ভারতের বাজেট নিয়ে এত সমালোচনা করেন?
বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন ভারতের অর্থমন্ত্রী - ছবি : সংগ্রহ
নরেন্দ্র মোদি সরকারের ২০২০-২১ সালের বার্ষিক বাজেটের প্রধান উদ্দেশ্য হলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ফিরিয়ে আনা। এই শ্রেণিটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে দূরে সরে গিয়েছিল। তবে বিরোধী দলের নেতারা অভিযোগ করছেন যে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে কিংবা চাকরি সৃষ্টি করার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এই বাজেটে নেই। তাদের মতে, এটি ‘আচ্ছে দিনের’ মতো আরেকটি স্বপ্ন ফেরি করার চেষ্টা।
আরো অভিযোগ রয়েছে যে মোদি সরকার অব্যাহতভাবে জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে এলেও প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানো হয়েছে মাত্রা ৫.৮ ভাগ, আর এর ৬৫ ভাগ ব্যয় হবে বেতন আর পেনশন মেটাতে। ফলে আধুনিক সরঞ্জাম কেনার সুযোগ থাকবে খুবই কম।
বাজেটের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
একটি সন্ত্রাসী হামলা ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে একটি স্বল্প মাত্রার সামরিক সঙ্ঘাতকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অন্ধদেশপ্রেম সৃষ্টি করতে। আর তার ফল পান ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত হওয়া পার্লামেন্ট নির্বাচনে।কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অন্ধদেশপ্রেম সাময়িকভাবে অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোকে সাময়িকভাবে ধামাচাপা দিতে পারলেও শেষ পর্যন্ত এগুলো তাকে ঝামেলায় ফেলতে শুরু করেছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অভিজিত ব্যানার্জি ও অমর্ত্য সেনের মতো নোবেল বিজয়ীরা দাবি করছেন যে অর্থনৈতির মারাত্মক বিপর্যয় ও চাকরিহীনতার জন্য মোদিই দায়ী। মোদির সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে চলমান গণআন্দোলন দেখিয়েছে যে এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজ, অথচ মোদি মনে করতেন, তিনি তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। তার সমস্যা বাড়িয়ে বিজেপি একের পর এক রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনগুলোতেও হারছে। এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষঅপটে মোদি সরকারের ২০২০-২১ সালের জন্য অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারামনের শনিবার পার্লামেন্ট পেশ করা বাজেট বিবেচনা করা উচিত।
গ্রামীণ দারিদ্র্যতা ও গ্রামীণ খাত থেতে ব্যাপক পতনমুখী ধারার কারণে শিল্প খাতে মন্থরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং তা চাকরির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থা দূর করার জন্য বাজেটে ৪০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে কৃষি খাতে এবং ৫০.৬৫ বিলিয়ন ডলার কেন্দ্রীয় পানি খাতে। ভারতের জিডিপিতে ১৫ ভাগ হলো কৃষি খাতের অবদান।আর এটা হলো দেশটির ১.৩ বিলিয়ন লোকের ৫০ ভাগের বেশির জীবিকার উৎস। সরকারের লক্ষ্য হলো ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা।
ভারতের বর্তমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ ভাগ, তবে সরকার চায় তা ৬ থেকে ৬.৫ ভাগে উন্নীত করতে চায় ২০২১ সাল নাগাদ। আর সরকারের টার্গেট ২০২৫ সাল নাগাদ ভারতের ২.৯৪ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিকে ৫ ট্রিলিয়নের অর্থনীতিতে পরিণত করা।
বাজেটে ৬৯০ বিলিয়ন রুপি বরাদ্দ রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। গত বছরের চেয়ে তাতে সামান্য বৃদ্ধি ঘটেছে।
সাধারণ মানুষের পকেটে আরো টাকা দিতে সরকার কর হারকে সংশোধন করেছে। লোকজন ৫ লাখ রুপি পর্যন্ত আয়ের জন্য আয়কর দিতে হবে না। যাদের আয় ৫ লাখ থেকে ৭.৫ লাখ রুপি, তাদেরকে এখন দিতে হবে ১০ ভাগ। যাদের আয় ৭.৫ লাখ থেকে ১০ লাখ রুপি, তাদের আয়কর দিতে হবে ১৫ ভাগ।
