পাকিস্তানে কেন সামরিক হস্তক্ষেপ হয়?
ইমরান খান ও বাজওয়া - ছবি : সংগ্রহ
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর উপমহাদেশের মানচিত্রে দুটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটে- ভারত ও পাকিস্তান। দীর্ঘ ৭৩ বছরের পথ পরিক্রমায় পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে নিজস্ব মানচিত্র অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তা-ও ৪৮ বছর আগের কথা। এ দীর্ঘ সময়ে হাজারো চড়াই-উতরাই পেরিয়েও ভারতের গায়ে রাজনৈতিকভাবে যে পরিচয়টি শোভা পাচ্ছে- তা হলো বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। কথাটি প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও এটাই ব্যবহৃত হয় ভারতের জন্য। অন্য দিকে, পাকিস্তানের মূল রাজনৈতিক পরিচয়টা কেমন- তা পরিষ্কার হয়নি এ দীর্ঘ সময়েও, বরং ধোঁয়াশাটা আরও জেঁকে বসেছে। কারণ দেশটিতে যেমন সরাসরি সামরিক সরকারের শাসন দেখা গেছে বেশ কয়েকবার, ঠিক তার পাশাপাশি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আসা সরকারেও দেখা গেছে সামরিক বাহিনীর ব্যাপক প্রভাব। সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের মেয়াদ বৃদ্ধি ও সাবেক সেনাশাসক ও প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে।
পাকিস্তানের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়ই দেশটির সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ থাকে ব্যাপক হারে। আবার নির্বাচিত হয়ে আসার পরও সামরিক বাহিনীর মতের অন্যথা করতে গিয়ে অসময়ে পতনের শিকার হয়েছে দেশটির বেশ কয়েকটি বেসামরিক সরকার। বিশেষ করে পারমাণবিক বোমা, ভারত, কাশ্মির, আফগানিস্তানের মতো ইস্যুগুলোতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মতের বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়নি কোনো সরকারের পক্ষেই। এগুলোকে বাইরে রেখেই কোনো কোনো সরকার অবশ্য সেনাবাহিনীর প্রভাব খাটো করার চেষ্টা করেছিল। মোটা দাগে এ পর্যন্ত চারবার সে ধরনের প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে। প্রথম দফায় ১৯৭১ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো সে চেষ্টা করেছিলেন ১৯৮৮-৯০ এবং ১৯৯৩-৯৬ এ দু’দফায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যা বেনজির ভুট্টো এবং সবশেষ ২০০৮-এ প্রেসিডেন্ট হওয়া বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারি সে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চারবারই সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর এ রকম হস্তক্ষেপের মূল কারণ কী, বিশেষ করে যেখানে প্রতিবেশী ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ইরান, চীন কোনো দেশেই এরকম চর্চা একেবারেই নেই বা খুব কম? এর কারণ হিসেবে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যদি সুস্থ গণতন্ত্রের ধারা চালু না হয়, তাহলে সে দেশের শাসন ব্যবস্থায় সামরিক প্রভাব বাড়তে থাকে। আর সেটা একটি নির্দিষ্ট সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর আর নিয়ন্ত্রণে আনা বা তা থেকে বের হয়ে আসা খুবই দুরূহ। বর্তমান পাকিস্তান ও মিসর এর জাজ্জ্বল্য প্রমাণ। তুরস্কেও এ অবস্থা ছিল। কিন্তু খুব কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে তা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে দেশটি।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতা। সেখানকার কোনো রাজনৈতিক দলেই মূলত গণতন্ত্র নেই। কোথাও একনায়কতন্ত্র, কোথাও পরিবারতন্ত্র। সেই সাথে পরস্পরের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বিরোধ তো রয়েছেই। পাকিস্তানের এই ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সব সময়ের লাভ খুঁজে নিয়েছে দেশটির সামরিক শক্তি। পাকিস্তানে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে ঘোষণা দেয়া হয়, সেনাবাহিনী নির্বাচনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু প্রতিবারই স্পষ্ট হয়ে যায়, কিছু কিছু দল সামরিক শক্তির আশীর্বাদেই পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে আগ্রহী। বেশ কয়েক বছর ধরে সরাসরি ক্ষমতায় না এলেও এ সময়েও যে তাদের আশীর্বাদ ছাড়া সরকারে আশা যায় না, বা এলেও টেকা যায় না, তা দেশটির রাজনীতিকরাসহ দেশের সব সাধারণ মানুষই বোঝেন। একটু খেয়াল করলে বিষয়টি খোলাসাও হয়ে যায়। সামরিক বাহিনীর সাথে সরকারের যতদিন কোনো সঙ্ঘাত সৃষ্টি না হয়, ততদিন তারা নির্বিঘ্নে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু সামরিক বাহিনী যেসব ইস্যুকে নিজেদের বলে মনে করে, সেসব ক্ষেত্রে সরকারকে তাদের কথাই মেনে নিতে হয়। নইলে ব্যাপক জনপ্রিয় দলের ক্ষেত্রেও সরকার থেকে নেমে যাওয়ার ভিন্ন কোনো বিকল্প থাকে না। আর শুধু নেমে আসাই নয়, নিকট অতীতে যারা সরকার পরিচালনায় ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই অবসর জীবন পার করছেন চৌদ্দ শিকের ভেতর অথবা বিদেশ বিভূঁইয়ে।
