চীনের করোনায় পুড়বে লঙ্কা!
চীনের করোনায় পুড়বে লঙ্কা! - ছবি : সংগৃহীত
গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধদের প্রার্থনা অনুষ্ঠান শুরু করেছে। লক্ষ্য একটাই ‘বন্ধুপ্রতীম’ চীনকে করোনাভাইরাসের অভিশাপ থেকে রক্ষা করা। ক্যান্ডিতে (এখানেই সবচেয়ে পবিত্র ‘টেম্পল অব দি টুথ’ রয়েছে) শুরু হয়ে এখন সৌন্দর্যমণ্ডিত নিলিগলা মন্দিরে আনুষ্ঠানিক প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। দুই মন্দিরেই বিপদ, দুর্যোগ ও রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মন্ত্র যপ করা হয়।
চীনা সরকার ও চীনা নাগরিকদের জন্য বৌদ্ধধর্মের এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে শ্রীলঙ্কা-চীন বুড্ডিস্ট ফ্রেন্ডশিপ এসোসিয়েশন। এ ধরনের অনুষ্ঠান আরো কয়েকটি মন্দিরে আয়োজন করা হয়। এসবের মধ্যে ছিল ফেব্রুয়ারিতে হওয়া কেলিনিয়া টেম্পলের অনুষ্ঠান। আর ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুরাধাপুরার প্রাচীন মন্দিরেও আরেকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
এদিকে সরকারি সফরে ভারত রওনা হওয়ার আগে বুধবার প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপাকসা কলম্বোর অভয়ারাম মন্দিরে চীনের জন্য প্রার্থনা করেন। এ সময় মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যসহ চীনা দূতাবাসের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং শ্রীলঙ্কায় বসবাসকারী চীনা নাগরিক ও শত শত শ্রীলঙ্কান উপস্থিত ছিলেন।
শ্রীলঙ্কা যখন নিজেই বন্যা, সুনামি, ভূমিধস, যুদ্ধ ও সন্ত্রাসী হামলার মতো নানা ট্রাজেডির মোকাবিলা করছে, তখনই তারা চীনের সমর্থনে প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
চীনের জন্য প্রার্থনা অনুষ্ঠানের সময়ই শ্রীলঙ্কার পর্যটন বোর্ড একটি গ্রাফিক সোস্যাল মিডিয়া নোটিশ প্রকাশ করে। এতে লেখা ছিল যে ‘আমরা চীনের পাশে আছি।‘ এতে করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শের ভয়ে কিছু রেস্তোরাঁ ও ট্যাক্সিতে চীনা কাস্টমারদের গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষাপটে এই নোটিশ প্রকাশ করে। এতে আরো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে আতঙ্ক সত্ত্বেও চীনা পর্যটকদের গ্রহণ করা অব্যাহত রাখবে চীন।
শ্রীলঙ্কা বেশ কার্যকরভাবে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখন পর্যন্ত প্রথম ও একমাত্র রোগী পাওয়া গেছে। তিনি চীনা এক নারী পর্যটক। তাকে ৫ দিন হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা প্রদান করার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, গত মাসে শ্রীলঙ্কায় আগত চীনা পর্যটকেরা তাদের ভিসার মেয়াদ বাড়াতে চাইছেন। কারণ তারা ওই ভাইরাসের ভয়ে দেশে ফিরত চাচ্ছেন না।
আক্রান্ত উহান প্রদেশে অধ্যয়নরত শ্রীলঙ্কানদের গত সপ্তাহে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদেরকে কোয়ারাটাইনে রাখা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কারো মধ্যে ভাইরাসটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। অবশ্য সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য কর্মকর্তরা সন্দেহভাজন হিসেবে ১৫ জনকে পরীক্ষা করেছে।
করোনা ভাইরাস কার্যত চীনকে বেশ বিপর্যয়ে ফেলে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে ৩১,১৬১ জন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পর্যটনের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল শ্রীলঙ্কা করোনা ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে চিন্তা করছে।
২০১৭ সালে চীনের জিডিপি ছিল ১২.২৭ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক প্রভাব মাত্র ১ ভাগ হলেও এর মূল্য দাঁড়াবে ১২২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার জিডিপি ছিল ৮৭.১৭ বিলিয়ন ডলার। চীনের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি হওয়ায় অর্থনৈতিক তাৎপর্যও হবে উচ্চ।
প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপাকসার সরকারি বিবৃতিতে অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ক্ষুদ্রদের অন্যতম। বর্তমানে এর প্রবৃদ্ধি শম্বুক গতিতে চলছে, মাত্র ৩ ভাগ করে। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে বাজেট ঘাটতি হতে পারে ৭ ভাগের মতো উচ্চ এবং ঋণ হতে পারে জিডিপির ৮০ ভাগের মতো।
করোনা ভাইরাসের কারণে চীনা অর্থনীতি যদি বিপর্যয়ে পড়ে, তবে তা শ্রীলঙ্কাকেও কঠোরভাবে আঘাত হানবে। চীনের কাছ থেকে বিপুল ঋণ গ্রহণ করেছে শ্রীলঙ্কা এবং সে ঋণের ব্যাপারে কিছু ছাড়ও চাইতে পারে।
ভারতে সরকারি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপাকসা দ্বীপদেশের ঋণের বোঝাকে ভয়াবহ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনি ভারতসহ ঋণদাতাদের প্রতি অনুরোধ করেন তিন বছরের জন্য ছাড় দেয়া হলে ভালো হয়। ধারণা করা হচ্ছে, চীনের কাছেও একই ধরনের প্রস্তাব পাঠাবে শ্রীলঙ্কা।
নয়া দিল্লিতে সফরকালে মহিন্দা রাজাপাকসা যেসব বিবৃতি দিয়েছেন, তার আলোকেই বোঝা যেতে পারে শ্রীলঙ্কার দাবির প্রতি ভারতের মনোভাব কী ছিল। তিনি ঘোষণা করেছেন যে তার সরকার ২০১৭ সালে ভারতের সাথে করা সমঝোতা স্মারকগুলো তিনি বাস্তবায়ন করবেন না, কারণ সেগুলো করেছিল পূর্ববর্তী সরকার। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে ফাঁকা বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত মাত্তালা বিমানবন্দরটিকে (ভারত এটিকে কেনার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী) কোনো বিদেশী দেশকে দেয়া হবে না।
আবার ১৯৮৭ সালে ভারতের মধ্যস্ততায় তামিলদের সাথে করা চুক্তিতে তাদেরকে কিছু ক্ষমতা প্রদান করার বিষয়টি বাস্তবায়ন করার জন্যও প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসা কিছু সময় চেয়েছেন। আবার তার ভাই ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কা পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে তার শাসনামলে ক্ষমতার কোনো ভাগাভাগি হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসা বলেছেন, নর্দার্ন ও ইস্টার্ন প্রাদেশিক কাউন্সিলের নির্বাচনের পর ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কলম্বো সরকার নির্বাচিত নেতাদের সাথে আলোচনা করতে আগ্রহী।
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার মতভেদ নিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রশ্নের জবাবে মহিন্দা বলেন, প্রাদেশিক কাউন্সিলগুলোকে শক্তিশালী করা হবে ঠিকই, তবে সেগুলোর লক্ষ্য থাকবে অর্থনীতি। গোতাবায়ার মতো মহিন্দাও বিশ্বাস করেন যে অর্থনৈতিক কল্যাণেই জাতিগত বিভেদ মুছে যেতে পারে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রাজাপাকসা জোর দিয়ে বলেন, শ্রীলঙ্কা এ থেকে বিপুল কল্যাণ লাভ করছে। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে চীনের হিস্যা মাত্রা ১২ ভাগ।
শ্রীলঙ্কার নতুন শাসকমণ্ডলীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে প্রতিযোগিতামূলক শক্তিগুলো- ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন- মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। কারণ ভারত মহাসাগরের কৌশলগত অবস্থানে থাকায় শ্রীলঙ্কার প্রতি ওই দেশগুলোর ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।
এই তিন দেশের মধ্যে ভারত ও চীন ইতোমধ্যেই শ্রীলঙ্কায় তাদের পা ফেলে রেখেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে মিলিনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন কমপ্যাক্ট (এমসিসি) ও স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্টের (সোফা) মাধ্যমে স্থান করে নিতে। উভয় ব্যাপারে মহিন্দা রাজাপাকসা বলেছেন, বিষয়গুলো বিবেচনায় রয়েছে।