এখন কী হবে সু চির

জি. মুনীর | Feb 09, 2020 05:21 pm
সু চি

সু চি - ছবি : সংগ্রহ

 

২৩ জানুয়ারি ২০২০। দিনটিকে বলা যায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনার দিন। ওইদিন বিশ্বে আইনের শাসন ও মানবতার মর্যাদা রক্ষায় জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এক ঐতিহাসিক অন্তর্বর্তী রায় ঘোষণা করেছে। রায়ে আইসিজে জানিয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সহিংসতা ও বৈষম্য নীতিতে মিয়ানমারের গণহত্যার উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আদালত সে বিবেচনা থেকেই ওই আদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রশ্নে চারটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন মিয়ানমার সরকারকে : ০১. গণহত্যা সনদ অনুযায়ী মিয়ানমারকে এর সীমানার মধ্যে হত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে; ০২. মিয়ানমারকে অবশ্যই তার সীমানার মধ্যে সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো অনিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট বা তাদের সমর্থনে যাতে গণহত্যা সংঘটন, গণহত্যার ষড়যন্ত্র বা অপ্রকাশ্যে গণহত্যার জন্য উসকানি বা গণহত্যার চেষ্টা করা বা গণহত্যায় সহযোগী হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে; ০৩. গণহত্যা সনদের বিধি ২ অনুযায়ী গণহত্যার অভিযোগের সাথে সম্পর্কিত সব সাক্ষ্যপ্রমাণ রক্ষা এবং তা ধ্বংসের চেষ্টা প্রতিরোধ করতে হবে এবং ০৪. এই আদেশ জারির দিন থেকে পরবর্তী চার মাসের মধ্যে আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আদালতকে জানাতে হবে। এরপর থেকে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস পর পর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে।

বলা দরকার, এই রায় আইসিজের একটি অন্তর্বর্তী আদেশ। চূড়ান্ত রায় এখনো ঘোষণার অপেক্ষায়। তবে নেদারল্যান্ডের হেগে শান্তি প্রাসাদে আদালতের আনুষ্ঠানিক এ অধিবেশনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাবিরোধী গণহত্যার বিষয়টি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। একই সাথে উচ্চারিত হয়েছে মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত রোহিঙ্গাবিরোধী জাতিগত নির্র্যাতন-নিপীড়ন ও বৈষ্যমের বিষয়টিও। ১৯৪৯ সালে গৃহীত গণহত্যা সনদে মিয়ানমার ও গাম্বিয়া স্বাক্ষরদাতা দেশ। এই সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণে মিয়ানমারকে বাধ্য করার লক্ষ্যেই গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক এ আদালতের শরণাপন্ন হয়। গাম্বিয়া অবশ্যই এ জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। যেখানে দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর জাতি নিধনের লক্ষ্যে রাষ্ট্র পরিচালত নির্যাতন-নিপীড়ন প্রশ্নে বিশ্বমোড়লরা শুধু নিষ্ফল বাণী বিতরণ ছাড়া কার্যকর আর কিছুই করেনি, সেখানে গাম্বিয়ার মতো ছোট একটি দেশের মানবিক পদক্ষেপে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান টানা ও চলমান একটি গণহত্যা প্রক্রিয়া বন্ধের লক্ষ্যে বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দ্বারস্থ হওয়া গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু এই অন্তর্বর্তী আদেশকে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত দীর্ঘ নিপীড়ন ও বঞ্চনার অবসানের পথে এটি একটি ছোট্ট পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, এই আদেশ এক দিনে রোহিঙ্গাদের জীবন বদলে দেবে না। তবে এটি একটি প্রক্রিয়ার সূচনা। আমরা আশা করি, এর মাধ্যমে একদিন রোহিঙ্গারা নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে রাখাইনে ফিরে যাবে। মিয়ানমার এবার অন্তত আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে। কারণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে মিয়ানমার মানবাধিকার ও মানবতার মৌলিক দায়িত্ব পালনের দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না।’