তবে এ বিষয়টিও অনস্বীকার্য যে, পাকিস্তানে বেসামরিক শাসক গোষ্ঠীগুলো দেশটিতে কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য প্রশাসনযন্ত্র সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পেছনে থাকা কারণগুলোর মধ্যে দলীয় রাজনীতিতে একনায়কতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্রের ব্যাপক প্রভাবের বাইরেও আছে যোগ্যদের তুলনায় অধিকারীদের ব্যাপক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দুর্নীতি, নিষ্ক্রিয় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান; নাগরিকদের ব্যাপক দারিদ্র্য ও বঞ্চনা এবং ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে নেতা ও দলের প্রতি জনগণের কিছুটা বাধ্যবাধকতা। এর পাশাপাশি আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে- স্বাধীনতা পাওয়ার শুরুর দিকের বছরগুলোতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু বিষয়ের কারণে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে তার স্বাভাবিক পরিসরের চেয়ে বেশি দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। সেই চর্চা থেকেই একপর্যায়ে দেশের প্রশাসনে হস্তক্ষেপের বিষয়টি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। পাকিস্তানের রাজনীতিতেও দুটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়- একটি বেসামরিক এবং অন্যটি সামরিক। পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা নিরসনে প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং তার নৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মতো কঠিন কাজটি করতে হবে সবার আগে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অতীতে নির্বাচিত প্রায় সবগুলো সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক-দু’বছরের মধ্যে তাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হারিয়েছে। ফলে তারা সামরিক সংস্থাগুলোকে মোকাবেলা করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। আর এক্ষেত্রে সমস্ত সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধা সত্ত্বেও সামরিক শাসন বেসামরিক শাসনের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বেসামরিক সরকারগুলোর খারাপ রেকর্ড ও তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে বারবারই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ পরিপালনে অক্ষম হওয়ায় পাকিস্তানের চারটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর দুর্নাম থাকলেও দেশটির বেশির ভাগ জনগণের মতে, পাকিস্তানে সবচেয়ে বিশ্বস্ত, সুশৃঙ্খল সংস্থা হচ্ছে এই সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানের ইতিহাসের ৭৩ বছরের মধ্যে আমলা বা সামরিক জেনারেল শাসিত হয়েছে ৪৫ বছর।
দুর্বল রাজনৈতিক সংস্থা ও দল, অদক্ষ নেতৃত্বই নয়, পাকিস্তানের ভৌগোলিক ও জনমিতিক অবস্থাও দেশটির সরকারগুলোর ব্যর্থতা এবং প্রশাসনে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রাখছে। আর এ বাস্তবতার কারণে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল, রাজনীতিকদের প্রতি জনগণের আস্থা একেবারেই কম। একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, সেখানে সরকারের প্রতি জনগণের ৩৬, পার্লামেন্টের প্রতি ২৭, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ৩০ এবং রাজনীতিকদের প্রতি ২৭ শতাংশ আস্থা রয়েছে। কিন্তু সেখানে দেশটির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও আস্থাবান প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সামরিক বাহিনী। তাদের প্রতি ৮২ শতাংশ মানুষ আস্থা পোষণ করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাজনৈতিক অবস্থার প্রতি ব্যাপক আস্থাহীনতা এবং সামরিক বাহিনীর ওপর ব্যাপক আস্থা থাকার পরও পাকিস্তানিরা আবার গণতন্ত্র পছন্দ করে। ৮১ শতাংশ পাকিস্তানি যেখানে গণতন্ত্রকে সমর্থন জানিয়েছে, সেখানে মাত্র ১৯ শতাংশ লোক সামরিক শাসনকে স্বাগত জানিয়েছে।
সব মিলিয়ে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের শাসন ও সামরিক শাসন মিলেমিশে একাকার। এসব ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কোনো জনমত জরিপই কিন্তু চোখ বন্ধ করে মেনে নেয়া যায় না। কারণ ভারত-কাশ্মিরসহ স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোতে খুব কম সময়েই এ জরিপ পাল্টে যেতে পারে। ফলে পাকিস্তানের শাসন-প্রশাসন বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে না সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে দেখতে মানুষ পছন্দ করে, তা সূক্ষ্মভাবে বুঝতে পারা বড়ই আপেক্ষিক ব্যাপার।