নির্বাচনী বিতর্কের নতুন মাত্রা
নির্বাচনী বিতর্কের নতুন মাত্রা - ছবি : সংগ্রহ
১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শনিবার। এই দিনটি বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে আরেকটি আশা ভঙ্গের দিন হিসেবে। কারণ, ওই দিনটিতে বেশ কিছু প্রশ্নের ও নানা বিতর্কের অনুষঙ্গের জন্ম দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ঢাকাবাসীর একটি ক্ষুদ্র অংশ এ নির্বাচনে তাদের ভোট দিয়েছেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের প্রত্যাশা নিয়ে। অপর দিকে, বিপুল সংখ্যক ভোটার ভোট কেন্দ্রে যাননি। গত বছর অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল অতিমাত্রায় কম। তখন ধারণা করা হয়েছিল দেশের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান ভোট প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাহীনতাই ভোটদানের প্রতি ভোটারদের এই অনাগ্রহের কারণ। এমনি প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অধিক হারে অংশ নিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি পূরণের আহ্বানই জানানো হয়েছিল ভোটরদের প্রতি। নির্বাচন কমিশনও এবারের নির্বাচনের আগে বারবার একই আহ্বান জানিয়েছে ভোটারদের প্রতি। কমিশন বলেছে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ হচ্ছে নাগরিক সাধারণের পবিত্র অধিকার। নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছিল, এবার ভোটকেন্দ্র ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজধানীতে বিভিন্ন বাহিনীর অর্ধ-লক্ষাধিক সদস্য ভোটের দিন দায়িত্ব পালন করবেন।
এমনি প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শুধু ঢাকার নয়, সারা দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল এবারের সিটি নির্বাচনে সর্বাধিক সংখ্যক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। কিন্তু নির্বাচনের দিন আমরা দেখলাম ভোটার উপস্থিতি আগের চেয়েও কমে গেছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সচিত্র খবরে দেখা গেছে, সকালে সামান্যসংখ্যক ভোটার ভোটকেন্দ্রে এসেছেন ভোট দেয়ার জন্য। তখন নির্বাচনী কর্মকর্তাদের আশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়বে। বাস্তবে দুপুরের দিকে কিছুসংখ্যক কেন্দ্রে খুব নগণ্যসংখ্যক ভোটার উপস্থিতি বাড়লেও অনেক কেন্দ্রে তা বাড়েনি। আর একদম শেষ দিকে অনেক কেন্দ্রই ভোটারশূন্য দেখা গেছে। এর অনেক কারণের মাঝে একটি কারণ হতে পারে, অনেক কেন্দ্রে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এসব ঘটনা ভোটারদের ভোটদানে কিছুটা হলেও নিরুৎসাহিত করেছে। ফলে এবারের ঢাকা সিটি নির্বাচনকে কেউ ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করলেও কিছু বলার থাকবে না।
নির্বাচনের ফলাফল এরই মধ্যে ঘোষিত হয়েছে। ভোটে দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থীরাই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন। বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থীই বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। বিএনপি ভোটের এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে রোববার ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। এই হরতালে সমর্থন জানায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফলাফল যাই হোক, এবারের নির্বাচনেও বিতর্ক আমাদের পিছু ছাড়েনি। এবারো আমাদের নির্বাচন কমিশন বিতর্কের খাদ থেকে জাতিকে তুলে আনতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এবারের নির্বাচনে ভোটারদের অতিমাত্রিক কম উপস্থিতি প্রমাণ করে এই নির্বাচন কমিশন ও দলীয় সরকারের অধীনে চলমান নির্বাচনী ব্যবস্থা দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, এ নির্বাচনে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। অপর দিকে, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ২৫ শতাংশের চেয়েও কম ভোট পড়েছে। তবে জনধারণায় এবার এর চেয়েও অনেক কম হারে ভোট পড়েছে এ নির্বাচনে। এটি বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি বড় ধরনের অনাস্থা প্রকাশেরই প্রতিফলন।
