সৌদি কারাগারে শিমুলী, মুক্তির আকুতি
সৌদি কারাগার - ছবি : সংগৃহীত
সৌদি আরবে জেদ্দার একটি কারাগারে ছয় মাস ধরে বন্দী বাংলাদেশী গৃহকর্মী শিমুলী বেগমের জীবন কাটছে মানবেতরভাবে। দুই সন্তানকে দেশে রেখে বিদেশে পাড়ি জমানো শিমুলী বেগম সুযোগ পেলেই ওই কারাগার থেকে টেলিফোনে স্বজনদের জানাচ্ছেন, জেল থেকে একে একে সবাই তো বের হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মুক্তির ডাক পড়ছে না। যেভাবেই হোক তাকে দ্রুত কারাগার থেকে মুক্ত করতে তিনি সরকারের কাছে আকুতি জানিয়েছেন।
এর আগে কারাবন্দী শিমুলী বেগমকে মুক্ত করে দেশে প্রেরণের আবেদন জানিয়ে বড় বোন চামেলী বেগম গত মাসে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। তার ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ড থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সৌদি আরবের জেদ্দার বাংলাদেশ কনসুলেট জেনারেল অফিসের কাউন্সেলরকে (শ্রম) চিঠি পাঠান। কিন্তু অভিযোগ দেয়ারও প্রায় এক মাস অতিবাহিত হলেও এখনো শিমুলী বেগমকে কারামুক্ত করে দেশে ফেরানোর বিষয়টি রহস্যজনকভাবে থমকে আছে। এ ঘটনার পর দিন যত যাচ্ছে শিমুলী বেগমের দেশে থাকা দুই সন্তানসহ স্বজনদের ততই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় পার করতে হচ্ছে।
চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি জেদ্দার কাউন্সেলরের (শ্রম) কাছে পাঠানো ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন ও উন্নয়ন) ও যুগ্মসচিব শোয়াইব আহমাদ খান স্বাক্ষরিত ৯ পাতার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, উপযুক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মী শিমুলী বেগম, পাসপোর্ট নম্বর-বিএফ ০৬০৬১০৫, বাবা জাফর মাতুব্বর, গ্রাম বড় লায়মন্দিয়া, পোস্ট তুগোলদিয়া, উপজেলা শালথা, জেলা ফরিদপুর। জেলে আছেন মর্মে তার বোন জানিয়েছেন। শিমুলী বেগমকে মুক্ত করে দেশে আনয়নের অনুরোধ জানিয়ে তার বোন চামেলী বেগম এ কার্যালয়ে আবেদন করেছেন। শিমুলী বেগমের মোবাইল নম্বর-০০৯৬৬৫৪৭০০৪৬৭ এবং তার নিয়োগকর্তার মোবাইল নম্বর ৯৬৬৮৮১২২৩৬৫৭২৬। তিনি রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স রানওয়ে ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১৩৪১) এর মাধ্যমে সৌদি আরব গমন করেছেন। এ অবস্থায় সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মী শিমুলী বেগমকে দেশে প্রেরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদনটি চিঠির সাথে পাঠানো হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়।
চিঠির অনুলিপি বাংলাদেশ দূতাবাস সৌদি আরব, জেলা প্রশাসক ফরিদপুর, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী এবং সচিবের একান্ত সচিব, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে দেয়া হয়। কিন্তু এর পরও কেটে গেছে ২৭ দিন। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিমুলী বেগম জেদ্দার সবচেয়ে বড় কারাগার মদিনা রোডের ‘দাওবান’ জেলখানাতেই বন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গতকাল জেদ্দার কাউন্সেলর (শ্রম) আমিনুল ইসলামের সাথে এ বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ফরিদপুরে থাকা শিমুলীর বড় বোন চামেলী বেগমের সাথে গত বুধবার সন্ধ্যার পর যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, জেদ্দার দাওবান কারাগারে বন্দী আমার বোনকে উদ্ধারে ঢাকায় দরখাস্ত দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এরপর তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে সেই কথা জানতে পারছি না। দুই দিন আগে আমার স্বামীকে খবর আনতে গাড়ি ভাড়া দিয়ে পাঠাইছিলাম। সেও কোনো সংবাদ আনতে পারল না। তিনি বলেন, আমার বোন মাঝে মধ্যে জেলখানা থেকে ফোন দিয়ে কথা বলে। কথা বলার সময় কান্না আর বলে, এই জেলে আসার পর ছয় মাস চইল্যা গেছে। বোন বলছে, আগে এখানে অনেক বাংলাদেশী বন্দী আছিল। এখন বেশি লোক নাই। সবাই আস্তে আস্তে চইল্যা যাইতাছে। খালি আমার কোনো ডাক আসতাছে না। এখন যে করেই হউক, তোমরা আমারে মুক্ত করার ব্যবস্থা করো।
শিমুলী কিভাবে গ্রেফতার হলেন জানতে চাইলে বোন চামেলী বেগম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের গ্রামের দালাল আমিনুল ইসলাম ৩৫ হাজার টাকা নিয়া তারে সৌদি আরবে পাঠাইছে। দুই বছর আগে যাওয়ার পর যে মালিকের বাড়িতে সে গেছিল সেখানে কাজকাম বেশি করা লাগছিল। তবে বেতন ২০ হাজার টাকা দিত। ওইখানে তার চাচাতো বোন আছিল। সে তারে বলছে, তোর সমস্যা হইলে আমার এখানে চইল্যা আয়। এর পরই সে পালিয়ে অন্য মালিকের কাছে কাজ নেয়। এক মাস পর পুলিশ ওই বাড়ি থেকে তারে ধইর্যাে নিয়া জেলে পাঠায়। আগের মালিকই তার নামে মামলা দিয়ে ধরাইয়্যা দিছে। এখন ধরা পড়ারও ছয় মাস চইল্যা গেছে। তারে জেলখানা থেকে ছাড়াতে পারছি না। তয় শিমুলী যখন সুযোগ পায় তখনই টেলিফোনে কথা বলে। তার কথা, আগের মালিক যতক্ষণ পুলিশের কাছে গিয়া তার ব্যাপারে না বলব ততক্ষণ তার ছাড়া পাওয়ার সুযোগ নাই। পাইলেও জেল খাটা শেষ হইলে ছাড়া পাইব। এর মধ্যে তারে একবার কোর্টে নিছিল। কিন্তু কাগজ তার হাতে না দিয়্যা তারে আবার জেলে নিয়্যো গেছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শিমুলীর স্বামী কুমিল্লায় গিয়া আরেকটা বিয়া করছে। আমার কাছে তার দুই পোলা রাইখ্যা গেছে। শিমুলীকে ছাড়ানোর জন্য দালাল আমিনুলের কাছে গেছিলাম। সে আমাগো কাছে আবার ৭০ হাজার টাকা চাচ্ছে। অভাবের সংসার। এর পরও জেলে থাকা বোান শিমুলীর জন্য তেল সাবান কিনতে আমরা ৮ হাজার টাকা পাঠাইছি। সেখানে তার অনেক কষ্ট হইতাছে। কিন্তু আমরা কি করলে বোনটা দেশে আইতে পারব, সেটাই তো বুঝতাছি না। যে টাকা লোন করে গেছিল আমাগো এখন সেই টাকার কিস্তিই মাসে মাসে টানতে হচ্ছে।