বার্নাবাসের বাইবেল কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
বার্নাবাসের বাইবেল - ছবি : সংগ্রহ
বার্নাবাস যিশুর ১২ জন সঙ্গী বা সাহাবির একজন। তিনি যিশুর সাথে থেকে অলৌকিক ঘটনাবলির প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তার লিখিত বাইবেলে এসব লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মযাজকরা গসপেল অব বার্নাবাসকে ত্রিত্ববাদবিরোধী হওয়ার কারণে Non canonical Bible হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং একই সাথে আরো কিছু প্রামাণ্য বাইবেল যা যিশুর (ঈসা আ:) বাণী ও কর্মময় জীবন নিয়ে লিখিত হয়েছিল, তাও বাদ দিয়েছেন। মথি, মার্ক, লুক ও যোহন কর্তৃক লিখিত চারখানি গ্রন্থকে তারা Canonical Bible হিসেবে মর্যাদা দিয়ে, বাইবেল নিউ টেস্টামেন্ট (যা বাংলা ভাষায় বাইবেল নতুন নিয়ম) নামে গ্রহণ করেন যা ‘আসমানি কিতাব ইঞ্জিলের সংস্করণ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
‘আসমানি কিতাবগুলোর ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্ব নবী সা: এবং ওই কিতাবগুলোর হস্তক্ষেপের তথ্যপ্রমাণ’ নামে ২০১৪ সালে একুশে বইমেলায় আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এই বইয়ের পরবর্তী গবেষণাধর্মী লেখা হিসেবে ‘বার্নাবাসের বাইবেল ও কুরআন কারিমে একত্ববাদ’ শিরোনামে লেখা প্রকাশের তাকিদ অনুভব করি। এই প্রবন্ধটি এরই একটি অংশ। আমার লেখার উদ্দেশ্য, আসমানি কিতাবগুলোর অভিন্নতা ও সাযুজ্য বের করা, একই সাথে এই কিতাবের ধারক ও বাহক হিসেবে মুহাম্মদ সা: এবং ঈসা আ:-যাকে খ্রিষ্টান জাতি ঈশ্বরত্বের অভিধায় অভিহিত করে উপাসনা করে থাকেন, তাদের সত্য ও সঠিক পরিচয় আসমানি কিতাবগুলোর তথ্যের মাধ্যমে নিজে জানা এবং অন্যদের জানানো। এখানে নবীদের ভবিষ্যদ্বাণীর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বের বুকে সর্বশেষ নাজিলকৃত আসমানি কিতাব পবিত্র আল কুরআন।
এই কুরআনই সেই কিতাব যা অনুসারীদের প্রতি এই নির্দেশ দিচ্ছে যে, মহামহিম আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত সব নবী-রাসূলের প্রতি এই ঈমান বা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, মুহাম্মদ সা: এবং আল কুরআন যে মহান সত্তার পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছে, সেই মহান সত্তাই সব আসমানি কিতাব ও নবী-রাসূলদের প্রেরণকারী। বলতে হবে, ‘আমরা কোনো রাসূলের মধ্যে পার্থক্য করি না’ (সূরা বাকারা)। একমাত্র বিশ্বধর্ম হচ্ছে ইসলাম এবং ইসলামই একমাত্র ধর্ম যার অনুসারীদের পরিচিতি সেই ধর্মের প্রবর্তকের নামে নয়, অথবা বিশেষ কোনো জনপদের নামেও নয়। বরং এই ধর্মের অনুসারীদের পরিচিতি হচ্ছে ‘মুসলিম’ তথা আত্মসমর্পণকারী এবং এই ধর্মের নাম ‘ইসলাম’ অর্থাৎ শান্তি। আত্মসমর্পণ অবশ্যই সেই সৃষ্টিকর্তার কাছে, যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং বিশ্ব মানবতার জন্য শান্তি হচ্ছে এই ধর্মের পরিচয়। সত্য-মিথ্যার একমাত্র মানদণ্ড পবিত্র আল কুরআন বা আল ফুরকান।
যে কিতাব মানুষে মানুষে বিভাজন মিটিয়ে দিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে বাঁচার এবং বিশ্বের মাঝে উন্নত মস্তকে দাঁড়ানোর অধিকার নিশ্চিত করেছে, সেই কিতাবই হতে পারে মানবজীবনের সব সমস্যার সমাধানকারী একমাত্র গাইডবুক এবং এই কিতাব তার পক্ষপুটে আশ্রয় নিতে আহ্বান জানায় বিশ্ব মানবতাকে। পবিত্র আল কুরআনের বাণী, ‘হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি একটি প্রাণ থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া এবং তাদের দু’জনার থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ ও নারী’ (সূরা : নিসা-১)।
পুরো বিশ্ব মানবতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বিধানের আওতাধীন। আমরা জানার চেষ্টা করব, বাইবেল বার্নাবাস আমাদের কাছে কোন তথ্য উপস্থাপন করছে?