এ দিকে মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি বলেছেন, তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর জন্য মিয়ানমারের বিচারের সুপারিশ করবেন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার বিচারের জন্য তিনি জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদে প্রতিবেদন দেয়ার সময় একটি নতুন অন্তর্বর্তী আন্তর্জাতিক আদালত ===গঠনের প্রস্তাব দেবেন।
অপর দিকে কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের আন্তর্জাতিক সঙ্ঘাতবিষয়ক অধ্যাপক জন ফ্রেডরিক প্যাকার জাতিসঙ্ঘের সাবেক মানবাধিকার কর্মকর্তা ও মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘের প্রথম বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ারের সহকারী হিসেবে ১৯৯২ সাল থেকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। তিনি বলেছেন, আইসিজের এই রায় মিয়ানমারের জন্য বাধ্যতামূলক। তার মতে, এটি এখন জাতিসঙ্ঘের গণহত্যা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদের আওতায় নিরাপত্তা পরিষদে আপনাআপনি চলে যাবে। আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে তাই মিয়ানমারকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। এই অন্তর্বর্তী আদেশের বিষয়ে আপিলের কোনো সুযোগ নেই। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা মিয়ানমার এই আদেশ অগ্রাহ্য করতে পারে।

তাদের এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। মিয়ানমার সরকার আইসিজের এই আদেশ ইতোমধ্যেই প্রত্যাখ্যান করেছে। মিয়ানমার বলেছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটিত হয়নি। যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু স্বাধীন মানবাধিকার পর্যবেক্ষক ও রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, সেখানে গণহত্যা ঘটেছে। গাম্বিয়া সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে।

কিন্তু আইসিজের সাম্প্রতিক আদেশের কয়েক দিন পরও থামেনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন। সর্বশেষ ঘটনায় শেলের আঘাতে দু’জন রোহিঙ্গা মহিলা ও আরো সাতজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে রাখাইন প্রদেশে। একজন ঘটনাস্থলেই ও অপরজন হাসপাতালে নেয়ার পর নিহত হন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এর জন্য দায়ী করেছে বিদ্রোহী রাখাইন আর্মিকে। বলা হচ্ছে, রাখাইন বৌদ্ধরা সেখানে স্বায়ত্তশাসনের জন্য সশস্ত্র লড়াই করছে। কিন্তু রাখাইন আর্মি এ ঘটনার দায় স্বীকার করেনি। তারা বলেছে, এ সময় সেনাবাহিনীর সাথে তাদের কোনো লড়াই হয়নি। অপর দিকে রাখাইনে গত জানুয়ারির প্রথম দিকে বোমার আঘাতে নিহত হয়েছে চার শিশু ও আরো পাঁচজন। মিয়ানমারের গণমাধ্যমের খবর মতে, মিয়ানার রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা গ্রামের ওপর গোলা নিক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে- এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি, মে ও ডিসেম্বরে। তা ছাড়া অব্যাহত রয়েছে রোহিঙ্গা হত্যা। বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে তাদের খাদ্য ও মানবিক সহায়তায়। সেই সাথে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী অস্পষ্ট নিবর্তনমূলক আইনে বেসামরিক লোকদের আটক অব্যাহত রেখেছে। আইসিজের এই আদেশের পর মিয়ানমার রোহিঙ্গা নির্যাতন যেন আরো জোরদার করে তুলছে। তা ছাড়া মিয়ানমার আদালতের এই রায় প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ধরনের প্রত্যাখ্যান মিয়ানমারের এক স্বাভাবিক চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘের নিয়োজিত একটি স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে বলে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের শত শত হাজার মানুষ এখনো মিয়ানমারে বড় ধরনের গণহত্যার হুমকির মধ্যে রয়ে গেছে। আর সরকার এদের পরিচয় সত্তা দেশ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।

তখনো মিয়ানমার এই রিপোর্টের বিষয়বস্তু প্রত্যাখ্যান করে বলে, এই মিশন কখনোই মিয়ানমারের স্বীকৃত নয়। এ কথা বলে তারা তাদের নিজস্ব তদন্ত শুরু করে। এভাবে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, নিপীড়নের কথা যতই অস্বীকার করুক, বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা এখন শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে সাড়ে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় ২০১৭ সালের আগস্টে শুরু হওয়া মিয়ানমার বহিনীর গণহত্যা অভিযান শুরুর পর। আর বাকিরা বাংলাদেশে আসে সত্তরের দশকে। সাধারণ নির্যাতনে এরা নিজের দেশ ও ঘরবাড়ি ফেলে এভাবে বিদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে, এমনটি কেউ বিশ্বাস করে না। গণহত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য এদের বাড়িঘর ছেড়ে পালানোর বিষয়টি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এদের নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদা দিয়ে মিয়ানমারে তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে নেয়ার দু’টি সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ব্যর্থ হয় মিয়ানমারের পিছু টানের কারণে : একটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরে এবং অপরটি ২০১৯ সালের আগস্টে। মিয়ানমারে এখনো ভীতিকর পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকায় এরা নিশ্চিত নিরাপত্তা ছাড়া বাড়িঘরে ফিরে যেতে চাইছে না। তাদের দাবি : সরকারিভাবে স্বীকার করে নিতে হবে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা এথনিক গ্রুপ; ফিরিয়ে দিতে হবে পূর্ণ নাগরিকত্ব; বহাল করতে হবে রোহিঙ্গা সমাজের অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা এবং রাখাইন রাজ্যে তাদের দিতে হবে চাকরির সুবিধা। তারা এমন ব্যবস্থা চান, যাতে এটাই হয় তাদের শরণার্থী হওয়ার শেষ ঘটনা। তারা পরিপূর্ণ অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে চান। আইসিজের রায়ের মূল কথাও কিন্তু এগুলোই। কারণ এগুলো ছাড়া রোহিঙ্গারা নিজ দেশে কখনোই মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে না। বরং বারবার থেকে থেকে এরা হবে নির্যাতনের শিকার।

বাংলাদেশকে আইসিজের রায় উত্তর-পরিবেশে অবশ্যই সাধারণভাবে সব দেশের সাথে এবং বিশেষ করে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র চীন, জাপান, ভারত ও রাশিয়ার সাথে এ ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা সমধিক জোরদার করতে হবে। মনে রাখতে হবে মিয়ানমারের সাথে এর আগে নেয়া দ্বিপক্ষীয় কোনো ব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। তা সম্ভব হলে এই রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের ঘাড়ে ঝুলে থাকত না। এই উপলব্ধি নিয়েই এখন বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে আইসিজের রায়-উত্তর পরিবেশে বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদার করে তোলার একটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু আন্তর্জাতিক আদালতের ওপর এই সমস্যা সমাধানের ভার ছেড়ে রাখলে চলবে না।

এদিকে, উল্লিখিত রায়ের পর রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে মিয়ানমার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার অন্তর্বর্তী রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে গত ২৮ জানুয়ারি এই তদন্ত শুরু হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বিশ্বে প্রথমবারের মতো জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিকÑ এই দুই আদালতে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার বিচারের আইনিপ্রক্রিয়া শুরু করেছে। আইসিজেতে অভিযুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে বিচার হবে মিয়ানমারের। আর আইসিসিতে বিচার হবে মিয়ানমারের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের।

আইসিজে ও আইসিসির পাশাপাশি জাতিসঙ্ঘের গঠিত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্তের প্রক্রিয়া (আইআইএমএম) তাদের কাজ শুরু করেছে। এর একটি প্রতিনিধিদল গত নভেম্বরের শেষ দিকে ঢাকা ও কক্সবাজার সফরের মধ্য দিয়ে এ কাজ শুরু করে। মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আদালতে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করবে আইআইএমএম। এসব আইনি উদ্যোগের ফলে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে আন্তর্জাতিক পরিসরে মিয়ানমারের ওপর আরো চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমনি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য এ ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার জন্য এটিই মোক্ষম সময়।
অপর দিকে গোটা বিশ্বের এখন উচিত আইসিজের অবস্থান ধারণ করে মিয়ানমারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে দীর্ঘ দিন ধরে চলা নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও নিপীড়নের মূল কারণ আইসিজের সাম্প্রতিক আদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সেসব কারণও দূর করতে হবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর কার্যত নির্যাতন ও নিপীড়নের পর্বটি শুরু হয় ১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার পর। তাদের নাগরিকত্ব ও যাবতীয় মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে এদের পরিণত করা হয় একটি রাষ্ট্রহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে। জাতিসঙ্ঘের ভাষায় এরা এখন বিশ্বের ‘মোস্ট পাসিকিউডেট পিপল’। সে কারণেই এখন আন্তর্জাতিক মহলের উচিত আইসিজের সাম্প্রতিক আদেশ মানতে এবং তাদের নাগরিকত্বসহ যাবতীয় নাগরিক অধিকার পুনর্বহাল করতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আইসিজে জতিসঙ্ঘের মূলধারার একটি আস্থাশীল প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু গণমাধ্যম এখনো এই আদালতের অবস্থান তেমন আমলে নিচ্ছে না। এই অবস্থান নিয়ে লেখালেখি প্রকাশ করতে এসব গণমাধ্যম আগ্রহী নয় বলেই মনে হয়। বিষয়টি দুঃখজনক।

