কী হচ্ছে লেবাননে?

ওসামা আল শরীফ | Feb 02, 2020 04:42 pm
কী হচ্ছে লেবাননে?

কী হচ্ছে লেবাননে? - ছবি : সংগ্রহ

 

এক শ’ দিনেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবাদ বিক্ষোভের পর সুন্নি মুসলিম টেকনোক্র্যাট হাসান দিয়াবের নেতৃত্বে লেবানন নতুন সরকার পেয়েছে। গোষ্ঠীগত ও সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদী জনগণ যে ধরনের সরকার চেয়েছিল এটা সে ধরনের সরকার নয়। প্রকৃতপক্ষে, ২০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার মাধ্যমে কথিত মার্চ ৮ জোট এবং হিজবুল্লাহ, আমল ও ফ্রি প্যাট্রিওটিক মুভমেন্টের (এফপিএম) সমন্বয়ে গঠিত একটি কোয়ালিশন যেটাকে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ নামে অভিহিত করা হয়, তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

এই মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে হিজবুল্লাহর বক্তব্যই চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তার অনুগত মন্ত্রীদের মাধ্যমে হিজবুল্লাহ তাদের অনাকাক্সিক্ষত নীতির বিরুদ্ধে ভেটো দিয়ে মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। প্রতিবাদকারীরা প্রধানমন্ত্রী দিয়াবকে কখনো মেনে নেবে না। কারণ তারা একটি ‘স্বাধীন মন্ত্রিসভা’ চেয়েছিল। তা এমন একটি স্বাধীন মন্ত্রিসভা- যারা নির্বাচনের জন্য নতুন আইন তৈরি করে শিগগিরই নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানাবে। তারা চেয়েছিল হিজবুল্লাহর প্রধান মিত্র প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে গত অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রতিবাদকারীরা দেশের ইনস্টিটিউশনগুলো এবং সম্পদের ওপর থেকে রাজনৈতিক এলিটদের কয়েক দশকের পুরনো নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল। যে গোষ্ঠীগত ব্যবস্থার মাধ্যমে অল্প কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখে দেশকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে বিপুল বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত এবং বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে, প্রতিবাদকারীরা তার নিন্দা করেছেন এবং ‘গোষ্ঠীগত ব্যবস্থার হোতাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’ বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

নতুন সরকার এমনকি আস্থা ভোটে জয়লাভের আগেই অথবা তাদের কর্মসূচি উপস্থাপন না করেই পার্লামেন্টে ২০২০ সালের বাজেট উপস্থাপন করতে চাইলে গত সপ্তাহে জনগণ ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হারিরির ফিউচার মুভমেন্ট, সামির গিগির লেবানিজ ফোর্সেস, ওয়ালিদ জুমলাতের প্রগ্রেসিভ সোস্যালিস্ট পার্টির মতো প্রধান রাজনৈতিক খেলোয়াড়রা সাইডলাইনে রয়েছেন। নতুন সরকারের জন্য সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। এ সময় তাদের আইন প্রণয়ন এবং সংস্কার কর্মসূচি চালু করতে হবে। বন্ড পেমেন্টের ক্ষেত্রে দেশ হয়তো দ্রুত অক্ষমতা বা বিচ্যুতিতে পড়তে পারে; তাই প্রকৃতপক্ষে দিয়াবের সময় ফুরিয়ে আসছে।

ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রধান ঋণদাতাদের সন্দেহ দূর করে আশ্বস্ত করার জন্য তার হাতে সময় আছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ। দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করতে, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের জন্য উল্লিখিত দুটি দেশের ঋণ প্রয়োজন। লেবাননের ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করার জন্য পাঁচ বিলিয়ন থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সহায়তা দরকার। এ জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলকে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ওয়াশিংটনের অনুমোদন প্রয়োজন। এখন এসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কেবল ফ্রান্সই দিয়াবের সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অপর দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মতামত হিজবুল্লাহর নিজের মতের মতো। এটা বিস্ময়কর যে, হিজবুল্লাহ কেন তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে স্বভাববহির্ভূত বিচ্ছিন্নতা বা উন্মত্ততাকে বেছে নেবে এবং ছায়া মন্ত্রিসভাকে সমর্থন দেবে? এ ধরনের মন্ত্রিসভাকে ওয়াশিংটন যে প্রত্যাখ্যান করবে, তা নিশ্চিত। কলঙ্কিত সিরিয়াপন্থী রাজনীতিবিদ জামিল আল সাইয়্যেদ সরকার গঠনে ভূমিকা পালন করায় লেবাননের রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ নাগরিকরা শঙ্কিত।

