চলনবিলের একটি নদীর মর্মান্তিক মৃত্যু
চলনবিলের প্রাণ বড়াল নদী - নয়া দিগন্ত
পদ্মা-যমুনার প্লাবন ভূমি চলনবিলের প্রাণস্বরূপ বড়াল নদী মানচিত্র থেকে হরিয়ে যেতে বসেছে। এই নদী রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে ২০৪ কিলোমিটার পথ প্রবাহিত হয়ে পাবনার বেড়ার মোহনগঞ্জে যমুনায় মিলিত হয়েছে। চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখে নির্মাণ করায় বড়াল সংযুক্ত বিল, নদী ও খাড়ির বেশির ভাগ অংশই শুকিয়ে গেছে। এর বিরূপ প্রভাবে কমেছে মাছ, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া ও জলজ গুল্মলতা। পানির অভাবে নদী-বিল কেন্দ্রিক ব্যবসায়-বাণিজ্য ও চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে এ অঞ্চলের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
পদ্মা ও যমুনার পানি বড়াল নদী হয়ে প্রবেশ করে চলনবিলে। এতে বিল, নদী ও খাড়ি চালু থাকে। সে কারণেই বিলটির নাম হয়েছে ‘চলন’। এই বিলের পানি সর্বদাই চলমান ছিল। চলনবিলের অভ্যন্তরে অসংখ্য ছোট-বড় নদী, বিল ও খাল রয়েছে। এসব বিল ও খাল প্রাকৃতিক। আবার বিল থেকেও ছোট নদীর উৎপত্তি হয়েছে। নদী থেকে খালও হয়েছে। এক কথায় বলা চলে চলনবিল হচ্ছে অসংখ্য স্র্রোতের জাল। আর এই জালের প্রধান সূত্র হচ্ছে বড়াল নদী। এ নদী থেকে আরও ১৬টি নদীর উৎপত্তি হয়েছে। সেগুলো থেকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক খাল বা খাড়ি।
সরেজমিন তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বড়াল নদীতে পানি প্রবাহ না থাকায় শুকিয়ে যাচ্ছে নন্দকুজানদী, ভদ্রাবতী, সরস্বতী, ইছামতি, গুমানী, আত্রাই, ফুলঝোর, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, গোহালানদীসহ ১৬টি নদী, ছয়আনি বিল, বাইড়ার বিল, সাধুগাড়ী বিল, সাঁতৈল বিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাকড়ার বিল, কচুগাড়িবিল, চাতরার বিল, নিহলগাড়ি বিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়ি বিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়ি বিল, খৈগাড়ি বিল, বৃগরিলা বিল, দিগদাড়িয়া বিল, খুলুগাড়ি বিল, কচিয়ারবিল, কাশিয়ার বিল, ধলার বিল, বড়বিলা, বালোয়া বিল, আমদাকুরী বিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরী বিল, চিরল বিল, ডিকশী বিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, খলিশাগাড়ির বিলসহ ৩৯টি বিল। এ ছাড়া নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা- বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, দোবিলা খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাড়িসহ ২২টি খাড়ি। শুষ্ক মৌসুমে বেশির ভাগ নদী-বিল-খাড়ির শুকিয়ে যাওয়ায় নৌপথ কেন্দ্রিক ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। বহুলাংশে কমে গেছে মাছ, ঝিনুক, শামুক, কাঁকড়াসহ জলজ প্রাণীর বংশবিস্তার ও উৎপাদন।
১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখে নির্মাণ করা হয় তিন দরজা বিশিষ্ট স্লুইস গেট। পদ্মা নদী থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া বড়াল নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করা হয় ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়ি নামক স্থানে আরও একটি পাঁচ দরজা বিশিষ্ট স্লুইস গেট নির্মাণ করে। এই গেটটি নির্মাণের ফলে দক্ষিণ দিকের অংশে পানি থাকলেও উত্তর দিকের অংশে পানি চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগ নন্দকুজা অন্য ভাগ বড়াল। বড়ালের উৎসমুখে চারঘাটে স্লুইস গেট নির্মাণ করায় ভাটির বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় নদী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। বনপাড়ার ভাটিতে বড়াল নদীতে তৃতীয় ও চতুর্থ স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুড়া এবং চাটমোহরের দহপাড়ার কাছে। দহপাড়ার নিকটবর্তী স্লুইস গেটটির উভয় পাশে শুকিয়ে যায় শুষ্ক মৌসুমে। অনেকেই নদী দখল করে ঘরবাড়ি, দোকান-গুদাম উঠিয়েছে। নদীর মধ্যে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ করছে।
রাজশাহীর চারঘাট থেকে জন্ম নিয়ে বড়াল নদী নাটোরের গুরুদাসপুরের কাছে আত্রাই নদীতে মিশেছে। এই অংশকে আপার বড়াল বলা হয়। এই অংশের দৈর্ঘ্য ৮৪ কিলোমিটার। বড়াইগ্রামের আটঘড়ি থেকে বেড়িয়ে বনপাড়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, সাঁথিয়া হয়ে শাহাজাদপুরের বাঘাবাড়ী ঘারে ভাটিতে চড়ায় হুড়াসাগর নদের সাথে মিলিত হয়ে যমুনা নদীতে মিশেছে। এই অংশ লোয়ার বড়াল নামে পরিচিত। লোয়ার বড়ালের দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। বড়াল নদীর মোট অববাহিকা হচ্ছে এক হাজার ৫৪২ বর্গকিলোমিটার। আপার বড়ালের গড় প্রস্ত ৬০ মিটার, গড় গভীরতা পাঁচ মিটার। লোয়ার বড়ালে গড় প্রস্ত ১২০ মিটার, গভীরতা ৯ দশমিক ৯০ মিটার।
বড়াল অববাহিকার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আশির দশক পর্যন্ত বড়াল ছিল স্থানীয় যোগাযোগ ও বাণিজ্যের চালিকাশক্তি তেমনি ছিল সংস্কৃতি ও বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। বড় বড় পণ্যবাহী নৌকা, বার্জ, জাহাজ, কার্গোজাহাজে পণ্যসামগ্রী আনা-নেয়া হতো বড়াল নদী পথে। চলত বড় বড় লঞ্চ ও স্টিমার। এই অঞ্চলের শতকরা নব্বই ভাগ অধিবাসীই ছিল বড়াল নদীর ওপর নির্ভরশীল। চারঘাটে স্লুইস গেট নির্মাণ করার ফলে নদী সঙ্কুচিত হতে থাকে, পানি প্রবাহ হ্রাস পায়। এর ফলে পরবর্তীত হতে থাকে পরিবেশ ও বড়াল পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা। বড়াল অববাহিকার অর্থনীতি মূলত কৃষি, মৎস্য ও গবাদি পশুসম্পদ নির্ভর। ধান, চাল, মসুর, খেসারি, সরিষা, মাসকালাই, পাট প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য বড়াল অববাহিকার সুখ্যাতি ছিল। নৌপথে বড়াল পাড়ের ফসল যেত চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
১৯৬০ এর দশকে বড়ালে যখন পানির প্রবাহ ছিল স্বাভাবিক তখন শুষ্ক মৌসুমে নদী তীরের জমিতে নদীর পানি পাওয়ার পাম্প দ্বারা সেচ দেয়া হতো। নালা বা খালে পানির প্রবাহ ছিল। তাতে বিলের অভ্যন্তরের জমিতে সেচ দেয়া যেত। নদীতে কোজার নির্মাণ করার পর পানি না থাকায় সেচ হয়েছে শ্যালো বা ডিপ মেশিন নির্ভর। বড়াল নদী অববাহিকায় এখন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। নদী মরে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশাল চলনবিলে।