এক দিন স্বপ্নের দিন
এক দিন স্বপ্নের দিন - ছবি : সংগৃহীত
ইতিহাস লিখল বাংলাদেশের যুবারা। দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে পতপত করে উড়ল লাল-সবুজের পতাকা। বিশ্ব আরো একবার শুনল বাঘের গর্জন। ব্যাটে বলে যে কাব্য লিখেছে আকবর আলীর দল তা এ দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় একটি স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হলো।
১৯৯৭ সালে আকরাম খানদের হাত ধরে আইসিসি ট্রফির শিরোপা জয়ের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় অনূর্ধ্ব-১৯ দল যেন লিখল আরেক কাব্যগাথা। আইসিসি ট্রফির সেই ম্যাচেও ছিল বৃষ্টির হানা, ছিল টানটান উত্তেজনা। গতকাল পচেফস্ট্রুমেও একই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। আশা-নিরাশার দোলাচলের মধ্যে ছিল বৃষ্টির বাধা। যার কারণে দর্শকদের মনে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের কিলাত কিলাব মাঠের সেই স্মৃতি হয়তো হানা দিয়ে গেছে আকবার আলীদের বিজয় দেখতে দেখতে।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জয় করল কোনো বিশ্ব আসরের শিরোপা। যেকোনো জাতির জীবনে এমন অর্জন সত্যিই অবিস্মরণীয়। গতকাল পচেফস্ট্রুমে ভারতেকে হারিয়ে বাংলাদেশ জিতল যুব বিশ্বকাপের ১৩তম আসরের শিরোপা। প্রথমবারে ফাইনালে উঠেই বাজিমাত। চারবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে গলায় বিজয়ের মালা পরেছেন বাংলাদেশের তরুণরা। এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে যুব এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠেও অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়েছিল শিরোপা। ৫ রানে এই ভারতের কাছেই হেরেছিল আকবর আলীর দল। সেবার ভারতকে ১০৬ রানে অলআউট করে দিয়েও অল্পের জন্য ধরা দেয়নি শিরোপা। সেদিনও ব্যাট হাতে মিডল অর্ডারে লড়াই করেছিলেন অধিনায়ক আকবর আলী; কিন্তু শেষটা করতে পারেননি। ভগ্নহৃদয়ে সেদিন ফিরতে হয়েছিল শ্রীলঙ্কা থেকে। এবার যেন আরো বড় অর্জন ছিনিয়ে এনে সেই আক্ষেপ ঘুচাল তারা। যুব বিশ্বকাপের নতুন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নাম লেখাল লাল-সবুজের দল।
টুর্নামেন্টের শুরুর আগেই অধিনায়ক ঘোষণা করেছিলেন তার দল টুর্নামেন্টের শেষ পর্যন্ত যেতে চায়। সেই অঙ্গীকার পূরণ করল বীর সেনানিরা। পূর্বসূরিরা যা পারেননি, সেটিই তারা করে দেখালেন রোববার দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে।
দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে অনুষ্ঠিত ম্যাচে টস জিতে প্রথমে বোলিং-এর সিদ্বান্ত নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর আলী। টস জিতে বোলিং নেয়ার কারনটা এভাবে ব্যাখা করেন আকবর, ‘দিনের শুরুতে উইকেটের ময়েশ্চার কাজে লাগাতেই এমন সিদ্বান্ত।’ তাই একাদশে তিন পেসার। দুই পেসার শরিফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান সাকিবের সাথে একাদশে সুযোগ পান অভিষেক দাস। পুরো আসরে গ্রুপ পর্বে কেবলমাত্র পাকিস্তানের বিপক্ষে একাদশে ছিলেন তিনি। কিন্তু বৃষ্টির কারণে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হওয়ায় বল করতে পারেননি অভিষেক।
তবে বল হাতে বাংলাদেশের হয়ে বোলিং শুরু করেন দুই উদ্বোধনী পেসার শরিফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান সাকিব। প্রথম ছয় ওভারে ভারতের দুই ওপেনারকে রানই করতে দেননি শরিফুল ও সাকিব। মাত্র ৮ রান তুলতে পারেন ভারতের দুই ওপেনার যশবী জয়সওয়াল ও দিব্যানাশ সাক্সেনা। সাকিব ৩ ওভারে ১ ও শরিফুল ৩ ওভারে ৭ রান দেন। দুই উদ্বোধনী বোলার সাফল্য এনে দিতে না পারায় সপ্তম ওভারে অভিষেকের হাতে বল তুলে দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর। বল হাতে নিয়েই চতুর্থ ডেলিভারিতে সাফল্যের স্বাদ নেন অভিষেক। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে মাহমুদুল হাসান জয়কে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ১৭ বলে ২ রান করা সাক্সেনা।
দলীয় ৯ রানে প্রথম উইকেট পতনের পর আরেক ওপেনার জয়সওয়াল ও তিন নম্বরে নামা তিলক ভারমার ব্যাটিং দৃঢ়তায় শুরুর ধাক্কা সামলে শতরানের গন্ডি পেরোয় ভারত। তবে তাদেরকে দ্রুত রান তুলতে দেননি বাংলাদেশের বোলাররা। ২৯ ওভারে যখন ভারতের দ্বিতীয় উইকেটের পতন ঘটে তখন রান ১০৩। জয়সওয়াল ও ভারমার জমে যাওয়া জুটিতে ভাঙ্গন ধরান সাকিব। ৬৫ বলে ৩টি চারে ৩৮ রান করে আউট হন ভারমা। দ্বিতীয় উইকেটে ১৩৪ বল মোকাবেলা করে ৯৪ রান যোগ করেন তারা।
ভারমার আউটে ক্রিজে যান অধিনায়ক প্রিয়ম গার্গ । উইকেটের সাথে সেট হবার আগেই তাকে বিদায় দেন এই আসরে বাংলাদেশের পক্ষে হ্যাট্টিক করা রকিবুল হাসান। ৭ রান করেন গার্গ। এতে ১১৪ রানে তৃতীয় উইকেট হারায় ভারত।
সতীর্থরা এক প্রান্ত দিয়ে পতনের তালিকায় নাম তুললেও, অন্যপ্রান্ত দিয়ে সর্তকতার সাথে রান তোলার কাজটি সাড়ছিলেন সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা জয়সওয়াল। ৮৯ বলে হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি। হাফ-সেঞ্চুরির পর মারমুখী হয়ে উঠে তাই পরের ৩২ বলে ৩৮ রান যোগ করে টানা দ্বিতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরির পথে ছিলেন জয়সওয়াল। কিন্তু ব্যক্তিগত ৮৮ রানে থামতে হয় জয়সওয়ালকে। শরিফুলের ১৩০ কিলোমিটার গতি বাউন্সার কিভাবে মারবেন সেই দোটানায় ভুগে শর্ট মিড উইকেটে তানজিদ হাসানকে ক্যাচ দেন জয়সওয়াল। ১২১ বল খেলে ৮টি চার ও ১টি ছক্কায় নিজের দায়িত্ববান ইনিংসটি সাজান জয়সওয়াল।
জয়সওয়ালকে বিদায় করার পরের ডেলিভারিতে সিদ্বেশ বীরকে লেগ বিফোর ফাঁদ ফেলেন শরিফুল। ফলে শুন্য হাতে ফিরতে হয় ভিরকে।
জয়সওয়ালের আউটটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় ভারতের জন্য। কারন ২১ রানে শেষ ৬ উইকেটের পতন হয় ভারতের। বীরের পর থেকে আর কোন ব্যাটসম্যানই দু’অংকের কোটা স্পর্শ করতে পারেনি। এরমধ্যে উইকেটরক্ষক ধ্রুব জুরেলের উইকেটও ছিলো। ৩৮ বলে ১টি চারে ২২ রান করে রান আউট হন তিনি।
ভারতকে ৪৭ দশমিক ২ ওভারে গুটিয়ে প্রধান ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশের পেসার অভিষেক। ৪০ রানে ৩ উইকেট নেন তিনি। শরিফুল-সাকিব ২টি করে উইকেট নেন। ১টি উইকেট নিয়েছেন রকিবুল।
১৭৮ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভারেই ১৩ রান তুলে নেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার ইমন ও তানজিদ হাসান। তানজিদের ব্যাট থেকে আসে ২টি চার।
এরপর দেখেশুনে এগোতে থাকেন ইমন ও তানজিদ। ফলে পরের ৭ ওভারে ৩১ রান উঠাতে পারেন তারা। প্রথম ৮ ওভারে তিন বোলার ব্যবহার করেও বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গতে পারেননি ভারতের অধিনায়ক গার্গ। তাই নবম ওভারে লেগ-স্পিনার রবি বিশনোইকে আক্রমনে আনেন ভারত দলপতি। দ্বিতীয় বলেই বিশনোইর উপর চড়াও হন তানজিদ। স্লগ সুইপে মিড-উইকেট দিয়ে ছক্কা মারেন তানজিদ। কিন্তু পঞ্চম বলে বিশনোইকে উইকেট দেন তানজিদ। ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ২৫ বলে ১৭ রান করেন তানজিদ।
দলীয় ৫০ রানে প্রথম উইকেট পতনের পর জুটি বাঁধেন ইমন ও তিন নম্বরে নামা মাহমুদুল হাসান জয়। বড় জুটির চেষ্টায় ছিলেন তারা। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেনি এই জুটি। সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি করা জয়কে নিজের দ্বিতীয় শিকার বানান বিশনোই। ৮ রান করেন জয়। জয়ের পর ওপেনার ইমনকেও হারায় বাংলাদেশ। তবে আউট হননি তিনি। পায়ে চোট পেয়ে আহত অবসর হয়ে মাঠ ছাড়েন ইমন। তখন তার নামের পাশে ছিলো ৪২ বলে ২৫ রান। এতে উইকেটে যান নতুন দুই ব্যাটসম্যান তৌহিদ হৃদয় ও শাহাদাত হোসেন।
নতুন দুই ব্যাটসম্যানকে উইকেটে থাকতে দেননি বিশনোই। হৃদয় শুন্য ও শাহাদাত ১ রান করে আউট হন। ফলে মাত্র ৩ রানের ব্যবধানে জয়-হৃদয়-শাহাদাতকে হারিয়ে মহাবিপদেই পড়ে বাংলাদেশ। ৫০ রানের সূচনার পর ৬৫ রানে ৪ উইকেট নেই বাংলাদেশের।
এ অবস্থায় দলের হাল ধরেন অধিনায়ক আকবর ও শামিম হোসেন। বিশনোইর ঘুর্ণিতে পথ হারানো বাংলাদেশকে লড়াইয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেন আকবর ও শামিম। ২০ রানের জুটি গড়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলেন তারা। কিন্তু তাদের বিচ্ছিন্ন করেন ভারতের বাঁ-হাতি পেসার সুশান্ত মিশ্র। ৭ রান করা শামিমকে প্যাভিলিয়নের পথ দেখান মিশ্র। এরপর অভিষেক দাস ৫ রান করে মিশ্রর শিকার হন। এমন অবস্থায় ১০২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে আবারো চাপে পড়ে বাংলাদেশ।
অভিষেকের বিদায়ে উইকেটে আসেন আহত অবসর নেয়া ইমন। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনা করে অধিনায়কের সাথে বড় জুটি গড়ার চেষ্টা করেন ইমন। তাতে সফল হন দু’জনে। সপ্তম উইকেটে ৪১ রানের জুটি গড়েন বিচ্ছিন্ন হন আকবর ও ইমন। হাফ-সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগিয়ে ৪৭ রানে থামেন ইমন। ৭টি চারে ৭৯ বল মোকাবেলা করে নিজের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসটি সাজান ইমন।
ইমন যখন ফিরেন তখন হাতে ৩ উইকেট নিয়ে জয়ের জন্য ৩৪ রান প্রয়োজন ছিলো বাংলাদেশের। বল ছিলো ১০৮টি। ম্যাচের লাগাম অনেকটাই ভারতের পক্ষে ছিলো। কিন্তু টেল-এন্ডার রকিবুলকে নিয়ে সর্তকতার সাথে পথ চলতে শুরু করেন অধিনায়ক আকবর। কোন প্রকার ঝুঁকি না নিয়ে উইকেটে টিকে থাকার চেষ্টা করেন আকবর ও রকিবুল। ইমনের ফিরে যাবার টানা তিন ওভার কোন রানই নেননি তারা।
শেষমেষ ৩৬তম ওভারে ৪ রান তোলেন আকবর-রকিবুল। এরপর ৪১ ওভার শেষে অবিচ্ছিন্ন থেকে দলের স্কোর ১৬৩ রানে নিয়ে যান তারা। অর্থাৎ জয়ের জন্য ১৫ রান প্রয়োজন বাংলাদেশের। এ অবস্থায় আর্শীবাদ হিসেবে নেমে আসে বৃষ্টি। ফলে বন্ধ হয়ে যায় খেলা। আর্শীবাদের বৃষ্টিতে নতুনভাবে ম্যাচ জয়ের টার্গেট পায় বাংলাদেশ। তাহলো- ৪৬ ওভারে ১৭০ রান। অর্থাৎ, ৩০ বলে ৭ রান। এই কাজটুকু সাড়তে ৭ বল লাগে আকবর ও রকিবুলের। তাই ২৩ বল বাকী রেখেই বিশ্ব জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ।
ছয় নম্বরে নেমে ৪টি চার ও ১টি ছক্কায় ৭৭ বলে অপরাজিত ৪৩ রানের অধিনায়কোচিত ইনিংস খেলেন আকবর। এই ইনিংসেই বিপদে পড়েও জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। ২৫ বলে ৯ রানে অপরাজিত ছিলেন রকিবুল। ভারতের বিশনোই ৩০ রানে ৪ উইকেট নেন। ম্যাচ সেরা বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর আলী। টুর্নামেন্ট সেরা: যশবী জয়সওয়াল (ভারত)।
সংক্ষিপ্ত স্কোর কার্ড :
ভারত : ১৭৭/১০, ৪৭.২ ওভার (জয়সওয়াল ৮৮, ভারমা ৩৮, অভিষেক ৩/৪০)।
বাংলাদেশ (টার্গেট- ১৭০ রান) : ১৭০/৭, ৪২.১ ওভার (আকবর ৪৩*, ইমন ৪৭, বিশনোই ৪/৩০)।
ফল : বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ বৃষ্টি আইনে ৩ উইকেটে জয়ী।