চীন-পাকিস্তানের সিপিইসি কি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর?
চীন-পাকিস্তানের সিপিইসি কি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর? - ছবি : সংগ্রহ
চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি তীব্র সমালোচনা করেছে। এতে কেবল চীন-মার্কিন সম্পর্কের সমস্যাটাই ফুটে ওঠেনি, বরং পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টার বিষয়টিও উঠে এসেছে। আর এই প্রচেষ্টার বিষয়টি শুধু পাকিস্তানের সিপিইসিকে অংশগ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এমনকি ইউরোপেও বিষয়টি ছড়িয়ে আছে।
তবে, সিপিইসির বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটার মাধ্যমে চীনের মূল ভূখণ্ডের সাথে ইরান হয়ে মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপের সংযোগ ঘটছে। সে কারণেই মনোযোগটা এখানে বেশি।
অন্যভাবে বললে, এটা শুধু সিপিইসি এবং বেল্ট অ্যাণ্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) ভূ-অর্থনীতি নয়, বরং ভূ-রাজনীতিও এখানে জড়িত। আর সেটাই যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বহু ঐতিহ্যগত প্রভাবের জায়গাটিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে চীন, এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ও আর্থিক সিস্টেমের বলয় থেকে বেশ কিছু দেশকে ভাগিয়েও নিয়ে গেছে তারা।
পাকিস্তানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার মাধ্যমে আইএমএফ আর সিপিইসির মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টিও উঠে এসেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো সামরিক মিত্র আর চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তানকে এই দুই দেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার যে কসরত করতে হচ্ছে, সেটিও উঠে এসেছে এখানে।
পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ যদিও তাৎক্ষণিক সিপিইসির সমালোচনার জবাব দিয়েছে। আর মার্কিন সমালোচনাকে এই প্রকল্পের ব্যাপারে ‘যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহ’ হিসেবে মন্তব্য করেছে চীনারা। তবে তাৎক্ষণিক এই কূটনৈতিক বাকবিতণ্ডার কারণ হলো সম্প্রতি সিপিইসি রুট দিয়ে চীন থেকে আফগানিস্তানে পণ্য পরিবহন শুরু হয়েছে। এই পরিবহনের সাথে চীনের তৈরি এবং চীন কর্তৃক পরিচালিত পাকিস্তানী বন্দর গোয়াদার এবং বালুচিস্তানের সিপিইসি সড়কগুলো জড়িত, যেটা চামান সীমান্ত দিয়ে চীন আর আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করেছে।
অন্যভাবে বললে, সিপিইসি দিয়ে আফগানিস্তানে পণ্য পরিবহন সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে চীন প্রবলভাবে এ অঞ্চলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সরে গেলে এই প্রক্রিয়া আরও বাড়বে, চীন ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো এই শূণ্যস্থানটা দখল করবে এবং আফগানিস্তানকে পুরোপুরি সিপিইসি ও বিআরআইয়ের সাথে যুক্ত করবে – এই চিন্তাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে।
অন্যভাবে বললে, আফগানিস্তানে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়ে গেলে এটা শুধু মার্কিন যুগের সমাপ্তিরই সূচনা করবে না, বরং এতে নতুন আঞ্চলিক সংযোগ কর্মসূচি যুগেরও সূচনা হবে, যেখানে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা দেখানোর সুযোগ থাকবে খুবই সীমিত – চীন আর রাশিয়ার তৎপরতা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে, গোয়াদার বন্দর সক্রিয় হওয়ার মধ্য দিয়ে এবং আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শুধু আফগানিস্তান নয়, বরং পাকিস্তানেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস পাবে। পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটা (যেটা সাউথ এশিয়ান মনিটরে অন্য একটি লেখায় আমি উল্লেখ করেছিলাম) আফগান যুদ্ধকেন্দ্রিক সীমিত হয়ে আছে এবং সময়ের সাথে সাথে সেটার পরিবর্তন হয়নি।