এই নির্বাচনের আড়ালের রূপ
এই নির্বাচনের আড়ালের রূপ - ছবি : সংগ্রহ
রাজধানীর ‘রাজন’দের নির্বাচন শেষ হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। দৃশ্যত ঢাকা সিটি নির্বাচন কিছুটা উত্তাপ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও অবশেষে নির্বাচনের দিন ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেছে। সরকারি দল তাদের ইতঃপূর্বেকার ‘নির্বাচনী ঐতিহ্য’ ধরে রাখবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। তার বিপরীতে বিরোধী দল ‘ভোট বিপ্লব’ ঘটানোর প্রত্যাশায় ছিল, তা ঘটেনি। সুতরাং ফলাফল ‘যথা পূর্বাং তথা পরং’। ভোটের দিনের নানা ধরনের নাটকীয়তা, ছল-চাতুরী, কারচুপি ও শক্তি প্রয়োগের মহড়া দেখে নাগরিক সাধারণের মন্তব্য ছিল ‘কী দরকার ছিল এ তামাশার? এরচেয়ে একতরফা ডিক্লারেশন বা নমিনেশন বা সিলেকশনই ভালো ছিল। এত ঢাকঢোল পেটানো, অর্থের অনর্থ, শ্রম ও শক্তির অপচয় প্রয়োজন ছিল না। তাতে মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কারণ থাকত না। রক্তারক্তির অবকাশ দূরীভূত হতো।’ বিরোধী দল রাজধানীর নির্বাচনকে ব্যাখ্যা করেছে আন্দোলনের অংশ হিসেবে। নির্বাচনে তাদের হেরে যাওয়াটা ছিল অবধারিত। নির্বাচনী ফলাফলকে সামনে রেখে যে নামকাওয়াস্তে আন্দোলনের মহড়া তারা দিলো, এক দিনের হরতালের মাধ্যমে এবং পরবর্তী সময়ে বিক্ষোভ-সমাবেশের মাধ্যমে তা পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে হয়নি। সে প্রস্তুতি থাকলে কর্মসূচির পর কর্মসূচি প্রদান করে জনগণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল দৃশ্যমান হতো। এ নির্বাচন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন ব্যবস্থার লাশে আরেকটি শেষ পেরেক। ভবিষ্যৎ যেকোনো নির্বাচনে জনগণকে দেখাবার জন্য হলেও বিরোধীদের অংশগ্রহণের আর কোনো যুক্তি ও সুযোগ থাকল না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত কিভাবে নির্বাচন ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রমাণ করছে ‘ছোট হয়ে আসছে আওয়ামী পৃথিবী’। ২০০৮ সালে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে গৃহীত নির্বাচনে ৮৭.৩ শতাংশ ভোট দেখানো হয়েছিল। ২০১৪ সালের ভোটার বিহীন নির্বাচনে তাদের প্রদর্শিত অংশগ্রহণ ছিল ৪০.৪ ভাগ। ২০১৮ সালের ‘নিশীথ রাতের নির্বাচনে’ ৮০ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়।
জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় স্থানীয় নির্বাচনে ভোটার প্রদর্শনের গরজ কিছুটা কম। কারণ ঐ ভোটে সরকার পরিবর্তন হয় না। তবুও নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান মোতাবেক, ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণের ৪৮ শতাংশ লোক ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। ঢাকা দক্ষিণে এর হিসাব ৩৭.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের উত্তাপহীন উপনির্বাচনে তাদের হিসাব মোতাবেক ৩১.৫ শতাংশ লোক অংশগ্রহণ করেছে। আর এবার সেখানে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ২৫.৩ শতাংশ। দক্ষিণ সিটিতে এবারে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ২৯ শতাংশ। এভাবে আরো অসংখ্য তথ্য প্রমাণ দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় যে, আসলে এবারের নির্বাচনটি ছিল গণঅনাস্থার। এতে অংশগ্রহণকারী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মন্তব্য করেছে, ‘নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের অনুপস্থিতি নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের হতাশার বহিঃপ্রকাশ’। বরাবরই সরকারি দলের অংশগ্রহণকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ‘জনগণের ভোট’ হিসেবে দেখানো হয়।