এই নির্বাচনেও বরাবরের মতো কেন্দ্র থেকে প্রতিপক্ষের এজেন্ট বের করে দেয়ার ঘটনা ছিল ব্যাপক। বিবিসি সংবাদদাতাকে তাদের ফেসবুক লাইভে বলতে শোনা গেছে, তিনি এ নির্বাচনে কমপক্ষে ১৫টি কেন্দ্র্রে গেছেন। তবে একটি ছাড়া কোনো কেন্দ্রেই সরকারবিরোধী প্রার্থীর কোনো এজেন্টের উপস্থিতি দেখতে পাননি। তবে যে কেন্দ্র তিনি সরকারবিরোধী প্রার্থীর এজেন্টের দেখা পেয়েছেন তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন তিনি কোন প্রার্থীর এজেন্ট? কিন্তু ওই ব্যক্তি তার মনোনয়নদাতা প্রার্থীর নামটি পর্যন্ত বলতে পারেননি। এতেই প্রমাণ হয়, আসলে তিনিও কার্যত বিরোধীদলীয় কেনো প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন না। বিবিসির অপর সংবাদদাতাও অন্য এলাকার ১৫টির মতো কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে এজেন্ট উপস্থিতির ব্যাপারে একই ধরনের চিত্র তুলে ধরেন। তাদের কাছে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, সরকারবিরোধী অনেক প্রার্থীর অনেক এজেন্টকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আবার যারা ঢুকতে পেরেছিলেন তাদেরও সরকারি দলের লোকেরা কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। এ ব্যাপারে নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সহযোগিতা চেয়েও তারা পাননি।
সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোট দিতে এসে নিজ ভোটকেন্দ্রে বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীদের এজেন্ট খুঁজেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। রাজধানীর ইস্পাহানি স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান। বেলা সাড়ে ১১টায় ভোট দেয়া শেষে তিনি প্রায় ৪৫ মিনিট ওই কেন্দ্রে অবস্থান করেন। বিভিন্ন বুথে গিয়ে জানতে চান, সরকারবিরোধী প্রার্থীদের এজেন্ট আছে কি না। এ সময় বেশির ভাগ বুথ থেকে জানানো হয় বিরোধী প্রার্থীদের কোনো এজেন্ট নেই। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অসংখ্য অভিযোগ আমি পেয়েছি। নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। স্বচ্ছ শব্দের বানান আমি জানি। এর অর্থ কতটুকু ব্যাপক, এটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রয়োগসিদ্ধ তা আমার জানা নেই।’ মোটামুটিভাবে বলা যায়, সরকারি দলের নেতকর্মী ও এজেন্টদের উপস্থিতিতেই এ নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে এক আওয়ামী লীগের প্রথমসারির একজন নেতা বলেছেন, ইভিএমে এজেন্ট লাগে না, ইভিএমই পাহারাদার।
ভোটের আগে থেকেই ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন মহল যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, তার শতভাগ প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়েছে সদ্য সমাপ্ত দুই সিটি নির্বাচনে। ইভিএম নিয়ে অনেকের মতো বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নির্বাচনের আগের দিন দুটি সুনির্দিষ্ট শঙ্কার কথা প্রকাশ করে। এ ছাড়া নাগরিকদের প্রতি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে উপযুক্ত প্রার্থীকে ভোট দিয়ে ‘বিতর্কিত নির্বাচন’-এর সংস্কৃতি থেকে উত্তরণের আহ্বান জানায় এ সংস্থা। ভোটের আগের দিন এক ভিডিও বার্তায় সুজন সম্পাদক বদিউল আলম এই আহ্বান জানান। ইভিএম নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি জানি ভোট নিয়ে অনেকের মনে অস্বস্তি আছে, শঙ্কা আছে। উদ্বেগের একটা কারণ হলো, নির্বাচন কমিশনের অতীত ভূমিকা। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আমাদের জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভূমিকা পক্ষপাতদুষ্ট। এর সাথে আরেকটি সমস্যা হলো, সব কেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট হবে। ইভিএমের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। একটি দুর্বলতা হলো ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার লোডেড ট্রেইল নেই। যেটা ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেখানকার ইভিএমে সংযুক্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা কাকে ভোট দিলাম তা নির্ধারণ করা যায় এবং একই সাথে ভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ভোট পুনর্গণনা করা যায়। বর্তমানে যে ইভিএম আমরা ব্যবহার করছি, সে ইভিএমে নির্বাচন কমিশন যা বলবে তাই আমাদের মেনে নিতে হবে।
