কতটা বিপর্যয়ে ভারতের সামরিক বাহিনী!

কতটা বিপর্যয়ে ভারতের সামরিক বাহিনী! - ছবি : সংগৃহীত
নরেন্দ্র মোদি সরকারের অধীনে সত্যিকার অর্থেই ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট সঙ্কুচিত হয়ে আসছে এবঙ এর ফলে পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ার দীর্ঘ দিনের উচ্চাভিলাষ ক্ষতির মুখে পড়ছে।
নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে ভারত তার প্রতিরক্ষঅ আধুনিকায়নের কর্মসূচি কাটছাঁট করেছে যাতে তার সশস্ত্র বাহিনীর বেতন প্রদান অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়।
গত ১ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা উল্লেখ করেছেন যে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারামন তার বাজেট বক্তৃতায় প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের (যা ১৯৯১ সাল থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিসেবে রয়েছে) কথা উল্লেখ করেননি।
কাগজকলমে গত বছরের চেয়ে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৫ ভাগ। তবে মুদ্রাস্ফীতির কথা বিবেচনা করা হলে প্রকৃত হিসেবে তা বাড়েনি। এর অর্থ হলো গত বছরের চেয়ে এবার প্রতিরক্ষা খাতে কম অর্থ প্রদান করা হবে।
মোদি সরকারের আমলে এমনটা অনেক দিন ধরেই চলছে। গত বছর ১৯৬২ সালের পর প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল সর্বনিম্ন। উল্লেখ্য, ওই বছর সীমান্ত যুদ্ধে চীনের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল ভারত।
মারাত্মক স্বল্পতা
প্রায় তিন বছর আগে ওই সময়ের ভাইস-চিফ অব আর্মি স্টাফ লে. জেনারেল সরথ চান্দ প্রতিরক্ষাবিষযক পার্লামেন্টারি স্থায়ী কমিটিকে বলেছিলেন যে বিদ্যমান অস্ত্র আধুনিকায়ন চুক্তিগুলোর অর্থ পরিশোধের কোনো টাকা ভারতীয় সেনাবাহিনী নেই, নতুন অস্ত্র কেনা তো দূরের কথা।
এই বাজেট ওই অবস্থাকে অব্যাহত রেখেছে এবং আধুনিকায়নের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে অর্থ আছে সামান্যই। বাজেটে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তার বেশির ভাগই ব্যয় হচ্ছে বেতন ও পেনশন প্রদানে। আর পেনশন খাতে ব্যয় প্রতিবছরই বাড়ছে। কারণ বেশি বেশি লোক অবসরে যাচ্ছে।
তিন বাহিনীর জন্যই এটি একটি খারাপ খবর।
ভারতীয় বিমান বাহিনীর জন্য ৪৫টি যুদ্ধবিমান স্কয়াড্রোন বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু তা হ্রাস পেয়ে এখন ২৮-এ নেমে এসেছে। সোভিয়েত আমলের পুরনো জঙ্গিবিমানগুলো আর চালানো যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যমান স্কয়াড্রোনও হ্রাস করা হচ্ছে। এর অর্থ হলো, তাদের যুদ্ধ করার বিমানের সংখ্যা কমছে।
বরাদ্দ করা ৪৫টি স্কয়াড্রোনের জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রয়োজন ৩০৬টি আধুনিক যুদ্ধবিমান। অবশ্য ভারত ২০১৬ সালের এপ্রিলে ৩৬টি রাফাল বিমানের জন্য চুক্তি করেছে। জৈশ-ই-মোহাম্মদের আস্তানায় হামলা চালানোর জন্য ভারতকে ৪০ বছরের পুরনো মিরেজ ২০০০ ব্যবহার করতে হয়েছে। আরো খারাব খবর হলো, ওই বিমান থেকে ক্রিস্টাল ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে নিক্ষেপ করা সম্ভব না হওয়ায় প্রধান টার্গেটস্থলই মিস হয়েছে।
প্রায় ১০ বছর আগে জরুরি ভিত্তিতে ১২৬টি জঙ্গিবিমান প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু এখনো তা হয়নি। আবার পরীক্ষা করার পর কোনো বিমান যদি নির্বাচন করা হয়, তা কেনার জন্য চুক্তিও হয়, কিন্তু তবুও তা হাতে পাওয়া যাবে না তা কেনার মতো অর্থ না থাকার কারণে।
ইউএস নেভাল কলেজের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্ক ও’ডনেল এশিয়া টাইমসকে ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে বলেন যে তিনি বিশ্বাস করেন যে বর্তমান বাজেট ভারতের বর্তমান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যতের নিরাপত্তা অংশীদারদের জন্য হতাশাজনক ঘটনা বিবেচিত হতে পারে।