অবশ্য এই ক্ষেত্রে অসত্য তথ্যের সমাহারই বেশি থাকে। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের ভোটাররাই গেল কই’? পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, তাপস-আতিকের প্রচারণায় বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম থাকলেও ভোটের দিন তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। একজন সতর্ক নাগরিক প্রশ্ন করেছেন, তাহলে কি এবার ভাড়া করেও লোক জোটানো যায়নি? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, গত এক যুগ ধরে নির্বাচন ব্যবস্থার যে সর্বনাশ সাধন করেছে ক্ষমতাসীন দল, তার প্রতি গণ অনাগ্রহ ও অনাস্থার প্রমাণ তারা এবার হাতেনাতে পেয়ে গেলেন। তা ছাড়া অভিজ্ঞ মহল বরাবরই বলে আসছেন, নীরব জনগোষ্ঠীর গরিষ্ঠ অংশ বিএনপির সাথে রয়েছে। তারা পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ বা প্রতিশ্রুতি পাননি বলে ভোটকেন্দ্রে যাননি। একটি জনপ্রিয় দৈনিকের হিসাব-নিকাশ মোতাবেক, নবনির্বাচিত মেয়রদ্বয় ঢাকা শহরের মাত্র ১৫-১৭শতাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে মেয়র হতে যাচ্ছেন। এটি সত্যিই নির্বাচনের অপলাপ। নির্বাচনে ‘জিতে’ যে প্রতিনিধিত্বশীল অংশ ক্ষমতাসীন হয়, আসলে অনেক ক্ষেত্রে তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ।
ভোটের প্রতি কেন আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে- সে সম্পর্কে ‘নানা মুনির নানা মত’। নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পৃক্ত ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, শুরু থেকেই ঢাকাবাসীর বড় অংশেরই নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা ছিল। ইভিএম নিয়েও ছিল সন্দেহ-সংশয়। নাগরিকদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তো ছিলই। এসব কারণেই ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। তাছাড়া ইভিএম যারা পরিচালনা করছে তারাও আস্থার সঙ্কটে ছিল। এর আগে জাতীয় নির্বাচনও ছিল অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে ভোট জালিয়াতি হয়েছে। ইভিএমের প্রশিক্ষণের টাকা নিয়ে নয়-ছয় হয়েছে। তাই এই নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা না থাকাই স্বাভাবিক।’ ড. মজুমদার আরো বলেন, বিগত জাতীয় নির্বাচনে যা হয়েছে তা নিয়েও সংশয় ছিল অনেকেরই। আবার এমনটাও হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনে কোনো কেন্দ্রে সরকারি দলের প্রার্থীর শতভাগ ভোট বা তার চেয়েও বেশি পড়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলেরও প্রার্থীর শূন্য শতাংশ ভোটও পড়েছে।
এজন্য মানুষের মনে এ ভয় সৃষ্টি হয়েছে, তারা ভোট দিলেও যাকে দেয়া হবে তিনি পাবেন কি না। আবার নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিজের ভোট দিতে পারবেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। ভোটকে ঘিরে যেসব মহড়া আগেই দেখা গেছে, তাতে নিরাপত্তাহীনতা হওয়ারই কথা।’ ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স-ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলেছেন, এবার ভোটে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন কমিশনের ওপর তরুণ প্রজন্মের আস্থা নেই। এ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কিছুই খোঁজখবর রাখছে। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর গতানুগতিক ধারার প্রচার-প্রচারণাকে পছন্দ করেনি। প্রচারে কোনো নতুনত্ব ছিল না। এ কারণে তরুণ প্রজন্ম মনে করেছে, ভোট দেয়া না দেয়া সমান কথা।’ ভোট দিয়ে কী হবে? এমন প্রশ্নও তারা করে। তিনি আরো বলেছেন, ভোটার অনুপস্থিতির আরেকটা কারণ ছিল- বয়স্কদের না যাওয়া। তাদের যাতায়াতের জন্য কোনো যানবাহন ছিল না।
