ট্রাম্পের পরিকল্পনা : বায়তুল মুকাদ্দাস, কাবুল আর কাশ্মির
বায়তুল মুকাদ্দাস - ছবি : সংগ্রহ
বোমা হামলা আমার কাছে নতুন কোনো বিষয় নয়। আমার বংশের লোকেরা এমন এক পাকিস্তানে বড় হয়েছে, যার শাসক ছিলেন জেনারেল জিয়াউল হক। তার সরকার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে আফগানিস্তানে যে জিহাদ শুরু করেছিল, তার জবাব দেয়া হতো পাকিস্তানের পথে-ঘাটে-বাজারে বোমা হামলার মাধ্যমে। আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম দিকের ঘটনা। ১৯৮৮ সালে লাহোর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একটি বোমা হামলা হয়। ক্রাইম রিপোর্টার ছুটিতে ছিলেন। সুতরাং ওই বোমা হামলার সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ল আমার ঘাড়ে। অকুস্থলে পৌঁছে মানুষের দেহের থেঁতলানো টুকরো বিদ্যুতের খুঁটিতে ঝুলতে দেখে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। কয়েক দিন পর্যন্ত কিছুই খেতে পারিনি।
পরবর্তী বছরগুলোতে পাকিস্তান ছাড়াও আফগানিস্তান, ইরাক, লেবানন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও চেচনিয়াতে এত বোমা হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ দেখি, এ ঘটনাগুলো জীবনের স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়ে যায়। ২০০৯ সালের ওই রাতের কথাও আমার মনে আছে, যে রাতে গাজার আল-কুদস হোটেলে ঘুমিয়ে ছিলাম, হঠাৎ এক বোমা হামলা হোটেলের দরজা-জানালা কাঁপিয়ে তোলে। আমি ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। পাশের কক্ষে থাকা আলজাজিরা টিভির ক্যামেরাম্যান বললেন, ইসরাইলি বিমানের বোমাবর্ষণে হোটেলের পেছনের অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। সুতরাং আমাদের এ স্থান ত্যাগ করা উচিত। শান্তভাবে জুতা পরে হোটেলের বিধ্বস্ত অংশে গিয়ে আহতদের সাহায্য করার কাজে নেমে পড়লাম। এটা দেখে আলজাজিরার ক্যামেরাম্যান বললেন, পাকিস্তানে ফিলিস্তিনের চেয়ে বেশি বোমা হামলা হয়। এ জন্য বোমা হামলা পাকিস্তানি সাংবাদিকদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলে না। আল্লাহর শুকরিয়া, আজকের পাকিস্তান ২০০৯-এর পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত। কিন্তু সকালের নানা সংবাদের ভিড়ে একটি সংবাদ আমাকে ২০০৯ সালে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। মনে হচ্ছিল, গাজার আল-কুদস হোটেলে নয়; আমি যেন বায়তুল মুকাদ্দাসে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমার চারপাশে চিৎকার-চেঁচামেচি চলছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা পেশ করেছেন, সেটি মূলত মধ্যপ্রাচ্য শুধু নয়, বরং গোটা বিশ্বকে এক নতুন যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার পরিকল্পনা। ট্রাম্পের এ পরিকল্পনা মূলত একটি বোমা হামলা, যা আমার স্নায়ুর দরজা-জানালা কাঁপিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, ট্রাম্প শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং পাকিস্তানকেও সন্ত্রাসবাদের সেই যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান, যার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ট্রাম্পের এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, তিনি এমনটি কেন করলেন?
নির্মম রসিকতা দেখুন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা জরুরি। এক পক্ষ ইসরাইল, অপর পক্ষ ফিলিস্তিন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফিলিস্তিনের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা না জেনেই, তাদের সাথে কোনো আলোচনা ছাড়াই এমন এক পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন, যার সুবিধা ভোগ করবে শুধুই ইসরাইল। ভেবে দেখুন, ফিলিস্তিনিরা এ পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করছে, অথচ ট্রাম্পের আজ্ঞাবহ কিছু মুসলিম দেশ এ পরিকল্পনাকে সমর্থন করে যাচ্ছে।
এ কারণে ইসলামী দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য বৃদ্ধি পাবে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নিজের বিরুদ্ধে জবাবদিহিতার আন্দোলন থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্য ট্রাম্প প্রথমে ইরাকে এক ইরানি সেনা কর্মকর্তার ওপর হামলা চালালেন। এখন মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি বিনষ্ট করার জন্য এমন এক পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন, যা সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে আমেরিকার বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব আরো বৃদ্ধি করবে। ট্রাম্পের কাছে শুধু ব্যক্তিস্বার্থই মুখ্য, তাকে সাধারণ আমেরিকার স্বার্থবান্ধব দেখা যাচ্ছে না। ট্রাম্প তার এ নামসর্বস্ব শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণার অনেক আগেই আমেরিকার দূতাবাস জেরুসালেম সরিয়ে নিয়েছেন।
এটা জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলির পরিপন্থী। নতুন পরিকল্পনার অধীনে শুধু জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে তা নয়, বরং জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে বসবাসকারী চার লক্ষাধিক ইহুদিকেও নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে। ট্রাম্পের ঘোষণা শুনে কয়েক মাস আগের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে সাংবাদিকদের একটি সাক্ষাৎকারের কথা আমার মনে পড়ল। সেখানে কিছু সহকর্মী অতি আগ্রহভরে ইমরান খানকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন- ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত, আর ইমরান খান ‘না’ সূচক মাথা নাড়াচ্ছিলেন। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার কাশ্মির ইস্যুতে মধ্যস্থতাকারী হওয়ার প্রস্তাব করে আসছেন। ভারতের পক্ষ থেকে মধ্যস্থতাকারী হওয়ার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তারপরও ট্রাম্প বারবার তার প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছেন।
অথচ এ ব্যাপারে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর নিশ্চুপ। এখন, যখন ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে এক নতুন যুদ্ধের সূচনার পরিকল্পনা পেশ করলেন, পাকিস্তানের উচিত ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আসা কাশ্মিরের মধ্যস্থতাকারী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। যে ব্যক্তি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারেননি, তিনি কাশ্মিরিদের প্রতি ন্যায়বিচার কিভাবে করবেন? ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির নামে নতুন যুদ্ধের সূচনার যে পরিকল্পনা পেশ করেছেন, তা তার মহা উন্মাদনা ও অহঙ্কারনির্ভর চিন্তাভাবনার ইঙ্গিত বহন করে। আর এমন মানসিকতার অধিকারী ব্যক্তি আফগানিস্তানেও শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পরিবর্তে ধোঁকা দেবেন।
পাকিস্তান আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকা ও আফগান তালেবানের মধ্যে আলোচনাকে সফল করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু আফসোস, ট্রাম্পের কর্মপন্থা শান্তির প্রতি বিদ্বেষের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। ট্রাম্প ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পাকিস্তান পর্যন্ত শান্তিপ্রিয় মানুষ নয়; বরং উগ্রবাদী মানুষের হাত শক্তিশালী করছে। পাকিস্তানে এমনও কিছু ‘দয়ালু’ মানুষ রয়েছেন, যারা বলেন- ‘ফিলিস্তিনের চিন্তা বাদ দাও, নিজের চিন্তা করো।’
ওই ‘দয়ালু’ ব্যক্তিদের বলতে চাই, এ অধম আল্লামা ইকবালের মতো দার্শনিক কবি ও কায়েদে আজমের মতো আইনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের অনুসারী। এ দু’জন ফিলিস্তিনকে টুকরো করার বিরোধী ছিলেন। সুতরাং আমি ওই মহান ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসতে পারব না। কেননা ফয়েজ আহমদ ফয়েজও আমাকে এ কথাই বলেছেন- ‘জিস যামীঁ পার ভী খুলা মেরে লাহূ কা পারচাম/ লাহলাহাতা হ্যায় ওহাঁ আরযে ফিলিস্তিন কা আলাম/ তেরে আদা নে কিয়া এক ফিলিস্তিন বারবাদ/ মেরে যাখমূঁ নে কিয়ে কেতনে ফিলিস্তীন আবাদ- যে জমিনেই উড়েছে আমার রক্তের পতাকা/ সেখানেই উড়বে ফিলিস্তিনভূমির পতাকা/ তোমার শত্রুরা এক ফিলিস্তিন করেছে বরবাদ/ আমার জখমগুলো কত ফিলিস্তিন করেছে আবাদ।’
আরব বিশ্বের শায়খরা বায়তুল মুকাদ্দাসের বিষয়ে সমঝোতা করতে পারে, কিন্তু আমরা অনারবরা এ সমঝোতা করতে পারব না। কেননা আমাদের এক পাপী কবি ইবনে ইনশা বলেছেন- ‘দেখ, বায়তুল মুকাদ্দাস কী পারছায়িয়াঁ/ আজনাবী হো গায়ীঁ জিস কী প্যাহনায়িয়াঁ- বায়তুল মুকাদ্দাসের অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখ/বিদেশীরাই হয়ে আছে তার পোশাক।’
যে ট্রাম্প জোরপূর্বক জেরুসালেমের ওপর ইসরাইলের দখলদারিত্বকে স্বীকার করে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত, কাশ্মির ইস্যুতে ওই ট্রাম্পকে আমরা মধ্যস্থতাকারী মানি না। আর ওই ট্রাম্প থেকে আফগানদেরও সতর্ক থাকা উচিত। কেননা তিনি শুধু আমাদের সাথেই নয়, বরং তিনি মার্কিনিদের সাথেও শত্রুতা করে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৩০ জানুয়ারি, ২০২০ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)