ইভিএমের দ্বিতীয় দুর্বলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, এতে আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে ভোটারদের শনাক্ত করা হয়। অনেকের আঙুলের ছাপ ইভিএম পড়তে পারে না। তাই কর্মকর্তাদের এই ইভিএমকে ওভাররাইট করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ওভাররাইট করার অধিকার দেয়া হয়েছে। এর অর্থ ভোটারের পরিচিতি যদি নির্বাচন কর্মকর্তা আপলোড করতে পারে, ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রার্থী অনুপস্থিত থাকলে নির্বাচনী কর্মকর্তা তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে দিতে পারবেন। এটি একটি ভয়াবহ ব্যাপার।
ইভিএম যে সবার আঙুলের ছাপ পড়তে পারে না, তার সাক্ষাৎ প্রমাণ পাওয়া গেছে এই সিটি নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনের ভোট দেয়ার সময়। ইভিএমএ ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন সিইসি। তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মেলায় তিনি এই বিড়ম্বনার শিকার হন। পরে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে নিজে ভোট দেন। তবে অভিযোগে প্রকাশ, ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মেলায় অনেককে ভোট না দিয়েই ফিরে যেতে হয়েছে। কেউ বলেছেন, আমি বোতাম চাপলাম, ভোট কোথায় পড়ল বুঝলাম না। ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হন ঐক্যফ্রন্টেরর শীর্ষনেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনও। এই পদ্ধতিতে ভোট দেয়ার সময় গোপনীয়তা রক্ষা হচ্ছে না বলে অভিযোগ অনেকের। এ ব্যবস্থার প্রতি খুব অল্পসংখ্যক ভোটার তাদের সন্তুষ্টির কথা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন। অন্যরা বলেছেন- কারো আঙুলের ছাপ মিলছে না, কখনো মেশিন কাজ করছে না, কোথাও যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য ভোট বন্ধ রাখতে হয়েছে। কারো অভিযোগ তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে পোলিং এজেন্ট বলেছে সময় নেই চলে যান।
এবারের নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, সকাল ১১টার দিকে টিকাটুলির কামরুননেসা বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে সরকার সমর্থিতরা ইভিএম মেশিন ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। একদল যুবক সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার অসীম কুমার সরকারের কক্ষে ঢুকে ইভিএম মেশিন ও ল্যাপটপ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এবারের নির্বাচনে ইভিএম মেশিনে যেসব আশঙ্কার কথা আমরা শুনে আসছিলাম, নির্বাচনে সেসব আশঙ্কার বাস্তব প্রতিফলনই দেখা গেছে; যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের হামলায় কমপক্ষে ছয়জন গণমাধ্যম কর্মী আহত হয়েছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন কেন্দ্রে নাজেহাল ও হেনস্থার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকেরা। অনেক গণমাধ্যম কর্মীর মুঠোফোন ও ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটে। রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে এসব হামলা চলে। অভিযোগে প্রকাশ, হামলার শিকার আহতদের মধ্যে আছেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘আগামী ডটকম’-এর প্রতিবেদক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন। তিনি রায়ের বাজার সাদেক খান রোডে সকাল ১১টায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের হামলার শিকার হন। অন্য এক হামলার ঘটনায় ‘পরিবর্তন ডটকম’র চিত্রসাংবাদিক ওসমান গণির ওপর হামলা হয় টিকাটুলি এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়। প্রেসবাংলা এজেন্সির বিশেষ প্রতিনিধি জিহাদ ইকবাল দুষ্কৃতকারীদের হামলায় পড়েন জানে আলম স্কুল কেন্দ্রে। এ ছাড়াও হামলার শিকার হন দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রধান আলোকচিত্রী শেখ হাসান, বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদক মাহবুব মমতাজি এবং ডেইলি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদক নুরুল আমিন। তাদের ওপর হামলার কারণ খুবই সহজবোধ্য।
