মানেকশ’ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : কিছু অজানা বিষয়
মানেকশ’ - ছবি : সংগ্রহ
‘পূর্ব পাকিস্তানের হাজার, হাজার শরণার্থী আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিম বঙ্গে প্রবেশ করছে। এ অবস্থায় আপনি কী করছেন?’ মন্ত্রীপরিষদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ জরুরি সভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও লৌহমানবী নামে খ্যাত ইন্দিরা গান্ধীর এ প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট ভাষায় জেনারেল মানেকশ জবাব দেন, “Nothing, it’s got nothing to do with me. You didn’t consult me when you allowed the BSF, the CRP and RAW to encourage the Pakistanis to revolt. Now that you are in trouble, you come to me. I have a long nose. I know what’s happening.” সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদের সামনে এমনভাবে কথা বলার মতো স্পষ্টভাষী, নির্ভীক, দুঃসাহসী ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী জেনারেল পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে একজনই আছেন, যিনি হলেন ফিল্ড মার্শাল স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ (Field Marshal Sam Hormusji Framji Jamshedji Manekshaw)।
তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সপ্তম প্রধান। দীর্ঘ নামের কারণে তিনি ‘Sam Manekshaw’, ‘Sam Bahadur’, ‘Sam the Brave’ ইত্যাদি নামে বেশি পরিচিত। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ-ভারতীয় মিলিটারি একাডেমি, দেরাদুনে প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে তিনি যোগদান এবং ১২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়নে কমিশন লাভ করেন। ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে সামরিক বাহিনীর বহু নামী-দামি জেনারেলের জন্ম হয়েছে যারা পরে বিভিন্ন সময়ে উভয় দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মানেকশ।
২। ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ ছিলেন পারসি বংশোদ্ভূত ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা। ১৯১৪ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তার পরিবার পারস্য বা ইরান থেকে ভারতে আগমন করেন। শুরুতে তারা গুজরাটের বালসাদ নগরীতে বসবাস শুরু করেন, পরবর্তীতে মুম্বাই। ১৯০৩ সালে মানেকশর বাবা-মা লাহোরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য ট্রেনে রওনা দেন। ট্রেনটি অমৃতসর পৌঁছানোর পর তার মা আর সামনে যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলে তাদের লাহোর যাওয়া হয়নি এবং স্থায়ীভাবে অমৃতসর বসবাস শুরু করেন। তার পরিবার প্রাচীন পারস্যের জরথুস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধী ছিলেন মানেকশদের পারিবারিক বন্ধু ও একই সম্প্রদায়ভুক্ত।
স্যাম মানেকশর বাবা ছিলেন ডাক্তার হরমুসজি মানেকশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে মেডিক্যাল কোরের ডাক্তার ছিলেন। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকেও ডাক্তার হিসেবে গড়ে তোলার। কিন্তু দূরন্ত ও অতি চঞ্চল স্যাম মানেকশ ১৯৩২ সালের পয়লা অক্টোবর সেনাবাহিনীর ভারতীয় মিলিটারি একাডেমি, দেরাদুনে প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ১৯৩৫ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। এ ব্যাচের ৪০ জন ক্যাডেটের মধ্যে মাত্র ২২ জন কমিশন লাভ করেছিলেন। তাদের সবাইকে এক বছরের অ্যান্টি ডেট প্রদান করা হয়। তার ব্যাচমেটদের মধ্যে ছিলেন বার্মার সেনাপ্রধান জেনারেল স্মিথ ডান এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ মুসা খান।
৩। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময়ে মানেকশ ছিলেন ১২তম ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়নের অফিসার যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অংশে পরিণত হয়। এ অবস্থায় তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অষ্টম গোরখা রাইফেলস ইউনিটে বদলি করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মায় সিতাং সেতু দখলের লড়াইয়ে তিনি আহত হন এবং সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য ‘মিলিটারি ক্রস’ লাভ করেন।
ভারতের সপ্তম সেনাপ্রধান হিসেবে ৮ জুন ১৯৬৯ থেকে ১৫ জানুয়ারি ১৯৭৩ পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। চল্লিশ বছরের বর্ণাঢ্য সামরিক জীবনে মানেকশ পাঁচটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক বিজয় অর্জিত হয় তার সুদক্ষ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। সেনাবাহিনীর প্রধান ও সব বাহিনী প্রধানদের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি এ যুদ্ধাভিযানের সামগ্রিক দায়দায়িত্ব পালন করেন। অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশলী ভূমিকা পালন করে মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে অল্প প্রয়াসে, স্বল্প জনবল ও অস্ত্রসম্ভার ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আশাতীত বিশাল বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হন। এতে তিনি ভারতের ইতিহাসে ‘চির অমর বীর পুরুষ’ হিসেবে খ্যাতি, শ্রদ্ধা ও সম্মানের শীর্ষ অবস্থান অর্জন করেন।
১৯৬২ সালে চীনের সাথে লজ্জাজনক পরাজয় এবং পাকিস্তানের সাথে ১৯৬৫ সালের অমীমাংসিত যুদ্ধের পর চিরশত্রুর বিরুদ্ধে এ অভাবনীয় বিজয়ের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মান তিনি পুনরুদ্ধার করেছিলেন। জাতির প্রতি এ অসামান্য অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৩ সালে তাকে ভারতের ইতিহাসে প্রথম ‘ফিল্ড মার্শাল’ অর্থাৎ পাঁচ তারকা জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে ‘জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ’ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন, যা তার অনন্য সাধারণ স্বীকৃতি। সর্বাবস্থায় তিনি দেশ ও সেনাবাহিনীর স্বার্থে কাজ করেছেন। কখনো কোনো আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ সহ্য করেননি। অত্যন্ত উচ্চ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সামরিক নেতা ছিলেন। ২০০৮ সালের ২৭ জুন মানেকশ মারা যান।
৪। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের জনযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে খাটো করে দেখেন তাদের উদ্দেশে বলছি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য ব্যতীত আর হয়তো সর্বোচ্চ দুই-তিন মাসের মধ্যে আমাদের সেনাবাহিনীর নিকটই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হতো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে দীর্ঘ সময়ে প্রশিক্ষিত হয়ে ও চাকরি করে তাদের সব দুর্বলতা সম্বন্ধে আমাদের সেনাবাহিনী অবহিত ছিল। তাই পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে বেগ পেতে হয়নি, সহজেই তারা কাবু হয়ে পড়ে। আট মাসের যুদ্ধে দেশের সর্বত্র পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী নভেম্বর মাসের শেষ দিকে পশ্চাদপসরণ করে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে। চতুর্দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে সেনানিবাসের ভেতরে তারা হয়ে পড়ে অবরুদ্ধ। আত্মসমর্পণ ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঠিক এ সময়ে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ‘বিনাযুদ্ধে মেদিনি জয়ের’ মতো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কেননা, পাকিস্তানি বাহিনী যখন ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে অতর্কিতে বাংলার নিরীহ মানুষ, বাঙালি সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসারের ওপর নির্মম, নিষ্ঠুর ও নৃশংস হামলা চালায়, তখন ৩ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধী মানেকশকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু মানেকশ সে সময়ে যুদ্ধ শুরু করলে ‘পরাজয় অনিবার্য’ হবে বলে সরাসরি এ নির্দেশ অমান্য করেন। এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ফিল্ড মার্শাল মানেকশর যে বাক্যালাপ হয় তা ১৯৯৫ সালের অক্টোবরে একটি অনুষ্ঠানে তিনি নিজে বর্ণনা করেছিলেন।
তা বহুল প্রচারিত ভারতীয় ম্যাগাজিন ‘আউটলুক’ এর ২৭ জুন ২০০৮ ‘When ‘Sam Bahadur’ confronted Indira Gandhi’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। নিচে তার অনুবাদ হুবহু তুলে ধরা হলো : “পদচ্যুতি বা ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হওয়ার মাঝে অতি ক্ষীণ একটি রেখা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যখন ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে (তদানীন্তন) পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং শত, হাজার শরণার্থী ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নিচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী তার অফিসে মন্ত্রিপরিষদের সভা আহ্বান করেন এবং আমাকে সেখানে তলব করেন। অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ, কঠোর মুখাবয়বে প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধী) পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীদের টেলিগ্রাম পাঠ করে শোনান। এরপর আমার দিকে ফিরে বলেন, ‘এই যে শরণার্থীরা আসছে, এ ক্ষেত্রে আপনি কী করছেন?’ ‘কিছুই না, এখানে আমার কিছুই করার নেই। বিএসএফ, সিআরপি এবং ‘র’ এর মাধ্যমে আপনি পাকিস্তানিদের মধ্যে বিদ্রোহের ইন্ধন যোগানোর সময় তো আমার সাথে পরামর্শ করেননি। এখন আপনি বিপদে পড়ে আমাকে ডেকেছেন। আমার নাক অনেক লম্বা। আমি জানি, কী কী ঘটে যাচ্ছে।’ তিনি বললেন, ‘আমি চাই আপনি পাকিস্তানে প্রবেশ করুন’। আমি উত্তরে বললাম, ‘এর মানে যুদ্ধ !’
তিনি বললেন, ‘যদি যুদ্ধ হয় তাই করুন।’ আমি বললাম, ‘আপনি কি প্রস্তুত ? আমি অবশ্যই না। এখন এপ্রিলের শেষ প্রান্ত। হিমালয়ের বরফ গলতে শুরু করেছে এবং চীন থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।’ প্রধানমন্ত্রীর দিকে ঘুরে আরো বললাম, ‘পূর্ব পাকিস্তানে বৃষ্টি শুরু হতে যাচ্ছে। ফলে সারা দেশ পানি ও বন্যায় একাকার থাকবে। হিমালয়ের বরফ গলে নদ-নদী মহাসাগরের রূপ নেবে। এ রকম পরিস্থিতিতে আমার সৈন্যবাহিনী কেবল সড়কের মধ্যে আটকে যাবে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিমান বাহিনীও সেনাবাহিনীকে কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না। পাকিস্তানিরা তখন আমাদের মাটিতে মিশিয়ে দেবে। ’ আরো বললাম, ‘তা ছাড়া সেনাবাহিনীর একটি বিশাল অংশ এখন পশ্চিম বঙ্গে নক্সালিদের বিরুদ্ধে অপারেশনে নিয়োজিত। এমতাবস্থায় তাদেরকে সংগঠিত করে পুনঃপ্রশিক্ষণ প্রদানে দেড়-দু’মাসের প্রয়োজন হবে।’
‘পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় এখন ফসল কাটার সময়। এখন দেশে যুদ্ধ শুরু হলে সব রাস্তা, রেলপথ, ঘোড়া ও গাড়ি ব্যবহার করতে হবে সৈন্য পরিবহনে। ফলে শস্য পরিবহন সম্ভব হবে না। এতে, ভারতে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে সবাই দোষ দেবে আমাকে। তা ঘাড়ে নিতে চাই না। আর্মার্ড ডিভিশন আমার মূল শক্তি। কিন্তু তাদের কাজ চালানোর মতো মাত্র ১২টি ট্যাংক আছে।’ ‘এর পরও আপনি যদি আমাকে এগিয়ে যেতে বলেন, আমরা যে পরাজিত হবো তা আপনাকে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি।’ ‘প্রধানমন্ত্রী, এখন আপনি আমাকে আদেশ করুন যুদ্ধ শুরু করবো কি না।’
উত্তেজিত ও ভয়ানক মুখাবয়বে প্রধানমন্ত্রী দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘কেবিনেট মিটিং মুলতবি। বিকেল ৪ টায় পুনরায় শুরু হবে’। মন্ত্রীরা এক এক করে বের হতে লাগলেন। কনিষ্ঠ হিসেবে সবার শেষে আমি যখন বের হচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী ডেকে বললেন, ‘চিফ, আপনি কি একটু অপেক্ষা করবেন?’ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘প্রধানমন্ত্রী, আপনি কিছু বলার আগেই আমি কি শারীরিক, মানসিক বা অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেবো?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনি যা বলেছেন সবই বাস্তব সত্য।’ ‘জি ! আমার দায়িত্ব হলো আপনাকে সঠিক ও সত্যটা বলা,’ আমি উত্তর দিলাম। ‘যুদ্ধ করা ও বিজয়ী হওয়া আমার কাজ এবং সত্যটা আপনাকে জানানোও আমার দায়িত্ব্’।
প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে শ্যাম, আপনি জানেন আমি কী চাই।’ ‘জি, আমি জানি আপনি কী চান’, আমি জবাব দিলাম।
জেনারেল মানেকশ বললেন, এই যুদ্ধ অবশ্যই আমার সময় অনুযায়ী হতে হবে। যুদ্ধে একজন মাত্র কমান্ডার থাকবে। আমার একজন মাত্র রাজনৈতিক অধিকর্তা থাকবেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী আমি কাজ করব, অন্য কারো নয়।
Ñ ঠিক আছে, স্যাম। আপনি অধিনায়ক, কেউ আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।
Ñ ধন্যবাদ। আমি আপনাকে সাফল্যের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।”
এভাবেই মানেকশ দীর্ঘ আট মাস নিজেদের প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা এবং মাত্র ১৩ দিন যুদ্ধ করেছিলেন।
সব রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে, দূরদর্শী মানেকশ তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সুকৌশলে বিজয়ী দলের সাথে খেলার শেষ পর্যায়ে দলীয় ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগদান করে বিজয়ের মালা ও চ্যাম্পিয়ন ট্রফিটা নিজ হাতে গ্রহণ করেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রণাঙ্গন সংবাদদাতা মুসা সাদিকের সাথে মানেকশ সাক্ষাৎকারে স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অসাধারণ অবদান সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা এবং দ্বিধাহীন চিত্তে তার অনুভূতি প্রকাশ করেন। মানেকশ বলেছিলেন, ‘এই যুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্ববাসী জানে। আমরাও জানি, এটা বাংলাদেশের যুদ্ধ। রণক্ষেত্রের অগ্রভাগে সাত-আট মাস ধরে তোমাদের হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করছে এবং তাদের জীবন উৎসর্গ করছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা প্রতিরোধে তোমাদের বাবা-মা তাদের সন্তানদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে রণাঙ্গনে পাঠাচ্ছেন। এটাকে তোমাদের জনগণ এখন জনযুদ্ধে রূপান্তর করেছে। একটা দেশের গোটা জনগোষ্ঠী তাদের রুখে দাঁড়িয়েছে বলে এ যুদ্ধ বেশি দিন চলতে পারবে না।’
রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছেন কি না, জানতে চাইলে মানেকশ বলেছিলেন, ‘না, এখনো দেখিনি। কিন্তু আমাদের ইস্টার্ন সেক্টরের যেসব জেনারেল রণাঙ্গনে তাদের ক্ষিপ্র গতির আক্রমণ দেখেছে, তাদের রিপোর্ট পাচ্ছি। শত্রুর ওপর তাদের ভয়ভীতিহীন আক্রমণ দেখে তারা (জেনারেলরা) বিস্মিত। আমার জেনারেলরা আমাকে বলেছেন, বীর বাঙালিরা জন্মভূমির জন্য রণাঙ্গনে জান কোরবানি দেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা বলতে পারেন, কিভাবে তোমাদের কিশোর, তরুণ, যুবক মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া এমন তুচ্ছ করে হাসিমুখে দেশের পায়ে নিজেদের বলি দিতে পারে। তিনি বলেন, দ্বিধাহীন চিত্তে আমার এই অনুভূতি প্রকাশ করা কর্তব্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র জানেন। তার নিখাদ মন্ত্রে এমন মৃত্যুঞ্জয়ী জাতি জন্ম নিয়েছে যে, এখন তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধু মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চায়। বাংলাদেশের বীর মুক্তিবাহিনীকে অভিবাদন। তাদের সামনে শুধু বিজয় অপেক্ষা করছে। বিধাতার আশীর্বাদে ধন্য হোক বাংলাদেশ।’
লেখক : সামরিক গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com