তুরস্ককে নিয়ে ইমরান খানের পরিকল্পনা
এরদোগান ও ইমরান খান - ছবি : সংগ্রহ
পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সঙ্ঘাতের পর মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমনে কূটনৈতিক উদ্যোগ চালানো হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনাদুলু সংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ইমরান খান বলেন, উত্তেজনা প্রশমনে আমরা আমাদের ভূমিকা পালন করেছি বলে মনে করছি এবং আমরা যুদ্ধ এড়াতে পেরেছি।
তবে পরিস্থিতি এখনো উত্তেজনাপ্রবণ রয়ে গেছে এবং স্থায়ী সমাধানের জন্য আরো চেষ্টা প্রয়োজন।
তুরস্কের সাথে সম্পর্ক প্রশ্নে ইমরান খান বলেন, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিপ এরদোগান ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে ইসলামাবাদ সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এতে ইসলামাবাদ ও আঙ্কারার মধ্যকার ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ইমরান খান (৬৭) দেড় বছর ধরে দায়িত্বে আছেন। আনাদুলু এসেন্সিকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন।
তুরস্কের সাথে সম্পর্ক
প্রশ্ন :তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক অনেক পুরনো। আমরা জানি, সেই ১৪৫৩ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুল জয়ে খুশি হয়ে উপমহাদেশের মুসলিমেরা একটি পত্র পাঠিয়েছিল। এই সম্পর্ক ও অংশীদারিত্ব দিন দিন বাড়ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দুই দেশ একসাথে কাজ করতে পারে, কোন কোন ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিতে পারে?
ইমরান খান : সবার আগে বলতে হয়,পাকিস্তানের জনগণ মনে করে যে তুরস্কের সাথে এই সম্পর্ক রয়েছে ১৯২০ সালে শুরু হওয়া খিলাফত আন্দোলনের সময় থেকে। ওই আন্দোলন ছিল সব দিক থেকে আক্রমণের শিকার তুরস্ককে রক্ষা করার চেষ্টা করা। বর্তমান পাকিস্তান ও ভারত থেকে অনেক টাকা তোলা হয়েছিল তুরস্ককে সহায়তা করার জন্য। ওই সময় উসমানিয়ারা খুবই কঠিন অবস্থায় ছিল।তুরস্ক এখনো ওই ঘটনার প্রশংসা করে। আর এটিই দুই দেশের মধ্যকার ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্কের ভিত্তি। আর এখন আমরা দুই সরকারের মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছি। আমাদের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ছে। কাশ্মিরি জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তুরস্কের প্রতি পাকিস্তান খুবই কৃতজ্ঞ।ফ্যাসিবাদী, বর্ণবাদী বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিবৃতি ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। ফলে আমাদের সম্পর্ক দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে।
প্রশ্ন :তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের মূল বিষয় কোনটি? দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক, বিনিয়োগ,অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
ইমরান খান : আমরা আশা করছি, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান পাকিস্তান সফর করবেন বলে আশা করছি।তিনি সাথে করে ব্যবসায়ী হাউস, বিনিয়োগকারীদেরও নিয়ে আসবেন। আমাদের ব্যবসায়ীরাও থাকবেন, তারাও তুর্কিদের সাথে কথা বলবেন। এর মাধ্যমে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করব। খনিজ খাতে দুই দেশের সম্পর্ক বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। পাকিস্তানে অনেক ধরনের খনিজসম্পদ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো উত্তোলন করা হচ্ছে না।বিশেষ করে স্বর্ণ ও তামার খনিগুলো খনন করা হয়নি।প্রেসিডেন্ট এরদোগান এলে আরো অনেক ক্ষেত্র নিয়ে আমরা আলোচনা করব। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা তুরস্কের কাছ থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরও চাই। আমরা সব ধরনের বিষয় নিয়েই আলোচনা করব।
প্রশ্ন :আপনি খিলাফত আন্দোলনের কথা বলেছেন। এটি তুরস্ক ও দক্ষিণ এশিয়ার সম্পর্কের আরেকটি দুয়ার। আমরা খিলাফত আন্দোলনের ১০০তম বছরে প্রবেশ করেছি। উসমানিয়া সাম্রাজ্যকে রক্ষার ওই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ রচনা করেছিল। বছরটি উদযাপনের জন্য কী কী পরিকল্পনা করছেন?