এখন যেহেতু আইসিজের এই রায় গণহত্যা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদের আওতায় আপনাআপনি নিরাপত্তা পরিষদে চলে যাবে, তাই নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছে বাংলাদেশের জোরালো কূটনৈতিক আবেদন পৌঁছাতে হবে, যাতে নিরাপত্তা পরিষদে কাছ থেকে আইসিজের এই আদেশের প্রতি সমর্থন আদায় করা যায়। এসব দেশের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের সব দাবির প্রতি সমর্থন আদায় করা পুরোপুরি সম্ভব না হলেও, কমপক্ষে যাতে তাদের নাগরিকত্ব অধিকারটি নিশ্চিত করা যায়, সে ব্যাপারে জোর দিতে হবে। মনে রাখত হবে, নাগরিকত্ব হারানোটাই তাদের যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ। আর রোহিঙ্গাদের এই অধিকার আদায় করতে বিশ্বসমাজকে গাম্বিয়ার চেতনা ধারণ করেই এগিয়ে যেতে হবে। সন্দেহ নেই গাম্বিয়া বিষয়টি আইসিজেতে নিয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের প্রতি অমানবিক আচরণে সহমর্মী হয়েই। যেমনটি সচেতন সহমর্মিতা দেখিয়েছে গাম্বিয়া সরকার, আসিয়ানভুক্ত অন্য ৯টি দেশের সরকারকেও একই ধরনের সহমর্মিতা দেখাতে হবে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে। উল্লেখ্য, মিয়ানমারসহ ১০টি দেশ এই আসিয়ানের সদস্য। এই দেশগুলো হচ্ছে : ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাউস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। মিয়ানমার ছাড়া আসিয়ানভুক্ত অন্য ৯টি দেশ আইসিজের রায়ের ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিলে মিয়ানমারও তখন বাধ্য হবে এসব দেশের সাথে থাকতে। এসব দেশ তাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্ষমতার রাজনীতি, ভূ-রাজনৈতিক চাপ একপাশে সরিয়ে রেখে যদি একমাত্র নির্য়াতিত-নিপীড়িত, রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে, তবে মিয়ানমারও বাধ্য হবে সবার সাথে থাকতে। তাই আসিয়ানেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এখানে। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক তৎপরতা হতে হবে জোরালোভাবে।
শুধু আসিয়ানকেই আইসিজের রায়ের প্রতি সাড়া দিতে হবে, তা কিন্তু নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ এ সরকারের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-আর্থিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে মিয়ানমার সরকারের সাথে। চীন সরকার যদি এসব বিবেচনার বাইরে গিয়ে অভিন্ন মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে, তবে রোহিঙ্গাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। মিয়ানমারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে আমরা যে কেউ একই প্রশ্ন তুলত পারি এ ক্ষেত্রে ভারতের ও জাপানের ভূমিকার প্রশ্নেও। তাই এই দেশ দু’টির কাছেও বিবেকী আচরণ প্রত্যাশিত।

আরেকটি বিষয় সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের বিদ্যমান আচরণে নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে, যদি দেশটি সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের সরকারের অবলম্বিত নীতি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করে। তারাও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে বাধ্য করতে পারে আইসিজের রায়ের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিতে। এটি ঘটবে এমন সম্ভাবনা কম। কারণ মিয়ানমারের বেশির ভাগ মানুষ বার্মান-বুদ্দিষ্ট সত্তায় বিশ্বাসী। এরা মিয়ানমারে নন-বার্মানদের কোনো স্থান দিতে নারাজ। আর এই নীতিই অবলম্বন করেই মিয়ানমারের অভিজাত গোষ্ঠীসহ দেশটির সামরিক ব্যক্তিরা। তবে বাইরের চাপে দেশটির জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আইসিজের আদেশের সাথে সহমত প্রকাশ করতে পারে। বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে আইসিজের রায়-উত্তর পেিবশে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আসিয়ান, পরাশক্তিগুলো, জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সমর্থন ও বিশ্বজনমত সৃষ্টি- যা মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গা নাগরিকত্বসহ অন্যান্য অধিকার আদায় করার পথকে সুগম করতে পারে। বাংলাদেশকে এসব বিবেচনায় রেখেই আগামী দিনের পথ চলতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও গ্রন্থপ্রণেতা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us