রুশ জেনারেলের শ্রীলঙ্কা সফর নিয়ে তোলপাড়
কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল ওলেগ স্যালিকভ - ছবি : সংগ্রহ
রুশ ফেডারেশনের স্থল বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল ওলেগ স্যালিকভের ৫ দিনের শ্রীলঙ্কা সপর শুরু হয়েছে সোমবার। ভারত মহাসাগর অঞ্চলের ঘটনাবহুল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভারত মহাসাগরসহ ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা থেকে চীনকে দূরে রাখার যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের জোরালো প্রয়াসের রুশ বিরোধিতা।
যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চাচ্ছে শ্রীলঙ্কা সরকারের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে।ওয়েস্ট-ইস্ট শিপিং রুটের কাছাকাছি থাকায় দেশটির কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।এই প্রেক্ষাপটে এখন রাশিয়াও চাইবে শ্রীলঙ্কাকে কাছে টানতে এবং শ্রীলঙ্কাকে যাতে পাশ্চাত্য ছিনিয়ে নিতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা।
পাশ্চাত্যের প্রতি রাশিয়ার অসন্তুষ্টির বিষয়টি প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ। জানুয়ারিতে নয়া দিল্লি সফরকালে তিনি বলেছিলেন, এশিয়া-প্যাফিফিককে ইন্দো-প্যাসিফিক বলার প্রয়োজনটা কী? এর জবাব স্পষ্ট। তা হলো চীনকে বাদ দেয়া। পরিভাষা প্রয়োগ করা উচিত বিভাজন সৃষ্টি নয়, বরং ঐক্যবদ্ধ করা।
শ্রীলঙ্কার কঠিনতর অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের চেয়ে শ্রীলঙ্কার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য রাশিয়ার কাছে বেশি যুক্তি রয়েছে। শ্রীলঙ্কান দৃষ্টিতে অপ্রীতিকর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্থলাভিষিক্ত হওয়া যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি হারে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করছে। অন্যদিকে সোভিয়েত আমলেও শ্রীলঙ্কার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। বিশেষ করে বামপন্থী মিসেস সিরিমাভো বন্দরনায়েকে ও মহিন্দা রাজাপাকসার আমলে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল রাশিয়ার।
তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার লড়াই করার সময় পাশ্চাত্য কিন্তু কলম্বোর কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তাছাড়া জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে নালিশও করেছে পাশ্চাত্য।জাতিসঙ্ঘে শ্রীলঙ্কার পক্ষে থেকেছে রাশিয়া, তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রয়োজনীয় অস্ত্রও সরবরাহ করেছিল।
জেনারেল স্যালিকভকে স্বাগত জানিয়ে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনী যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতেই শ্রীলঙ্কার কাছে রাশিয়ার গুরুত্ব এবং বিপরীতটি দৃশ্যমানভাবে ধরা পড়েছে। শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনী জেনালে স্যালিকভকে ‘বিশেষ সম্মানিত অতিথি’ হিসেবে অভিহিত করে। এই পরিভাষাটি শ্রীলঙ্কায় এই মর্যাদার অন্য কোনো বিদেশীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় না। এই জেনারেল মঙ্গলবার ৭২তম জাতীয় দিবস অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
রুশ-লঙ্কা সামরিক সম্পর্ক
সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া ও শ্রীলঙ্কা তাদের সামরিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। তামিল টাইগারদের পরাজিত করার ক্ষেত্রে রুশ সরঞ্জাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন মিটিয়েছে।
২০১৯ সালের আগস্টে ওই সময়ের শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনলি কমান্ডার লে. জেনারেল মহেশ সেনানায়েকে রাশিয়ায় সফল সফর করেন। ওই সময় রুশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে জেনারেল স্যালিকভের সাথে জেনারেল সেনানায়েকের বৈঠকটি ছিল ফলপ্রসূ। রাশিয়া তার মর্যাদাপূর্ণ সামরিক একাডেমিগুলোতে শ্রীলঙ্কান অফিসারদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে সম্মত হয়।