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে এই সম্ভাবনাটা খুবই কম যে, যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে যাবে। ২০০১ সাল থেকে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটা যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, আগামী দশকেও সেটা অনেকটা একই রকম থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু ক্রমেই ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের দিকে তাদের মনোযোগ বাড়াচ্ছে, সেখানে পাকিস্তান নয়, বরং ভারতই মার্কিন নীতিতে আরও জোরালোভাবে উঠে আসবে। পাকিস্তান সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই সিপিইসি আর বিআরআই প্রকল্পগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ থাকবে এবং এখনই সময় যাতে পাকিস্তান সিপিইসি প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়, কারণ ২০১৮ সালের জুলাইয়ের নির্বাচনের পর থেকে প্রায় এক বছর এই কাজ অনেকটা থমকে আছে।
এরই প্রেক্ষাপটে ১৪ জানুয়ারি কসকো শিপিং লাইনস বহরের কার্গো জাহাজ দিয়ালা আফগানিস্তান-পাকিস্তান ট্রানজিট ট্রেড এগ্রিমেন্টের অধীনে দুটো কন্টেইটার খালি করেছে। রাসায়নিক সারের এই কার্গো এরপর উত্তর বালুচিস্তানের চামান সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে গোয়াদার বন্দর থেকে আফগানিস্তানে নেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মনোবেদনার আরেকটি কারণ হলো সিপিইসি আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলে যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উপর থেকে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক নির্ভরতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে, এবং সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবও সেখানে হ্রাস পাবে।
প্রকল্পের বিস্তারিত যদিও এখনও প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু আফগানিস্তান সিপিইসি থেকে দুটো সুনির্দিষ্ট রুটের ব্যাপক সুবিধা পাবে: একটি হলো তোরখাম থেকে জালালাবাদ, এবং অন্যটি চামান থেকে কান্দাহার পর্যন্ত রুট। সিপিইসির সাথে যুক্ত হলে আফগানিস্তান অনেক সস্তা এবং সহজ রুটের মাধ্যমে গোয়াদার বন্দরের সাথে যুক্ত হতে পারবে, যেটা ভারত মহাসাগরে এবং আরও দূর-দূরান্তে তাদের প্রবেশাধিকার সহজ করে দেবে।
একই সাথে সিপিইসির সাথে যুক্ত হলে এবং যুক্তরাষ্ট্র-আফগান যুদ্ধের ইতি ঘটলে পাকিস্তান আর আফগানিস্তান তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনরায় ঢেলে সাজাতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্র যখন ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের দিকে ক্রমেই মনোযোগ বাড়াচ্ছে এবং ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত ২+২ সংলাপ চলছে, এ রকম একটা পরিস্থিতিতে এটা আরও বেশি হবে। ফলে ভারত নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরও গভীরভাবে সংযুক্ত করতে পারবে। আফগানিস্তান থেকে ভারতের মনোযোগ সরে যাবে, এবং আফগানিস্তান সিপিইসির সাথে যুক্ত হলে তারা সরাসরি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সাথে এমনভাবে যুক্ত হবে যেখানে আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব এবং আফগান মাটিতে পাকিস্তান-বিরোধী তৎপরতা হ্রাস পাবে।
সিপিইসির কারণে নিশ্চিতভাবে পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের পরস্পরের উপর নির্ভরতা বেড়ে গেলে আফগানিস্তানের ভারত-পন্থী ব্যক্তিরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটানোর ব্যাপারে আরও বেশি সতর্ক হয়ে যাবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতের কারণেই আফগানিস্তানে যখন যুদ্ধ চলছিল এবং যখন যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান আলোচনা এবং আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না, তখন সিপিইসির ভূ-রাজনীতি যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সম্ভাব্য এই প্রস্থানের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক চিত্র ব্যাপকভাবে বদলে যাবে, এবং এর সাথে সাথে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের সমীকরণটাও বদলে যাবে। আফগানিস্তানে ও এর বাইরেও চীনের প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ঠেকাতে পারবে না। এটা থেকেই বোঝা যায় যে, সিপিইসি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন এত উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে।