কবির বিদ্রোহ
ফয়েজ আহমদ ফয়েজ - ছবি : সংগ্রহ
বিদ্রোহের অপবাদ যদি আরোপিত না হতো, তাহলে সম্ভবত তিনি অনেক বড় কবি হতে পারতেন না। তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, বরং সাংবাদিকও ছিলেন। আর বিদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারের মূল কারণ তার কবিতা নয়, সাংবাদিকতা। তার বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপকারীরা বদনাম ও অপমান ছাড়া আর কিছুই পায়নি, অথচ কবির নাম আজো অমর। আজো ওই কবির একটি কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে। কেননা এ কবিতা জালিম শাসকদের মাথার ওপর বজ্রপাত হয়ে গর্জন করছে। ওই কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবনের জন্য সে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরি, যার প্রেক্ষাপটে এ কবিতা জন্মগ্রহণ করেছে।
আপনারা বুঝে গেছেন, এ কবি হচ্ছেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। তার একটি কবিতাকে ভারতের উগ্রপন্থী হিন্দুরা ‘হিন্দুবিরোধী’ বলে অভিহিত করছে। ফয়েজ প্রগতিশীল দর্শনের মানুষ ছিলেন। কিন্তু হিটলারের বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অভিলাষের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন। ‘পাকিস্তান টাইমস’ নামের ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক হলেন। তিনি তার পত্রিকায় কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানান এবং ৩ জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে হাফিজ জলন্ধরি, আবদুর রহমান চুগতাই, ড. এমডি তাসিরসহ সাহিত্যিকদের এক যৌথ বিবৃতি তার পত্রিকায় প্রকাশ করেন। সেখানে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণের পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারেরও সমালোচনা করা হয়েছিল, যারা কাশ্মিরকে ডোগরা শাসকদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও পুলিশের ইংরেজ অফিসাররা ফয়েজকে অপছন্দ করতেন। অথচ তার স্ত্রী আলিসও ইংরেজ ছিলেন, যিনি ইসলাম গ্রহণ করে শ্রীনগরে ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে বিয়ে করেছিলেন। আলিস ও ফয়েজের বিয়ে পড়িয়েছিলেন শেখ আবদুল্লাহ। ফয়েজ পাকিস্তান টাইমসে এমন অসংখ্য সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছেন, যা পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন দফতরে নিয়োজিত ইংরেজ অফিসারদের সমালোচনায় ভরপুর ছিল। সেনাবাহিনীর এমন কিছু অফিসারের সাথেও তার বন্ধুত্ব ছিল, যারা কাশ্মির রণাঙ্গনে ১৯৪৮ সালে বীরত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারা মনে করেন, পাকিস্তানি বাহিনীতে রয়ে যাওয়া ইংরেজ অফিসাররা ষড়যন্ত্র করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে অস্ত্র সমর্পণে প্রস্তুত করেন। নতুবা শ্রীনগরকে স্বাধীন করা কঠিন ছিল না। ওই অফিসারদের মধ্যে মেজর জেনারেল আকবর খানও শামিল ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১৯৫১ সালে এ অপবাদ আরোপ করা হয়েছিল, তিনি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে হামলা করতে