জেনারেল সেনানায়েকে ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডে বোমা হামলার পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে জেনালে স্যালিকভকে জানিয়ছিলেন। উভয়েই এসব সন্ত্রাসীকে দমনের ব্যাপারেও একমত হয়েছিলেন।সন্ত্রাস দমনে শ্রীলঙ্কাকে বিভিন্নভাবে সহায়তার আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল
রুশ সরকার জানিয়েছিল, তারা শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ছয় জাতি সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে শ্রীলঙ্কান সশস্ত্র বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানাবে। আর জেনারেল সেনানায়েকে শ্রীলঙ্কা আয়োজিত বহুজাতিক সামরিক মহড়ায় পর্যবেক্ষক পাঠাতে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।
সার্গেই ল্যাভরভের সফর
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ জানুয়ারির মধ্যভাগে শ্রীলঙ্কা সফর করেন ৪২ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে। শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিনেশ গুনাবর্ধনের সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ল্যাভরভ বলেন,আমরা শ্রীলঙ্কা বাহিনীকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী অস্ত্র সরবরাহ করতে প্রস্তুত। তিনি উল্লেখ করেন, জাতিসঙ্ঘে রাশিয়া ও শ্রীলঙ্কা সহযোগিতা করছে। তিনি আশ্বাস দেন, জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে শ্রীলঙ্কাকে রাশিয়া সহযোগিতা করা অব্যাহত রাখবে।
ল্যাভরভ বলেন, দেশের অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা যেসব প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, সেগুলো বাস্তবায়নে রাশিয়া সমর্থন করবে।
আর জবাবে শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিনেশ গুনবর্ধনে বলেন, শ্রীলঙ্কার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন প্রদান করা জন্য রাশিয়াকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
গোটাবায়া রাজাপাকসা ২০১৯ সালের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তার প্রেক্ষাপটে রুশ স্থল বাহিনীর জনারেল ওলেগ স্যালিকভ শ্রীলঙ্কা সফর করছেন। পম্পেইও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার বিষয়গুলো আবার গুরুত্বসহকারে সামনে আনবে এবং সুশাসন ও ন্যায়বিচারের বিষয়গুলো উত্থাপন করবে।তিনি কলম্বোকে স্মরণ করিয়ে দেন যে যুক্তরাষ্ট্র চায় শ্রীলঙ্কা সরকার অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বিকশিত করার জন্য সহযোগিতা করবে।
এটা পরিষ্কার যে যুক্তরাষ্ট্র চায়, শ্রীলঙ্কা নতজানু হোক মার্কিনিদের কাছে এবং চীনবিরোধী অবস্থান অনুসরণ করুক। কিন্তু সেটা হবে শ্রীলঙ্কা তথা গোটাবায়া সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে আত্মহত্যার সামিল।
ট্রাম্প প্রশাসন চাচ্ছে, গোটাবায়া সরকার সোফা ও এমসিসি নামের দুটি বিতর্কিত চুক্তিতে সই করুক। মিলিনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের (এমসিসি) নামের ওই চুক্তি অনুযায়ী শ্রীলঙ্কাকে ৪৮০ মিলিয়ন ডলারের মঞ্জুরিও দিতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সোফা গ্রহণযোগ্য হবে না। আর এমসিসি পরীক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। সরকার জানিয়েছে, এই চুক্তিটি অনুমোদনের জন্য গণভোটের প্রয়োজন হবে।
এসব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যদি অব্যাহতভাবে শ্রীলঙ্কাকে চাপ দিতে থাকে (এতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, কিন্তু শ্রীলঙ্কার জন্য রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক), তবে গোটাবায়া সরকারকে পাশ্চাত্যের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করতে এবং রাশিয়া ও চীনের দিকে আরো ঝুঁকে বাধ্য হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।