বাইবেল বার্নাবাসের বাংলায় অনুবাদক, মরহুম কবি আফজাল চৌধুরীর ‘গ্রন্থ প্রসঙ্গ’ থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো, ‘ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের এবং কুরআন মজিদের উৎসুক পাঠকের জন্য সর্বোত্তম কথা এই নয় কি যে, ঈসা আ:-এর সাথী বার্নাবাসের বাইবেল দেড় হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর আবার জগতবাসীর সামনে প্রকাশিত হয়েছে?
পরাক্রান্ত খ্রিষ্টান যাজকতন্ত্র যে বইটিকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে গিয়ে এর প্রচার ও পঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, কিন্তু পোপের ফতোয়া ভেদ করে, যে বইটি পুনরায় মানুষের বিবেকের দুয়ারে উপস্থিত হয়ে তার সত্তায় বিস্ফোরণ তুলেছে, জ্ঞানচর্চার জগতে এর তুলনা পাওয়া কি সম্ভব? কিন্তু কে এই বার্নাবাস? ম্যাথু, লুক, যোহন ও মার্কের কোনো বাইবেলেই তো এই ভদ্রলোকের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে চতুর্থ অধ্যায়ের ১০ নম্বর শ্লোকে কলোসিয়ান্থদের প্রতি নিবন্ধে একজন বার্নাবাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। উনিই কি তিনি? হ্যাঁ, উনিই তিনি; কিন্তু তিনি কে? সন্ত পলের সহচর রূপে একজন বার্নাবাসকে আমরা জানি, কিন্তু...? এই ‘কিন্তু’ থেকেই আলোকোজ্জ্বল পথের সূচনা সম্ভব। ‘বাতিল গ্রন্থ’ রূপে এবার একে বিচার করার জন্য ম্যাথু, লুক, মার্ক, যোহনের পাশাপাশি বার্নাবাসের বিবরণও তো পড়তে হয়। Non Canonical Bible রূপে বার্নাবাসের যেটুকু প্রাপ্য, পাঠকের মনোযোগ ঠিক ততটুকুই দরকার? যদি এই বইয়ের নিজস্ব শক্তি কিছু না-ই থাকে, তবে এর পৃষ্ঠাগুলো উল্টানোর কী প্রয়োজন? ভিয়েনার ইমপিরিয়াল লাইব্রেরির প্রাচীন ইতালীয় পাণ্ডুলিপি থেকে অনুবাদ ও সম্পাদনা করে ‘দ্য গসপেল অব বার্নাবাস’ নামে ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ প্রণয়ন করেন লন্স ডেল ও লোরা র্যাগ নামক দুই পণ্ডিত ব্যক্তি। গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর খ্রিষ্টীয় ধর্মে মহা বির্তকের আশু সম্ভাবনা দেখে বইটির প্রায় সব কপিই বিনষ্ট করা হয়।
ইংল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থশালায় রক্ষিত একটি দুর্লভ কপি থেকে পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের দুনিয়াব্যাপী প্রচার ও প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে একটি মুসলিম দাতা প্রতিষ্ঠান। ফলে বার্নাবাসের গসপেল গ্রন্থ হিসেবে আজ জগতবাসীর কাছে প্রতিভাত’ (আফজাল চৌধুরী)।
বার্নাবাসের বাইবেলের অনুবাদক মরহুম আফজাল চৌধুরী, তার প্রসঙ্গ কথায়, কলোসিয়ান্থদের প্রতি, বাইবেল নতুন নিয়মের প্রেরিতদের পত্রাবলির চতুর্থ অধ্যায়ের দশম শ্লোকে একজন বার্নাবাসের নামের উল্লেখ আছে বলে লিখেছেন। ম্যাথু, লুক, মার্ক, যোহন এই চারজনের লিখিত মূল চারটি গসপেলে বার্নাবাসের উল্লেখ নেই। কিন্তু প্রেরিতদের পত্রাবলির প্রথমে, প্রেরিতদের কার্যাবলিতে বার্নাবাসের নাম বারবার এসেছে। এখানে সেই তথ্যগুলো তুলে ধরছি। প্রেরিত অধ্যায় : ১১, এন্টিওকে জামাত শ্লোক-২২, হজরত বার্নাবাস ও শৌলের তবলিগ যাত্রা অধ্যায় : ১৩, শ্লোক-১, সাইপ্রাস দ্বীপে : শ্লোক-১, ২৪, অধ্যায় : ১৫, শ্লোক-১, ১২। প্রেরিতদের কার্যাবলিতে বার্নাবাসের নাম বহু জায়গায় ছড়িয়ে আছে।