চাচ্ছেন। তাকে ‘রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা’য় গ্রেফতার করা হয় এবং তার সাথে গ্রেফতারকৃতদের মাঝে ফয়েজও শামিল ছিলেন। মামলার শুনানির জন্য একটি বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। ওই আদালতে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ তার বক্তব্যে বলেন, তিনি পাঞ্জাবের ইংরেজ ডিআইজি (সিআইডি) জেনকিন্সের গোপন তৎপরতা সম্পর্কে একটি কঠিন সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। আরেক ডিআইজি কুরবান আলী খান শ্রমিক নেতা মির্জা ইবরাহিমকে হাতকড়া লাগালে তার বিরুদ্ধেও সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। এ কারণে পুলিশ তাকে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে। মেজর জেনারেল আকবর খান, মেজর জেনারেল নজির খান, ব্রিগেডিয়ার সাদেক খান, ব্রিগেডিয়ার লতিফ খান, কর্নেল নিয়াজ মুহাম্মাদ আরবাব, কর্নেল জিয়াউদ্দিন, এয়ার কমোডর মুহাম্মদ খান জানজুয়া, মেজর মুহাম্মদ ইসহাক, ক্যাপ্টেন জাফরুল্লাহ পুশনি, মুহাম্মদ হুসাইন আতা, সাজ্জাদ জহির, ক্যাপ্টেন খিজির হায়াত ও কর্নেল মির্জা হাসান খানের সাথে ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে হায়দরাবাদ জেলে রাখা হলো। ওই জেলে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলাকে ‘প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র’ অভিহিত করে বলেছেনÑ ফিকরে দিলদারিয়ে গুলযার কারুঁ ইয়া না কারুঁ/যিকরে মুরগানে গেরেফতার কারুঁ ইয়া না কারুঁ/কিসসায়ে সাযেশে আগইয়ার কাহুঁ ইয়া না কাহুঁ/শিকওয়াহে ইয়ারে তারহদার কারুঁ ইয়া না কারুঁÑ পুষ্পোদ্যানের প্রশান্তি কল্পনা করব, নাকি করব না/বন্দী পাখির কথা বলব, নাকি বলব না/প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের কাহিনী বলব, নাকি বলব না/ পরমবন্ধুর নামে অনুযোগ করব, নাকি করব না।’
ওই জেলখানায় বসে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ এটাও লিখেছেন- চেশমে নাম, জানে শুরিদা কাফি নাহিঁ/তোহমাতে ইশক পুশিদা কাফি নাহিঁ/আজ বাযার মেঁ পা বেজাওলাঁ চালো/ দাসতে ইফশাঁ চালো, মাস্তো রাকসাঁ চালো- ভেজা চোখ, অস্থির প্রাণ যথেষ্ট নয়/গোপন প্রেমের অপবাদ যথেষ্ট নয়/আজ বাজারে চঞ্চল পায়ে চলো/হাত নাচিয়ে চলো, মত্ততা ও নৃত্যতালে চলো।’
ফয়েজের কারাগারে সঙ্গী কর্নেল মির্জা হাসান খান ফয়েজের কাব্যচর্চা ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছেন এবং এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা ফয়েজের নিকৃষ্ট বিরোধীদের মুখ থেকেও বের হবে না। কর্নেল সাহেব নিজেই নিজেকে গিলগিট বালচিস্তানের বিজয়ী ভাবতেন। তিনি ফয়েজের গ্রহণযোগ্যতাকে তার নিজের প্রতি অবিচার মনে করতেন। অথচ ফয়েজের স্থান ও তার স্থান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তা সত্ত্বেও তিনি আত্মজীবনীতে ফয়েজের ব্যাপারে যে কলমী অপরাধ করেছেন, তাতে বোঝা যায়, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ অন্যদের পাশাপাশি আপনজনদের তীরেও হয়েছেন ক্ষতবিক্ষত। অথচ তিনি এমন বন্ধুদের সমালোচনার জবাব কখনই দিতেন না, যারা তাকে