ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-চীন : সবার বিরুদ্ধেই সোচ্চার মাহাথির
মাহাথির মোহাম্মদ - ছবি : সংগৃহীত
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ভারতবিষয়ক যে মন্তব্য করেছিলেন, তা যে নরেন্দ্র মোদি সরকারকে হতাশাগ্রস্ত করবে, তা নিশ্চিতই ছিল। দুই বছর আগে মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে প্রচলিত ধারার বিপরীতে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের নেতৃত্বাধীন কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট জয়ের পর থেকেই কুয়ালামপুরে সবকিছু স্বাভাবিক চলছিল না। মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন সরকার এমনকি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী দেশগুলোর বিরুদ্ধেও কঠোর পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করছেন। তিনি চীনের সাথে আগের সরকারের করা বাণিজ্যচুক্তিগুলো নতুন করে সম্পন্ন করেছেন, এমনকি দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিতর্কে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন, আরো জোরালোভাবে মালয়েশিয়ার দাবি উত্থাপন করেছেন।
রাজনৈতিক লাইমলাইটে দীর্ঘ দিন ধরে অবস্থানের সময় মাহাথির সাদাকে সাদা, কালোকে কালোই বলেন। ৯৪ বছর বয়স্ক স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতায় থাকা ‘বারিসান ন্যাশনাল’ সরকারকে পরাজিত করতে অবসর ভেঙে রাজনীতিতে নামেন। ক্ষমতায় থাকুন বা না থাকুন, তিনি তার মতামত প্রকাশ করতে কখনো কুণ্ঠিত হননি। তিনি পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন নীতির সোচ্চার সমালোচক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে সামান্যই। যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে তিনি ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন ।
তিনি তার ভারতীয় প্রতিপক্ষ ও অন্য বেশির ভাগ বিশ্বনেতার বিপরীতে জেনারেল কাসেম সোলাইমানির ‘অনৈতিক’ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ।ঘন হিসেবে অভিহিত করে একে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে খুন করার সাথে তুলনা করেছিলেন।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আরো নানাভাবেও সৌদি রাজতন্ত্রকে ক্রুদ্ধ করেছিলেন। তার সরকার জোরালোভাবে জানিয়েছে, কিভাবে সৌদি ও আমিরাতিরা ১মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ কেলেঙ্কারি আড়াল করতে সহায়তা করেছিল। আধুনিক ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে বড় দুর্নীতিমূলক চুক্তি। ২০১৮ সালে জাতিসঙ্ঘে বক্তৃতাকালে তিনি সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ হিসেবে ইসরাইল সৃষ্টিকে দায়ী করেছিলেন এবং বিশ্বজুড়ে মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ এনেছিলেন।
ভারতের প্রতিশোধ
গত ডিসেম্বরে ভারত সরকার মালয়েশিয়া পাম ওয়েল আমদানির ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারত সরকার। বেসরকারি আমদানিকারকদেরকে গত বছরের নবেম্বরেই ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে’ অর্ডার দেয়া বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। আর চলতি বছরের শুরুতে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে তারা মালয়েশিয়া থেকে পাম ওয়ে আমদানি করা বন্ধ করবে। আমদানির ওপর কোনো আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে সরকার পাম ওয়েল আমদানি ‘মুক্ত’ থেকে ‘বিধিবদ্ধ’ তালিকায় স্থানান্তর করেছে। ভারত হলো ভোজ্য তেলের বৃহত্তম আমদানিকারক। আর মালয়েশিয়া হলো ভারতে পাম ওয়েলের প্রধান সরবরাহকারী।
ভারত সরকারের সিদ্ধান্তে আরো কয়েকটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মালয়েশিয়ার পাম ওয়েলের একটি বড় অংশ পরিশোধিত হয় নেপালে। সেখান থেকে তা ভারতে রফতানি হয়। নেপালও মালয়েশিয়ার পাম ওয়েল আমদানি বন্ধের ভারতীয় সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাশ্মির ও নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন (সিএএ) নিয়ে কঠোর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, সিএএ প্রসঙ্গে বলেছেন, ভারত দাবি করে যে সে সেক্যুলার দেশ, এখন সে নাগরিকত্ব থেকে মুসলিমদেরকে বঞ্চিত করছে। ভারত সরকার তার এই মন্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করে বলেছে, এটা একে অপরের অভ্যন্তরীণ নীতিতে হস্তক্ষেপ না করার কূটনৈতিক রীতির লঙ্ঘন।