নির্বাচন কমিশন গাড়ি বন্ধ করে দিয়ে বড় ভুল করেছে। সিনিয়র সিটিজেনদের অনেকেই গাড়ি ছাড়া বের হতে পারেন না। তাই তারা ভোটকেন্দ্রে যায়নি। অনেকে রিকশায় উঠতে পারেন না। এর দায় অবশ্যই নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।’ নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও উপকরণ নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীও জনপ্রিয় কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ মনে করেন, ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার জন্য পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর। কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিতে বলা যায়, তারা সমানভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের আগে প্রচার-প্রচারণা ভালো হয়েছে। কয়েক দিন আগে প্রধান দুটি দলের নেতারা ভোট কেন্দ্রের পাহারা বসানোর বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের কথাবার্তায় আক্রমণাত্মক ভাব ছিল। এ কারণে সাধারণ মানুষের মনে ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল। এই ভীতি কাটানোর দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনের । কিন্তু তারা সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারেননি। সে কারণে মানুষ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হননি। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, ভোটের সংখ্যা কম হলেও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। এর বৈধতা থাকবে। তার জন্য যদি ৫ শতাংশও হয় তাতেও সমস্যা নেই। তিনি আরো বলেন, আমার ভোটের কোনো মূল্য নেই- এমন ভাবনা মনের মধ্যে আসন করে নিয়েছে। মানুষ ভোট দিতে যায়নি বা ভোট দিতে যায় না বা ভোট দিতে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই। এর ফলে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এটি খুব ক্ষতিকর। ভোট না দেয়ার মানে হচ্ছে, জনগণ ভোটকে গুরুত্ব দেয়নি। ভোট না দিয়ে জনগণ ‘প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স’ করেছে বলা যেতে পারে। আর এসবের ফলে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সরকারের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান। নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা না থাকায়, বিগত নির্বাচনগুলোতে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ না পাওয়ায় ভোটাররা ভোট দিতে উৎসাহী হচ্ছেন না। তিনি আরো বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ গণতন্ত্র ও ভোটের মালিক। তারা যদি ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহী না হন, জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন অংশগ্রহণ না করেন, তাহলে পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভোটের প্রতি মানুষের ক্রমাগত আগ্রহ ও আনন্দ হ্রাসের যে কারণটি গুরুত্বের সাথে বলেছেন, তা হচ্ছে- নিষ্পৃহ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। দু’টি কারণে এটি প্রবল হতে পারে। অতি উন্নত আমেরিকা ইউরোপে ভোগ আর সম্ভোগ ছাড়া মানুষ অন্যকিছু ভাবে না। সপ্তাহে পাঁচ দিন গাধার মতো খাটার পর আর দুই দিন ঘোড়ার মতো আনন্দ উপভোগ করে। এদের অন্যকিছু- রাজনীতি, সমাজনীতি ও ন্যায়নীতি নিয়ে ভাববার কোনো ইচ্ছে নেই। সেজন্য দেখা যায়, মার্কিন মুলুকে যদি একটা পাগলও লাফ দিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে তারও কিছু সমর্থক জুটে যায়। প্রায়ই দেখা যায়, এশিয়া, আফ্রিকার বংশোদ্ভূতরা ভালো করছেন। তার কারণ রাজনীতি সম্পর্কে শে^তকায়দের অনীহা। এখন আমাদের দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে! সুতরাং নির্বাচন বা ভোটাধিকার নিয়ে তাদের ভাববার অবকাশ খুবই কম। অনেকে নির্বাচনপূর্ব সংখ্যাধিক্য দেখে আফসোস করেছেন ভোটের দিনে তারা আসেনি কেন?
