প্যারাসাইট : এশিয়ার আমেরিকাজয়
প্যারাসাইট : এশিয়ার আমেরিকাজয় - ছবি : সংগৃহীত
একটু আগেই ‘প্যারাসাইট’–এর জন্য একটা অস্কার–পুরস্কার নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছেন ছবির পরিচালক বং জুন–হো। পুরস্কারটা ‘সেরা বিদেশি ছবি’র। আর তখনই দর্শকেরা ধরে নিয়েছেন, ‘এবারও হলো না’। দৌড়টা শেষ হয়ে গেল ওই ‘সেরা বিদেশি ছবি’ পর্যন্ত পৌঁছেই! ‘সেরা ছবি’র শিরোপাটা অধরাই রয়ে গেল এবারও, অ–ইংরেজি ছবির কাছে। হলিউড আর প্রথম দুনিয়ার বাইরে থাকা ছবির কাছে।
কিন্তু নাটক তখনো বাকি! মাঝখানে সেরা অভিনেতার পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠলেন ‘জোকার’ জোয়াকিন ফিনিক্স। এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন তারপর। তাতে দুনিয়াজুড়ে সব রকমের একাধিপত্যকে ধ্বংস করার ডাক। তার ভেতর জাতিগত একাধিপত্য আছে, লিঙ্গগত একাধিপত্য আছে, এমনকী মানুষের প্রজাতিগত একাধিপত্যের কথাও আছে। ফিনিক্স কি তখন জানতেন আর একটু পরেই দুটি একাধিপত্য অন্তত ধসে পড়তে চলেছে এদিনের সন্ধ্যায়, লস এঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটারের মঞ্চে! এক, ইংরেজি ভাষার আধিপত্য। তা ভেঙে এই প্রথম সেরা ছবি হতে চলেছে কোনও অ–ইংরেজি বিদেশি ভাষার ছবি। দুই, তাও আবার কোনও প্রথম দুনিয়া থেকে নয়! স্প্যানিশ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ–এর মতো ডাকসাইটে ভাষা ও হাঁকডাকওয়ালা সিনেমা–বানানো–দেশ থেকে নয়, বরং ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ এশিয়া থেকে! দক্ষিণ কোরিয়া থেকে!
অস্কার পুরস্কারের ৯২ বছরের ইতিহাস যে মোড় ঘুরতে চলেছে, নিশ্চিত বুঝেছিলেন জেন ফন্ডা। তাই নাটকীয় ‘পজ’ নিলেন চূড়ান্ত নামটি ঘোষণার আগে। ‘প্যারাসাইট’, বছরের সেরা ছবি! শেষ বলের ‘গুগলি’তে যেন ‘মিডল স্টাম্প’ উপড়ে গেল হলিউডের। ইতিহাস! একই ছবি এক বছরে সেরা বিদেশি ছবি, সেরা ছবি। সেই সঙ্গে সেরা পরিচালক। একেবারে ত্রিমুকুট। প্যারাসাইট চতুর্থ অস্কার পেল সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের জন্য।
লড়াইটা কিন্তু সোজা ছিল না। প্রতিদ্বন্দ্বী কারা? বিপক্ষে পরিচালক কারা? টড ফিলিপসের ‘জোকার’, স্যাম মেন্ডেসের ‘১৯১৭’, কোয়ান্টিন টারান্টিনোর ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন হলিউড’, মার্টিন স্করসেসির ‘দ্য আইরিশম্যান’। প্রতিটি বাণিজ্য ও সমালোচক–ধন্য ছবি। জোকার আর ১৯১৭ হইহই ফেলে দিয়েছিল পৃথিবী জুড়ে। তুলনায় পরিচালকের নামডাকে ‘প্যারাসাইট’ নেহাতই ‘অর্বাচীন’।
আসলে সিনেমার ‘সূর্যোদয়’ এখন এশিয়ায় হয়। আগে ‘সিরিয়াস’ সিনেমায় যে সম্মান পেত ফেলিনি–আন্তনিওনির ইতালি কিংবা গদার–ত্রুঁফোর ফ্রান্স, তা এখন পায় ইরান। কিয়োরেস্তামি–পানাহি–মখমলবাফ খচিত ইরান। পাশাপাশি গত এক দশকে দুরন্ত গতিতে উঠে এসেছে দক্ষিণ কোরিয়ার কিম কি দুক। যাঁর ছবি এখন পশ্চিমি দুনিয়ায় ‘কাল্ট’। তাঁর একটু আগে পরে জাঁ সু ইল, কোন টায়েক ইম বা বং জুন–হো’রাও দক্ষিণ কোরিয়ার ছবিকে এনে দিয়েছেন বিশ্ব মানচিত্রে। কিম কি দুক অতীতে ভেনিসে ‘স্বর্ণসিংহ’ পেয়েছেন। বং জুন হো’র এই ‘প্যারাসাইট’ কান–এ পেয়েছে ‘পাম ডি ওর’। এগুলো ছিলই। কিন্তু সিনেমা–ব্যবসার সবচেয়ে বড় দুর্গ খোদ হলিউডেই এবার কামান দাগল দক্ষিণ কোরিয়া।
‘প্যারাসাইট’ দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমা–ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যবসা করা ছবি। সদ্য আমেরিকায় মুক্তি পেয়ে এরই মধ্যে সেখান থেকেও এ ছবি তুলে ফেলেছে ৩৬ মিলিয়ন ডলার।
বিনোদনধর্মী নয়, এ ছবি রূপকের আড়ালে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলে। এক ধনী পরিবারে পরিচয় গোপন করে আশ্রয় নেয় এক গরিব পরিবার। যাদের পদবি কিম। এই কিম পরিবারের সঙ্গে আবার এই আশ্রয় নিয়ে লড়াই বাধে ওই বাড়িতে অতীতে কাজ করে যাওয়া এক দম্পতির। যারা আত্মগোপন করে থাকে ওই বাড়ির এক চোরাকুঠুরিতে। একদিকে এই দুই পরিবার। অন্যদিকে বাড়িওয়ালা পার্ক পরিবার। ছবি শুরু হয় কমেডির ঢংয়ে। ধীরে ধীরে তা এগিয়ে চলে মর্মান্তিক এক মৃত্যু ও করুণ পরিণতির দিকে। এমন চিত্রনাট্য সত্যিই হলিউডের বাজারে অমিল। এ ছবি প্রবল রাজনৈতিক। সারা পৃথিবী এখন ধুঁকছে লুকোনো অভিবাসনে, আর্থিক মন্দায়, শ্রমহীনতায়, অসহিষ্ণুতায়। এর প্রতিটি মাত্রাই কোনও না কোনওভাবে থেকে গেছে এ ছবিতে।
‘জোকার’ খানিকটা সান্ত্বনা পেয়েছে সেরা অভিনেতার পুরস্কারে। সঙ্গে সেরা মৌলিক সঙ্গীত। সেরা অভিনেত্রী রেনে জেলওয়েগার। অতীতের নক্ষত্র জুডি গারল্যান্ডের জীবনী–ছবি ‘জুডি’তে নামভূমিকায় অভিনয় করে। ব্র্যাড পিট সেরা সহ–অভিনেতা হয়েছেন ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন হলিউড’–এর জন্য। সেরা সহ–অভিনেত্রী লরা ডার্ন ‘ম্যারেজ স্টোরি’র জন্য।
সূত্র : আজকাল