সৌদি আরবের ওপর কেন ক্ষিপ্ত হলেন ইমরান খান
প্রিন্স মোহাম্মদ ও ইমরান খান - ছবি : সংগৃহীত
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উভয় পর্যায়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে কাশ্মির যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বিষয় হয়ে থাকে, তবে সৌদি আরবের কার্যকর নেতৃত্বে থাকা ওআইসি স্পষ্টভাবেই পাকিস্তানের প্রত্যাশা পূরণ এবং সত্যিকার অর্থে এর বস্তুগত লক্ষ্য অর্জনে পাকিস্তানকে সহায়তা করতে ব্যর্থ হওয়ায় পাকিস্তানের প্রয়োজন তার কাশ্মির নীতি তুলে ধরার জন্য নতুন আঞ্চলিক পথের সন্ধান করা।
মালয়েশিয়ায় দু’দিনের সফরকালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন যে ভারতের কাশ্মিরকে দখল করা এবং এরপরপরই উপত্যকাটিকে কার্যত গণকারাগারে পরিণত করার বিরুদ্ধে ওআইসি প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সৌদি চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কুয়ালামপুর শীর্ষ সম্মেলনে তার অংশ না নেয়াটা ছিল ‘খারাপ সিদ্ধান্ত’ এবং চলতি বছরের পরবর্তী সম্মেলনে তিনি ওই ভুলের সংশোধন করতে চান।
এই ঘোষণা স্পষ্টভাবেই সৌদি আরবের প্রতি পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান অসন্তুষ্টির কথাই প্রকাশ করছে। উল্লেখ্য, কাশ্মির ইস্যুতে মুসলিমবিশ্বকে (আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কথা না হয় বাদই দেয়া হলো) সঙ্ঘবদ্ধ করতে সৌদিরা অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
এমনকি পাকিস্তান যখন কুয়ালামপুর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন সৌদিরা পাকিস্তানকে ‘আশ্বস্ত’ করেছিল যে কাশ্মির ইস্যুকে সত্যিকারভাবে বিশ্বপর্যায়ে তুলে ধরার জন্য কেবল কাশ্মির নিয়েই পাকিস্তানে একটি ওআইসি সম্মেলন আয়োজন করা হবে। কিন্তু তা আর হয়নি। মালয়েশিয়ায় ইমরান খানের বক্তব্যের মাধ্যমেই ওআইসির ওই সম্মেলন আয়োজনে অনীহার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। তবে বৈঠকটি না হওয়ার জন্য বৈঠক কেমন হবে তা নিয়ে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণেই নয়, সেইসাথে ওই ধরনের সম্মেলন আয়োজনের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের ওপর ভারতীয় চাপও সক্রিয় ছিল।
পাকিস্তান চাপ দিয়ে যাচ্ছিল, ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাশ্মিরবিষয়ক সম্মেলন আয়োজন করতে, অন্যদিকে সৌদি আরব বলছিল এ ব্যাপারে স্পিকারদের একটি সম্মেলন (যার কোনোই তাৎপর্য নেই) আয়োজন করতে। এ কারণে সৌদিদের ওপর পাকিস্তান ক্রমাগত হতাশ হয় মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও ইরানসহ মুসলিমবিশ্বে সৌদিবিরোধীদের সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী হয়। বলা নিস্প্রয়োজন, এই তিনটি দেশ নানা কারণে নানা কারণে কাশ্মিরকে ভারতের একীভূত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে।
মালয়েশিয়া সফরকালে সৌথ বিবৃতিতে ইমরান খান বলেন, উভয় দেশই জোর দিয়ে বলছে যে ফিলিস্তিন, জম্মু ও কাশ্মির ও রোহিঙ্গা ইস্যুগুলো জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ, জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব এবং সেইসাথে জাতিসঙ্ঘ সনদ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে হওয়া উচিত।
এসব ঘটনা ঘটছে সৌদিদের অনীহার কারণে। দেশটি ভারতের সাথে ক্রমবর্ধমান হারে জোরদার অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে, আর এই সম্পর্ক কাশ্মিরসহ সারা বিশ্বের মুসলমানদের কল্যাণের জন্য কার্যকর সংস্থা হিসেবে ওআইসির গড়ে ওঠার পথে বাধার সৃষ্টি করছে।
কুয়ালামপুর শীর্ষ সম্মেলনকে সৌদি আরব সুস্পষ্টভাবেই উম্মাহর ‘ঐক্যের’ প্রতি একটি হুমকি বিবেচনা করেছিল। তবে এটি ছিল সৌদি আধিপত্যে থাকা ওআইসির প্রতি চরম অসন্তুটির বহিঃপ্রকাশ। সৌদিরা মনে করেছিল যে কুয়ালামপুর শীর্ষ সম্মেলনটি মুসলিমবিশ্বের প্রতি সৌদি আরবের আধিপত্যের বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টি করছে। তবে ইতোমধ্যেই অসন্তুষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় তা ক্রমবর্ধমান হতে থাকলে সৌদির পক্ষে তা রুখে দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
সৌদি প্রাধান্যবিশিষ্ট ওআইসি এখন শূন্য হয়ে পড়ছে এবং এর নেতৃত্ব এখন তেলসম্পদে ধনী কর্তৃত্ববাদী আরব রাষ্ট্রগুলোর হাত থেকে তুরস্ক ও মালয়েশিয়াসহ অনরাব ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় ও উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে যাচ্ছে। এ নিয়ে ওআইসি ইতোমধ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর পাকিস্তান এই সুযোগটি গ্রহণ করে তার নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতিটি ফুটিয়ে তুলছে, সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে তার সম্পর্ক নানামুখী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
মালয়েশিয়া সফরকালে ইমরান খান যে বক্তৃতা করেছেন তাতে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠেছে। তিনি বলেন, ওআইসি থেকে কোনো কথাও শোনা যাচ্ছে না এবং সংস্থাটির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বিভাজন দেখঅ যাচ্ছে। আমরা কাশ্মির প্রশ্নে ওআইসির শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন পর্যন্ত করতে পারিনি।
তবে এটাও বলতে হবে সৌদিদের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক খুবই নাজুক অবস্থায় পৌঁছে গেলেও এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতের সাথে সৌদিদের সম্পর্ক জোরদার হতে থাকায় পাকিস্তানকে হিসাব করেই আগে বাড়তে হবে। ইরানের সাথে সম্পর্ক গড়ার সময়ও পাকিস্তানকে একই বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
ওআইসি স্থবির হয়ে পড়ায় কাশ্মির প্রশ্নে সেখানে আর পাকিস্তান তার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ কামনা করতে পারে না। ফলে যেখানে পাকিস্তান তার কাশ্মির ইস্যুটি যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারে, বিষয়টিকে আন্তর্জাতিককরণ করতে পারে, সেখানে যাওয়াই হবে ইতিবাচক পদক্ষেপ।