ভারত যাতে প্রতিযোগিতামূলক থাকে, সেজন্য করপোরেট কর হার নতুন ম্যানুফেকচারিং কোম্পানির জন্য নজিরবিহীনভাবে কমিয়ে করা হয়েছে ১৫ ভাগ, আর বিদ্যমান কোম্পানিগুলোর জন্য ২২ ভাগ। এটা বিশ্বে সর্বনিম্ন। এতে আশা করা যায়, করপোরেট বেঁচে যাওয়া অর্থ বিনিয়োগ করবে এবং চাকরি সৃষ্টি হবে।
বাজেটে ভারতের প্রতিটি জেলায় রফতানি হাব করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছ। ভারতের রফতানি হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৯-২০ সময়কালের এপ্রিল-ডিসেম্বরে রফতানি হ্রাস পেয়েছ ১.৯৬ ভাগ, তথা ২৩৯.২৯ বিলিয়ন ডলার। আমদানি হ্রাস পেয়েছে ৮.৯ ভাগ, তথঅ ৩৫৭.৩৯ বিলিয়ন ডলার, ফলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছ ১১৮.১০ বিলিয়ন ডলার।
অবকাঠামো খাতে বিপুল পরিকল্পনা রয়েছে। সড়ক ও মহাসড়ক, নৌপথ, রেল অবকাঠামো বানানোর জন্য মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০৩ লাখ কোটি রুপি। ২০২৫ সাল নাগাদ আরো ১০০ বিমানবন্দর নির্মাণ করা হবে।
প্রশিক্ষণ ও চাকরি
ভারতের ২০৩০ সাল নাগাদ থাকবে সর্বোচ্চ কর্মী এইজ গ্রুপ। চাকরি ও লাইফ স্কিলের ওপর জার দেয়া হচ্ছে। ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে ১৫০ উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম শুরু করবে।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রস্তাব করা হয়েছ। শীর্ষ ১০০ প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে ডিগ্রি দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী উচ্চশিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন। শিক্ষা খাতে সরকার ব্যয় করতে চায় ৯৯,৩০০ কোটি রুপি, স্কিল ডেভেলপমেন্ট খাতে ৩০০০ কোটি রুপি।
প্রতিরক্ষা
২০২০-২১ সময়কালের জন্য বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৩.৩৭ লাখ কোটি রুপি। ২০১৯ সালে এই খাতে যে বরাদ্দ ছিল এবার তা থেকে বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৫.৮ ভাগ। মজার ব্যাপার হলো,বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী কিন্তু প্রতিরক্ষার কথঅ বলেননি। এতে বোঝা যাচ্ছে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটি কম গুরুত্ব পাচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই প্রতিরক্ষা বাজেটে ক্যাপিট্যাল এক্সপেন্ডিটার থাকে ৩৩ থেকে ৩৪ ভাগ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটা হওয়া উচিত অন্তত ৪৫ ভাগ। তবে ব্যয়ের বেশির ভাগই যায় বেতন ও পেনশনে।
মেজর জেনারেল অশ্বিনী সিওয়াচের (তিনি টেরিটরি আর্মির সাবেক প্রধান) মতে, গত বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.৫ ভাগ, যা ছিল ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর সর্বনিম্ন। অথচ আমাদের প্রতিবেশী, বিশেষ করে পাকিস্তান ও চীনে তা বাড়ছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেট তাদের জিডিপির ৩.৫ ভাগ, চীনের প্রায় ৪ ভাগ। ভারতের বাজেট হতে পারত ২.৫ ভাগ।
অন্যান্য সমালোচনা
কংগ্রেস তেনা রাহুল গান্ধী বলেছেন, বাজেটে কোনো কৌশলগত ধারণ বা সুনির্দিষ্ট কিছু নেই। তিনি একে গতানুগতিক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি দেশের তরুণদের বেকারত্বের কথাছিল অনুল্লেখ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।
মাক্সর্সবাদী নেতা সিতারাম ইয়েচুরি বলেন, এটা হলো দীর্ঘতম অ-বাজেট, বাজেট বক্তৃতা। তবে মন্ত্রী বলেননি যে কোথা থেকে ব্যয় করার অর্থ সগ্রহ করবেন।অর্থনৈতিক মন্থরতা থেকে উদ্ধারের কোনো রোডম্যাপও এখানে নেই।
তবে করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, হুন্ডাই মটর ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট বি সি দত্ত বলেছেন, ব্যক্তিগত আয়কর হ্রাস করায় গাড়ির চাহিদা বাড়বে, যা ২০১৯ সালে মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছিল।