মনে পড়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা
মনে পড়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা - ছবি : সংগ্রহ
১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয় অর্জিত হয়েছিল। আমার জানা মতে, এত সুন্দর উৎসবমুখর এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে স্বচ্ছ নির্বাচন আর দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়নি। কিন্তু গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে গত ১০০ বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নির্বাচন বলে আমরা জানতে পারলাম। জানি না আমাদের প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে এ ধরনের নির্বাচন বা এ ধরনের নির্বাচনী শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান শুনতে পারতাম কি না।
তবে সদ্য সমাপ্ত এই সিটি নির্বাচন ১০০ বছরের শ্রেষ্ঠ নির্বাচন হয়েছে কি না তা ঢাকাবাসী বা ঢাকা সিটির ভোটাররা ভালোই মূল্যায়ন করতে পেরেছেন। কারণ এই অবাধ গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের যুগে জনসম্পৃক্ত যেকোনো কিছুর বিচার জনগণ খুব ভালোভাবেই সম্পন্ন করতে সক্ষম। কাজেই এখন শুধু নেতা-নেত্রীর কথায় বা বক্তৃতায় মানুষ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে না। তারা বরং পুরো ব্যাপারটি দেখতে পায় বা দেখতে চায় যেকোনো বিষয়ে ধারণা নিশ্চিত করার আগে। আমরা মানুষের সরব প্রকাশকে সীমিত করে দিতে পারি কিন্তু তাদের অনুভূতিকে বেধে রাখতে পারি না।
আজ আমাদের আছে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ, আছে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আদর্শ। কিন্তু নেই শুধু বঙ্গবন্ধু। তাতেই আজ আমরা তাঁর আদর্শকে হারিয়ে ফেলেছি। যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সারাটি জীবন সংগ্রাম করেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছ থেকে ভোটের অধিকার আদায় করতে তিনি যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, আমরা আজ তাঁর সেই আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছি জাতি হিসেবে।
মুজিব-পরবর্তী বাংলাদেশে অনেক নির্বাচন হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে সেনাশাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো অত্যন্ত খারাপ হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করেন এমন সরকারের অধীনেও নির্বাচন সন্দেহমূলক বা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে তা এই জাতি বারবার নীরবে লক্ষ করেছে। সেনাশাসনের বাইরে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং তা বিশ্বদরবারেও প্রশংসিত হয়েছে। সেই নির্বাচনগুলো হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সম্পন্ন ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন। এরপর কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, যেগুলোর একটিও পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে মেনে নিতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনের কথা বাদ দিলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েই ব্যাপক অগ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে বারবার। আর এবারের ঢাকা সিটি নির্বাচন কোনোক্রমেই এসব প্রশ্নের বাইরে নয়।
২ ফেব্রুয়ারির পত্র-পত্রিকা পাঠ করে ১ ফেব্রুয়ারির ঢাকা সিটি নির্বাচনের পুরো চিত্র দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হয়। দেশের প্রধান ইংরেজি দৈনিক হিসেবে পরিচিত ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকার সাংবাদিকরা দুই হাজার ৪৬৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ২০৭টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেন আর বহুল প্রচারিত ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকার ৬৬ জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী ৪২৭টি ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে সার্বিক খবরাদি তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ‘প্রথম আলো’ এবং ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকা ২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় বিভিন্ন শিরোনামের মাধ্যমে ভোটের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেছে।
প্রথম আলো- ‘নিয়ন্ত্রিত ভোটের নতুন রূপ’; ‘সঙ্ঘাত নেই, ভোট স্থগিত হয়নি। তবে গোপন ভোটকক্ষে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের তৎপরতা’; ‘শত বছরেও এ রকম সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি’ ‘ভোটারদের উপস্থিতি খুবই নৈরাশ্যজনক’; ‘এবারো মাঠ থেকে দূরে বিএনপি’; ‘আগের রাতে ভোট না পড়া ইভিএমের দুই অর্জনের একটি’; ‘কোথাও বাড়াবাড়ি, কোথাও দর্শক, কোথাও সহযোগী (পুলিশের ভূমিকা’; দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের মারধর ও হেনস্তা’; ‘ভোট কক্ষে অনিয়ম, কর্মকর্তা নিরূপায়’; ‘বুথে ঢুকে পড়েন দলীয় কর্মী’; ‘ক্ষমতাসীনদের মহড়া মারপিট’; ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের পক্ষে ছাত্রলীগের ভূমিকা’; ‘প্রবেশমুখে সরগরম, ভেতরে নীরব’; ‘ককটেল বিস্ফোরণ, জোর করে নৌকায় ভোট’; ‘২০ কেন্দ্র ঘুরে চারটিতে এজেন্ট পেলেন ইশরাক’; ‘একপক্ষের সবাই আছে অন্যপক্ষ শূন্য’, ‘ভোটার তুমি আগ্রহ হারাইয়াছ?’ ইত্যাদি।
এবার ডেইলি স্টার পত্রিকার কিছু শিরোনাম উল্লেখ করা হচ্ছে- Voters keep off- Low turnout, Show of strength by Al men, poor presence of BNP polling agents mark Dhaka city polls”; “Ghosts around machines?; Agents must be strong (CEC)Õ; Unwanted help Ruling party men in the name of assistance breach privacy in booths, even cast ballots on behalf of voters; Polling centres at DU- BCL men follow occupies, control instructions; The polling see turnout below expectation, thin presence of young voters; Voting in an intimidated and monopolised space; ÔLow voter turnout was inevitable; No confidence vote for EC ইত্যাদি।
উপরোল্লিখিত পত্রিকাগুলোর শিরোনাম পড়লেই ভোটের সার্বিক চিত্র বোঝা যায়।
এবার সম্পূর্ণ এক নতুন আঙ্গিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট হয়েছে। কিন্তু এই ভোটে অত্যন্ত স্মার্ট কৌশল ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ জয়লাভে সমর্থ হয়েছে। মূলত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশলের কাছেই পরাজিত হয়েছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ সম্ভবত সম্প্রতি ইভিএমের মাধ্যমে হয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের কৌশল নির্ধারণ করেছে। আসলে ইভিএম বা ব্যালট পেপার কিছুই নয়। বড় কথা হলো- কৌশল। আমরা ২০০৮ সালের পর বিভিন্ন নির্বাচনী কৌশলের সাথে পরিচিত হয়েছি। এর পরের নির্বাচনে হয়তো আরো নতুন কৌশল দেখা যাবে।
৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার আগ থেকে ধরপাকড়ের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাকর্মীদের ও সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের এলাকাছাড়া করা এবং আগের রাতে ভোটদান সম্পাদন করাই ছিল মূল কৌশল। কিন্তু এবার সিটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের যথেষ্ট স্পেস দিয়ে পূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাখা এবং নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র দখলে রেখে ইভিএমে ভোটদানে সহযোগিতা করা বা নিজেদের প্রতীকে ভোট দিতে প্রভাবিত বা বাধ্য করা ছিল মূল কৌশল। প্রতিটি কেন্দ্রের সামনে নির্দিষ্ট প্রতীকের সমর্থকদের জটলা সৃষ্টি করে কেন্দ্রের ভেতরে কড়া নিয়ন্ত্রণ রাখার অজস্র ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এর কোনো পাল্টা কৌশল পরাজিত প্রার্থীরা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর কোনো অজানা কারণে বা অশরীরী ইশারায় বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে আসেননি বা এলেও চলে গিয়েছিলেন। নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যক্তিদেরও তেমন তৎপর দেখা যায়নি বলে জানা যায়। আর প্রিজাইডিং অফিসাররা হয়তো বা ছিলেন অসহায়।
একজন নির্বাচন কমিশনারের ভাষ্য মতে, ২৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা নয়। এখানেও অনেকের যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। দুপুরের আগে অনেক কেন্দ্রেই প্রথম ৪ ঘণ্টায় মাত্র ১০ শতাংশ ভোট পড়লেও ভুতুড়ে ভোট ছাড়া বেলা শেষে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট পড়তে পারে না বলেই অনেকেই ধারণা করছেন।
নির্বাচনের কয়েকদিন আগে এইচটি ইমাম অভিযোগ করলেন, বিএনপি সারা দেশে থেকে সন্ত্রাসীদের এনে জড়ো করছে সিটি নির্বাচনে ব্যবহার করার জন্য। বিএনপিও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করল। এই অভিযোগের মাঝে ঢাকা মহানগরী পুলিশ থেকে ঘোষণা করা হলো, ভোটার ছাড়া যাকেই নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরে পাওয়া যাবে তাকে গ্রেফতার করা হবে। এর প্রভাবেই নির্বাচন কেন্দ্রগুলো শান্ত হয়ে পড়ল। শুধু একটি পক্ষের সমর্থকরা বীরদর্পে পুরো কেন্দ্র দখলে রাখল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে। আর গ্রেফতার এড়ানোর ভয়ে বিরোধী প্রার্থীদের সমর্থকরা গা ঢাকা দিলো। এভাবে এবারের ঢাকা সিটিতে এক অভূতপূর্ব শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।
কিন্তু একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। নির্বাচন কমিশন তথা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। সর্বোপরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ছে। সবচেয়ে কষ্টকর হলো বঙ্গবন্ধুর গড়া দল, স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া সংগঠন, গণতন্ত্রের অগ্রপথিক এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী দলের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রশ্ন বা অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে।
তবে সদ্য সমাপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের শিক্ষা হলো আমাদের দেশে বোধহয় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রশ্নহীন হওয়া সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনী ‘স্টেক হোল্ডারদের’ নিরপেক্ষ থাকা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনই হতে পারে প্রশ্নহীন যা আমরা বারবার দেখেছি। এমতাবস্থায় আমাদের দেশের কর্ণধাররা দেশের স্বার্থে ওই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনর্বহালের চিন্তা করতে পারেন।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং পিএইচডি গবেষক
Email: maksud2648@yahoo.com