মন্দ বলে নিজেদের মাথা উঁচু করার চেষ্টা করতেন। ফয়েজ আমাদের ইতিহাসের এমন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থন করে প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের নিশানায় পরিণত হয়েছেন। এরপর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনে সশরীরে অংশগ্রহণের জন্য তিনি বৈরুত পৌঁছেন এবং ইয়াসির আরাফাতের ইচ্ছায় ‘লোটাস’-এর সম্পাদক হয়ে যান। যে সময় ফয়েজ লোটাসে সম্পৃক্ত ছিলেন ওই সময় জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে বসেছিলেন। জিয়া ইসলামীকরণের নামে পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছিলেন। আর এটাই সেই সময়, যখন ফয়েজ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন- হাম দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে/লাযেম হ্যায় কে হাম ভি দেখেঙ্গে/ওহ দিন কে জিস কা ওয়াদা হ্যায়/জো লৌহে আযাল মেঁ লেখা হ্যায়/জাব যুলমো সেতাম কে কোহে গেরাঁ/রুয়ি কী তারাহ উড় জায়েঁঙ্গে/হাম মাহকুমুঁ কে পাওঁ তালে/ইয়ে ধারতি ধাড় ধাড় ধাড়কেগি/আওর আহলে হুকম কে সার উপার/জাব বিজলী কাড় কাড় কাড়কেগি/জাব আরযে খোদা কে কাবে সে/সাব বুত উঠওয়ায়ে জায়েঁঙ্গে/হাম আহলে সাফা মারদুদে হারাম/মাসনাদ পে ব্যাঠায়ে জায়েঁঙ্গে/সাব তাজ উছালে জায়েঁঙ্গে/সাব তাখত গেরায়ে জায়েঁঙ্গে/বাস নাম রাহেগা আল্লাহ কা/জো গায়েব ভি হ্যায় হাযের ভি/জো মানযার ভি হ্যায় নাযের ভি/উঠঠেগা ‘আনাল হাক্ব’ কা নারা/জো ম্যাঁয় ভি হুঁ আওর তোম ভি হো/আওর রাজ কারেগি খালকে খোদা/জো ম্যাঁয় ভি হুঁ আওর তোম ভি হো/লাযেম হ্যায় কে হাম ভি দেখেঙ্গেÑ আমরা দেখে নেবো, আমরা দেখে নেবো/অবশ্যই আমরাও দেখে নেবো/আমরা দেখব প্রতিশ্র“ত দিন/যা লেখা আছে চূড়ান্ত ভাগ্যলিপিতে/যেদিন অন্যায় অত্যাচারের সুদৃঢ় পাহাড়/তুলার মতো উড়ে যাবে/মজলুমের পায়ের তলায়/এ ধরিত্রী কাঁপবে থর থর করে/আর শাসকের মাথার ওপর/বজ্র যখন আঘাত হানবে কড় কড় করে/যখন কাবার রবের ভূপৃষ্ঠ থেকে/অপসৃত হবে মূর্তিগুলো/যখন দরবার থেকে বিতাড়িত বঞ্চিত নিরপরাধ আমাদেরকে/মসনদে বসানো হবে/ছিনিয়ে নেয়া হবে সকল রাজমুকুট/গুঁড়িয়ে দেয়া হবে সকল রাজসিংহাসন/থাকবে শুধু আল্লাহর নাম/যিনি গায়েবও, হাজিরও/ যিনি দৃশ্য নির্মাণ করেন এবং সবকিছু দেখেন/ধ্বনিত হবে ‘আমি সত্য’র স্লোগান/সে সত্য আমিও, সে সত্য তোমরাও/ আর রাজত্ব করবে জনতা/সে জনতা আমিও, সে জনতা তোমরাও/অবশ্যই আমরাও সেদিন দেখে নেবো।’
এ কবিতার শেষে জনতার রাজত্বের সুসংবাদ শুনিয়ে ফয়েজ অমর হয়ে আছেন। ১৯৮৬ সালে ইকবাল বানু এ কবিতা গাইলে এটা পাকিস্তানে বিক্ষোভ ও বিপ্লবের সঙ্গীতে রূপ নেয়। আজ ভারতে এ কবিতা যারা গেয়ে গেয়ে প্রতিবাদ করছেন, তাদের ‘গাদ্দার’ বলা হচ্ছে। অথচ সেখানে জেনারেল জিয়া নয়, মোদির সরকার বিদ্যমান। জিয়া সামরিক শাসক ছিলেন, মোদি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ফয়েজের একটি কবিতা উভয়ের পার্থক্য মিটিয়ে দিয়েছে। কবির কৃতিত্ব এখানেই।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২০ জানুয়ারি,
২০২০ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)