ইমরান খান :আইডিয়াটি দারুণ। আমি তা নিয়ে চিন্তা করিনি। আমরা একটি কঠিন সময়ে এই বছরটি উদযাপন করতে পারি।
প্রশ্ন :দেড় বছর আগে আপনি দক্ষিণ গ্রহণ করেছেন। এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানে কী কী পরিবর্তন হয়েছে।
ইমরান খান : আমার সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দুটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। একটি ছিল আর্থিক ঘাটতি। আমাদেরকে আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার পার্থক্য হ্রাস করতে হয়েছিল। দ্বিতীয়টি ছিল রিজার্ভ ঘাটতি। রুপির দাম এ কারণে পড়ে যাচ্ছিল। মুদ্রাকে স্থিতিশীল করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। আমরা মুদ্রা ঘাটতি ৭৫ ভাগ পূরণ করতে পেরেছি।
জম্মু ও কাশ্মির
প্রশ্ন :জম্মু ও কাশ্মিরে অবরোধ এখন ছয় মাস অতিবাহিত করেছে। কাশ্মিরে এর পর থেকে ইতিবাচক কী পরিবর্তন হয়েছে? আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় আপনার চেষ্টার কোনো ফলাফল হয়েছে কি?
ইমরান খান :প্রথমে আপনাকে বুঝতে হবে কাশ্মিরে কী ঘটছে, ভারতে কী ঘটছে? ভারতে যা ঘটছে তা হলো, সেখানে চরম বর্ণবাদী মতাদর্শ গ্রহণ করা হয়েছে। এটাকে বলে আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংস্থা)। এই মতাদর্শ অনুযায়ী,ভারত কেবল হিন্দুদের দেশ।একে বলা হয় হিন্দুত্ববাদ। ১৯৩০-এর দশকের নাৎসিবাদ থেকে এটি উদ্দীপ্ত হয়েছিল। তারা বিশ্বাস করত যে জার্মান জাতিই সেরা। এখন হিন্দুরাও ঠিক তেমনভাবে বিশ্বাস করে যে তারাই সেরা।এর ফলে ৫০ কোটি লোক বাদ পড়ে যাবে। এই আরএসএস চরমপন্থীরাই গান্ধীকে হত্যা করেছিল। এই সংগঠনটি তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছিল সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে।এখন তারা সংখ্যালঘুদের চেপে ধরেছে। তারা সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালাচ্ছে।তবে কাশ্মিরে তারা সংবিধানও লঙ্ঘন করেছে।তোরা কাশ্মিরের মর্যাদা পরিবর্তন করেছে একতরফাভাবে। কাশ্মির নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদও এই বিরোধের বিষয়টি স্বীকার করে। কিন্তু তারা জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে কাজ করেছে। তারা ছয় মাস ধরে কাশ্মিরের ৮০ লাখ লোকের ওপর কারফিউ জারি করে রেখেছে। সেখানে তারা ৯ লাখ সৈন্য মোতায়েন করেছে।তারা সেখানকার নেতাদের আটকে রেখেছে। হাজার হাজার তরুণকে তারা কারারুদ্ধ করে রেখেছে। অনেককে কাশ্মিরের বাইরেও রাখা হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। পাকিস্তান বিষয়টি জাতিসঙ্ঘ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থায় উত্থাপন করেছে। জাতিসঙ্ঘে ভারতের ভূমিকার নিন্দা করে এরদোগান প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। কাশ্মিরে যা ঘটছে, তা অবৈধ ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
প্রশ্ন : ভারত মুসলিমদের বিরুদ্ধে আরো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা নাগরিকত্ব আইন তৈরী করেছে, বাবরি মসজিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখান থেকেও কি মিয়ানমারের মতো মুসলিমদের বের করে দেয়া হবে?
ইমরান খান :তারা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন করেছে, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি করেছে। আসলে তারা ভারতে বসবাসকারী ২০ কোটি মুসলিমকে টার্গেট করেছে। মিয়ানমারে নিবন্ধন আইন করে ঠিক একই কাজ করেছিল। তারপর সেখান থেকে মুসলিমদেরকে বের করে দেয়ার জন্য গণহত্যা চালানো হয়েছিল।কী ঘটতে যাচ্ছে, তা ভেবে আমি ভীত।
প্রশ্ন : পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কি ভারত থেকে আসা লোকদের নিয়ে অভিবাসন সমস্যায় পড়তে পারে?
ইমরান খান :আমি মনে করি, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কারণ প্রায় ২০ লাখ লোককে বাদ দেয়া হয়েছে তালিকা থেকে। তারা কোথায় যাবে? বাংলাদেশ তো বলে দিয়েছে, তারা তাদের নেবে না। তাহলে তারা কোথায় যাব?
প্রশ্ন :আপনি এই অঞ্চলে কোনো যুদ্ধ না হওয়ার জন্য চেষ্টা করছে? এতে কোনো ফল পেয়েছেন কি?
ইমরান খান :আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে ফলাফলটা সর্বশক্তিমানের হাতে ছেড়ে দিতে পারে।
আনাদুলু এজেন্সি