হিজবুল্লাহ কেন, নতুন সরকার গঠনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনে উদ্যোগী হয়েছে, এর একটি ব্যাখ্যা হলো- প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের খোলামেলাভাবে শোডাউনের ক্ষেত্রে লেবানন অপর একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। এমনিতেই বলা যায় যে, হিজবুল্লাহর প্রধান উদ্বেগ বর্তমানে লেবাননের স্থিতিশীলতা নয়, বরং ইরানের আঞ্চলিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। মনে হচ্ছে, আউনের একমাত্র স্বার্থ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকা; আর যত মূল্যই দিতে হোক না কেন, তার বিতর্কিত জামাতা জিবরান বাসিলকে লেবাননের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে অপরিবর্তিত রাখা।

বাসিল বর্তমানে এফপিএমের প্রধান। একটি হুমকি হচ্ছে, হিজবুল্লাহর এই খেলা গোষ্ঠীগত উত্তেজনাকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ সুন্নি মুসলিম এবং দ্রুজরা বিশেষভাবে ক্রমবর্ধমানভাবে বিচ্ছিন্নতাবোধ করছে। (ইরানি সেনাপতি) কাসেম সুলাইমানিকে হত্যা করার পর (হিজবুল্লাহ নেতা) হাসান নসরুল্লাহকে এখন তেহরান অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছে। নসরুল্লাহ কি বুঝতে পেরেছেন, দিয়াব সরকারের ব্যর্থতার অর্থ হচ্ছে লেবাননের অর্থনীতি মুখথুবড়ে পড়া? প্রকৃতপক্ষে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, দিয়াবের ব্যর্থতা সরাসরি হিজবুল্লাহ ও তার মিত্রদের ওপর গিয়ে পড়বে এবং শিয়া দলটিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসবে। অতীতে হিজবুল্লাহ পেছনের আসনে ও পর্দার অন্তরাল থেকেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করত।
যত দ্রুত সম্ভব শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘যথাযথ সংস্কার দেখতে চায়’ বলে বিবৃতি দেয়া সত্ত্বেও ঋণ দেয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক অগ্রাধিকারই তাদের কাছে গুরুত্ব পাবে।

ইরান-আমেরিকা বিরোধ ও শোডাউন নতুন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ওয়াশিংটন আশা করে, ইরানি অর্থনীতির রাশ টেনে ধরলে দেশটিতে যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠবে, তাতে তেহরান নতুন একটি পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে অথবা সরকারের পতন ঘটার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সে লক্ষ্যেই ওয়াশিংটন এখন ইরাক ও লেবাননে ইরানি প্রক্সির ওপর চাপ প্রয়োগ করছে।
সময় লেবাননের দিয়াবের অনুকূলে নয়। যথাযথ সংস্কারের জন্য তিনি যেসব উদ্যোগ নেবেন, এলিট রাজনৈতিক শ্রেণী এর বিরোধিতা করবে। কারণ তারা এতদিন অনেক কিছু হারিয়েছে। দিয়াবের ব্যর্থতা এবং সম্ভাব্য বিদায় লেবাননের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। হিজবুল্লাহ হয়তো আশা করছে- এটা ঘটলে তারা হারিরিকে দায়িত্বে ফিরিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে : ১৭ অক্টোবরের পর লেবাননে যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তার মাধ্যমে দেশটি একটি ভিন্ন দেশে পরিণত হয়েছে। প্রতিবাদকারীরা বাড়ি ফিরে যায়নি। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে যেকোনো সময়ে দ্রুত তাদের দুঃখ-দুর্দশা আরো বৃদ্ধি পাবে।

লেখক : সাংবাদিক ও আম্মানভিত্তিক রাজনৈতিক ভাষ্যকার
‘আরব নিউজ’ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us