দিল্লির বিজেপি সরকার কুয়ালামপুরে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই মাহাথিরের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। ভারতীয় টিভিতে ইসলামপ্রচারক জাকির নায়েককে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় প্রদান করা হয় ভারত সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও। অর্থ পাচার ও ‘বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার’ অভিযোগে তাকে আটক করতে চায় দিল্লি। মালশিয়া সরকারের মতে, ভারতে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে জাকির নায়েক ভারতে সুবিচার পাবেন না।
মাহাথির মোহাম্মদ স্বীকার করেছেন যে পাম ওয়েল আমদানির ওপর ভারতের নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশটির অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তবে তিনি তার মতে অটল থেকে বলেন যে ভারতে যা ঘটছে, তাতে সেখানকার অনেক লোকের মধ্যে কষ্টের সৃষ্টি হচ্ছে। পুরো দুনিয়া মনে করে, সেখানে অনেককে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনও মালয়েশিয়া থেকে পাম ওয়েল আমদানি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়ার হুমকি দিলে মাহাথির পাল্টা হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন যে তোমরা যদি মালয়েশিয়া থেকে পাম ওয়েল আমদানি করা কমিয়ে দাও, তবে আমরাও তোমাদের কাছ থেকে আমাদের আমদানি কমিয়ে দেব। ট্রাম্পের কথা মতো আমরা চলব না। তিনি বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আসিয়ান এক জোট হয়ে কাজ করতে পারে।
ভারত যদি পাম ওয়েল আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে, তবে মালয়েশিয়াও বদলা নিতে পারে। মাহাথিরের মিডিয়া উপদেষ্টা বলেছেন, তার দেশ ভারতীয় কর্মজীবীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। অবশ্য মালয়েশিয়া সরকার চাচ্ছে, এর কূটনৈতিক সমাধান। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে ভারত সরকারও ইঙ্গিত দিয়েছে, সে মালয়েশিয়ার সাথে উত্তেজনার প্রশমন চায়। মালয়েশিয়ায় বর্তমানে এক লাখের বেশি ভারতীয় কর্মরত রয়েছে। তারা বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের ৬ শতাংশ।
ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে যাওয়া দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের মার্কিননীতিই অনুসরণ করতে চায় ভারত সরকার। কিন্তু বিশ্ব নেতারা এখন কথা বলতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পশ্চিম এশিয়ার একটি সংবাদপত্রে বলেছেন, সিএএ ছিল অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার।
তবে প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন মাহাথিরই। তিনি সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন, ভারত কাশ্মিরে আক্রমণ চালিয়ে দখল করেছে। তিনি কাশ্মিরিদের ওপর অবরোধ আরোপের বিরুদ্ধে এক জোট হয়েছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানের বিরুদ্ধে।
ভারত সরকার তুরস্ককেও শাস্তি দিতে চেয়েছিল দেশটিকে কোনো নির্মাণচুক্তির দরপত্রে আহ্বান করার সুযোগ না দিয়ে। মাহাথির মোহাম্মদ, এরদোগান ও পাকিস্তানের ইমরান খান এখন ইসলামি বিশ্বের সমস্যাগুলো একটি ফোরাম গঠনে একমত হয়েছেন।
কাশ্মির ইস্যুতে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ওআইসি নীরব দেখে মুসলিম বিশ্বের অনেকেই সংস্থাটির ওপর হতাশ।
কাশ্মির ইস্যু
কুয়ালামামপুর সম্মেলনের প্রেক্ষাপটেই ওআইসি এপ্রিলে কাশ্মির প্রশ্নে বিশেষ অধিবেশন আয়োজনে সম্মত হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবসর গ্রহণের পর মাহাথির মোহাম্মদ মার্কিন যুদ্ধ মেশিনের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর জনমতকে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি যুদ্ধকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে কুয়ালামপুর ফাউন্ডেশন গঠন করেছিরেন। ২০০৩ সালে কুয়ালামপুরে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে তিনি কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার বাতিলের দাবি তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কোনো একটি দেশকে বিশ্বের পুলিশ হিসেবে রাখা যায় না। তার এই ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে ইরাক আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র।
মাহাথির ২০০৯ সালে কুয়ালামপুর ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন যুদ্ধবাজদের বিচার করতে। ট্রাইব্যুনালের ৫ বিচারকের আন্তর্জাতিক বিচারিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সরকার এতে সহায়তা করেনি। তবে ট্রাইব্যুনাল চার দিনের শুনানি শেষে জর্জ ডব্লিউ বুশ ও টনি ব্লেয়ারকে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছিল।
ফ্রন্ট লাইন