এদিকে এবারের সিটি নির্বাচনে কূটনীতিকদের তৎপরতায় সরকারপক্ষের প্রকাশ্যে নাখোশের বিষয়টি ছিল একটি নতুন মাত্রা। সরকার পক্ষ বলেছে, নির্বাচন নিয়ে কথা বলে এবং প্রার্থীদের সাথে বৈঠক আর দেখা করে কূটনীতিকরা শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন। নির্বাচনের দু’দিন আগে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় পশ্চিমা ৯ দেশের রাষ্ট্রদূতরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করে এক যৌথ বিবৃতি দেন। যুক্তরষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ৯টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা ওই যৌথ বিবৃতিতে উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দেয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তারা তাদের বিবৃতিতে ভোটের ফলাফল সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সাথে প্রকাশের আহ্বান জানান। এই বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকার নাখোশ হয়। কূটনীতিকদের নিয়ে এই অসন্তুষ্টির সূচনা ভোটের আগের রোববার থেকে। ওই দিন দুপুরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন সাক্ষাৎ করেন। এ ব্যাপারে অসন্তুষ্টির রেশ না কাটতেই রবার্ট ডিকসনের বাসায় কূটনীতিকদের বৈঠক নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশী যারা বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি করেন, তাদের বিদেশী পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগে আপত্তি তোলে বাংলাদেশ সরকার। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজে ভোট দেয়ার সময় এ প্রসঙ্গে তার অসন্তুষ্টির কথা জানান।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন কূটনীতিকদের আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান। আর তা না হলে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেন। অপর দিকে, নির্বাচনে কোনো দেশের পর্যবেক্ষক যেন মাতবরি না করে সেদিকে নজর রাখতে ইসিকে পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচটি ইমাম। ৩০ জানুয়ারি তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠকের সময় এ পরামর্শ দেন। অনেকেই মনে করছেন, কূটনীতিকরা যদি নির্বাচনী কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘন করেই থাকে, তবে সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনই তাদের জানিয়ে দিতে পারতেন এবং একই সাথে আচরণবিধি মেনে চালার আহ্বান জানাতে পারতেন। সেখানে এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা এইচটি ইমামের কথা বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তা ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে কূটনীতিকদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন এবং এইচটি ইমাম তাদের মাতবরি থামাবার জন্য সিইসিকে পরামর্শ দিয়েছেন কূটনীতিসুলভ ভাষা নয়। এ ধরনের ভাষা প্রয়োগ কূটনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভুললে চলবে না, সব দেশের সাথে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা প্রতিটি দেশের জন্য কাম্য। বিশেষ করে আইসিজে-এর রায়-উত্তর পরিবেশে আমাদের অন্যান্য দেশের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। অতএব, আমরা যেন কূটনৈতিক ভাষা প্রয়োগে আরো সতর্ক হই।
আসলে এই নির্বাচন প্রসঙ্গে বলতে হয়, ব্যালট পেপার থেকে ইভিএম মেশিনে পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো পরিবর্তন হয়নি এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। বিভিন্ন কেন্দ্রে এবারো ভোট চলেছে সেই পুরনো একই কায়দায়। কেন্দ্রে কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষ, প্রতিপক্ষের অ্যাজেন্ট বের করে দেয়া, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব, ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে না দেয়া, সরকারবিরোধী প্রার্থীকে ভোট দেয়ার কারণে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, সরকারি দলের প্রার্থীর চিহ্নে ভোট দিতে বাধ্য করা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, ইভিএম বিড়ম্বনা, ইভিএম দখলে নেয়া, ইভিএম ছিনতাইয়ের চেষ্টা, ভোটারশূন্য ভোটকেন্দ্র ইত্যাদি সবই চলেছে আগেরই মতো, পুরনো কায়দায়। এসব কারণে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না এই নির্বাচন কমিশনকে। সেই সাথে বাড়ছে দেশের মানুষের নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা। এর শেষ কোথায়, তা আমাদের জানা নেই।