তিনি বলেন, ব্যয়বহুল সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি কেনার জন্য এমন বাজেট প্রণয়ন করা হয়নি। অথচ ভারতীয় সামরিক বাহিনী আধুনিকায়ন করার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
অনির্ভরযোগ্য অংশীদার
প্রায় তিন দশক ধরে ভারত এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তি এবং পরিণামে বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার উচ্চাভিলাস পোষণ করছে। আর তা পূরণ করার জন্য প্রয়োজন আধনিক সামরিক বাহিনী। এ কারণেই মূলত সে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গাটছড়া বেঁধেছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্ব গভীরভাবে অবলোকনকারী ও’ডোনেল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে এমন স্বল্প বাজেট যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোকে ভুল বার্তা পাঠাবে।
কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সাম্প্রতিক সময়ে যেসব চুক্তি করেছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংগ্রহ করতে হবে। আর সেজন্য প্রয়োজন বিপুল বাজেট।
ভারতের নৌবাহিনীর অবস্থাও একই রকম। তাদের মাত্র একটি বিমানবাহী রণতরী আছে। দেশে তৈরী দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরটির কাজ থমকে আছে। দেশটির মাত্র ১০টির মতো সাবমেরিন আছে। এগুলো পুরনো সোভিয়েত আমলের ও জার্মান এইচডিডব্লিউ সাবমেরিন।
আর ছয়টি ফরাসি স্করপিন সাবমেরিনের মধ্যে মাত্র একটি পুরোপুরি কার্যকর রয়েছে। চীনা নৌবাহিনীর সাথে পাল্লা দিতে হলে ভারতের প্রয়োজন অন্তত ২০টি সাবমেরিন।
অন্যদিকে চীন ইতোমধ্যেই বিমানবাহী রণতরী বানিয়ে চলেছে। আর সবার জানা, তাদের সাবমেরিনগুলো বিশ্বে সবচেয়ে শব্দহীন। ফলে সেগুলো শনাক্ত করা অসম্ভব। এর অর্থ হলো কোয়াডের (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার গ্রুপিং) অংশ হিসেবে চীনকে মোকাবিলা করার ভারতীয় নৌবাহিনীর সক্ষমতা হবে খুবই সীমিত।
ভারতের কৌশলগত স্বার্থের ব্যপ্তি পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে পশ্চিমে হর্ন অব আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে ভারত মহাসাগরও রয়েছে। এখানেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ।
আবার ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনো ১৯৮০-এর দশকে তৈর আইএনএসএএস রাইফেল ব্যবহার করে। এগুলো এখন আর তেমন কেউ ব্যবহার করে না। ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনো সোভিয়েত আমলের টি-৭০ ও টি-৯০ ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে।
ভঅরতের প্রধান অস্ত্র হলো সুইডিশ বফোর্স আর্টিলারি কামান। এগুলো তৈরী হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকে। ভারতের যুদ্ধ করার সক্ষমতা যখন কমছে, তখন চীন তার বাহিনীকে দ্রুত আধুনিকায়ন করে ফেলছে। মনে রাখতে হবে, ভারত তার সীমান্তে চীন ও পাকিস্তানের মতো কঠিন প্রতিবেশীদের নিয়ে অবস্থান করছে।
একটি সফল যুদ্ধ করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কিন্তু স্বল্প বাজেট এই সক্ষমতায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক জনসভায় বলেছেন, ভারত থেকে আট দিনের মধ্যে পাকিস্তানকে যুদ্ধে হারিয়ে দিতে পারে।
আসলে এ ধরনের বাজেট নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারত যদি নিজেকে রক্ষা করতে পারে, সেটিই হবে ভাগ্যের ব্যাপার। বর্তমানে বিদেশে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করতে থাকা চীন তার সামরিক বাহিনীকে আরো উন্নত করে চলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে ও’ডনেলের মতো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোদি প্রশাসন যদি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মতো খাতে রাজনৈতিক শক্তি ব্যয় করা বন্ধ না করে, এবং এর বদলে অর্থনৈতিক সংস্কার ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে নজর না দেয়, তবে ভারতের অংশীদার ও বৈরি শক্তিশুলো মনে করতে শুরু করবে যে ভবিষ্যতে নিজের সামর্থ্য তুলে ধরার এটিই সর্বোচ্চ অবস্থা কিনা।
এশিয়া টাইমস