ভোগবাদী সমাজের লক্ষণ হলো- ‘খাও, দাও, ফুর্তি করো’। অন্যভাষায় ‘দুনিয়াকা মজা লে লাও, দুনিয়া তুমহারই হ্যায়।’ নির্বাচন উপলক্ষে আনন্দ-ফুর্তি হয়েছে। জনপ্রতি দৈনিক পাওনা জুটেছে অঢেল। সুতরাং নির্বাচনের দিন তারা অন্য ধরনের আনন্দ-ফুর্তিতে কাটিয়েছে। তারা শতভাগ নিশ্চিত ছিল যে, তারাই আনন্দ মিছিল করবে। সম্ভোগে ডুবে যাবে। আর এক শ্রেণীর লোক নির্বাচনকে ঝামেলা মনে করে। তারা নিতান্তই নিরুত্তাপ। কোনো কিছুতেই তাদের কিছু আসে যায় না। ঘরে বসে ঘুমানোই তাদের কাছে বেশি উপভোগ্য। কাকে ভোট দিয়ে কাকে নারাজ করবে, সেটাও এক বিরাট সমস্যা। সুতরাং রাজনীতি নিয়ে, ভোট নিয়ে মাথা না ঘামানোই বুদ্ধিমানের কাজ বলে তারা মনে করে। তারা বুদ্ধিমান হয়েছে এবং ‘ঠিক’ কাজটি করেছে।
আমরা যেহেতু উন্নয়নের মহাসড়কে আছি, তার আর একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে- বিজ্ঞান ও কারিগরি ব্যবস্থাপনা। আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশে অবস্থান করছি, তারও তো প্রমাণ থাকতে হবে। তাই ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার জোরে সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট নেয়া হয়। আগেই আশঙ্কা ছিল ক্ষমতাসীনদের নিশ্চিত পরাজয়ের এড়ানোর জন্য ইভিএম ছাড়া উপায় নেই। ভোট কারচুপির অনেক কারসাজি পরীক্ষিত হয়ে গেছে। সে কারণে ইভিএমএ ভর করতে হয়েছে ক্ষমতাসীন লীগকে। আগেই বলাবলি হচ্ছিল যে, ইভিএম ব্যবস্থায় আপনি যাকেই ভোট দেন না কেন ভোট চলে যাবে নির্দিষ্ট মার্কায়। ভোটের পরে মানুষের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষকদের মতামত প্রমাণ করেছে যে, মেশিন ‘ঠিক কাজটি’ করেছে। ভোটারযন্ত্রে আঙুলের ছাপ দেয়ার পর ব্যালট উন্মুক্ত হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকার দলীয় অবাঞ্ছিত লোকেরা ভোট দিয়ে দিয়েছেন। তারা ‘স্বেচ্ছাসেবক’ হয়ে নাগরিক সাধারণের অনেক উপকার করেছেন। যারা উঁকিঝুঁকির নামে নৌকার ভোট নিশ্চিত করেছেন, তাদের বাহবা দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। তিনি বলেছেন, ‘কেউ কেউ এই দু’একটি উঁকি দেয়াকে বড় বিষয় হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে’। বাহবা! বেশ। এর চেয়েও সরস কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। দুই সিটি নির্বাচনকে ‘১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘ভোট কারচুপির অদৃশ্য অভিযোগ এবং এসব অভিযোগের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নিশ্চয়তা ভোটারদের মধ্যে চূড়ান্ত হতাশা সৃষ্টি করে। এভাবে চলতে থাকলে একটি দেশ উদার গণতান্ত্রিক থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের দিকে চলে যায়।’
সাম্প্রতিক একটি জরিপে আওয়ামী লীগের প্রতি গরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আছে বলে দেখানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পুত্রের এই প্রত্যয় প্রমাণিত না হলেও এটা প্রমাণিত হয় যে, বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে। ফলাফল দেখে রসিকজন বলছেন, তার সব সম্ভাব্য কথা তো আর মিথ্যা হতে পারে না! তাই প্রকাশিত ভোটের হিসাবে দেখা যায়, সত্যি সত্যিই বিএনপি তিন ভাগের এক ভাগ ভোট পেয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার আর একটি মহৎ (!) কাজ করেছিল। সেটা হচ্ছে- ভোটের দিন ‘সরকারি হরতালের ব্যবস্থা’। দীর্ঘ এক যুগ ধরে তারা এই কাজটি কৃতিত্বের সাথে করে আসছেন। বিএনপি বা বিরোধী দলের কোনো ব্যাপক কর্মসূচি থাকলে সেদিন তারা রাস্তাঘাট থেকে যানবাহন প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করে দেন। মালিক সমিতি, ড্রাইভার সমিতিসহ পরিবহন সংশ্লিষ্ট সবাই একজোট হয়ে সরকারের ওই মহান দায়িত্বে এগিয়ে আসে। দৃশ্যত তাতে সরকারের দায় কোথায়? তবে এই জঙ্গির দেশে জনগণের নিরাপত্তার জন্য ঢাকা মহানগরীর প্রবেশ পথগুলোতে পুলিশ তল্লাশি করতেই পারে। সেটা তাদের রুটিন দায়িত্ব। গণমাধ্যমে এ ধরনের বক্তব্যই তারা দেন। নির্বাচনের দিনে যদি ভোটের সংখ্যা বেড়ে যায়, তাহলে ক্ষমতাসীনদের পরাজয়ের আশঙ্কাও বেড়ে যায়। সুতরাং আইনের নামে বেআইনি ব্যবস্থা! অনেকে মনে করেন, এরচেয়ে ঢের ভালো একদলীয় ব্যবস্থা। আইন অনুযায়ী তখন একক ব্যবস্থা নেবে সরকার। অন্যদল করার বা অন্যদলকে ভোট দেয়ার বৈধ ব্যবস্থা তখন থাকবে না। ভিন্নমত পোষণ করার জন্য সরকারকে নিপীড়নের নির্যাতনের পথও বেছে নিতে হবে না। ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, বিরাজনীতিকরণের দিকেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। এ অবস্থা থেকে সে অবস্থা অনেক ভালো!
নির্বাচন ব্যবস্থার যে ‘সর্বনাশ’ এই নির্বাচন কমিশন করেছে, কেউ কেউ মনে করেছিলেন তারা তাদের হৃত সম্মান উদ্ধারের জন্য শেষ আলোর ঝলক দেখাবেন। কিন্তু যাদের মেরুদণ্ড নেই তারা কি করে মেরুদণ্ড সোজা করবেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রতি অনীহা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এতবড় জালিয়াতির পরও তাদের সহাস্যমুখ এবং ‘বড়গলা’। তত্ত্বকথায় আছে, একটি অন্যায় বারবার করলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যায়ের অনুভূতিটাই হারিয়ে ফেলে। ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন যে, তারা চোরাপথে ক্ষমতায় যেতে চান না। কিন্তু যে বাস্তবতা জনগণ দেখল আসলে কী ঘটেছে। এটা করে সাময়িকভাবে নির্বাচনে জেতা যায়। হয়তো বা কিছুটা সময় ক্ষমতায়ও টিকে থাকা যায়। কিন্তু জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তা করতে হয়।
জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে যারাই ক্ষমতায় টিতে থাকার চেষ্টা করেছেন অবশেষে তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরিণতি তাদেরই বহন করতে হবে। তার কারণ নির্বাচনই একমাত্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা বদলের পথ। এটা বিলুপ্ত হয়ে গেলে মানুষ ন্যায়-অন্যায় না দেখে বিকল্প পথে হাঁটে। পথ যত শ্বাপদসঙ্কুল হোক না কেন, দেশের বিবেকবান মানুষদের এ অবস্থা থেকে যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে উত্তরণ ঘটাতে হবে। এ আকুতি গরিষ্ঠ নীরব জনগণের।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com