তেরঙ্গা হিজাবে মুসলিম নারীর প্রতিরোধ
তেরঙ্গা হিজাবে মুসলিম নারীর প্রতিরোধ - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লির শাহিন বাগের কাছে একটি মহাসড়ক সাইনবোর্ডে তেরঙা ভারতীয় পতাকাকে হিজাব হিসেবে ব্যবহারকারী এক নারীর বিশাল পোস্টার শোভা পাচ্ছে। পোস্টারে নারীটিকে নির্দেশ দিতে দেখা যাচ্ছে, ‘কথা বলুন, আপনার ঠোঁট স্বাধীন।‘
ওই নারী কাছের একটি মেট্রো পিলারে আবার আত্মপ্রকাশ করেছেন, এছাড়া শাহিন বাগ ও ভারতজুড়ে বিক্ষোভকারীদের হাতে হাতেও তাকে দেখা যাচ্ছে।
ছয় সপ্তাহ ধরে সারা ভারতে বিক্ষোভকারীরা বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমে এসেছে। তাতে মতে এই আইনে ভারতের নাগরিকত্ব পেতে ধর্মকে ব্যবহার করার সময় মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা হয়েছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার বলছে, প্রতিবেশী তিন দেশের নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের সহায়তা করার জন্য এই আইন করা হয়েছে। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, এটি দেশের সেক্যুলার সংবিধানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মুসলিম, দলিত ও অন্যান্য প্রান্তিক গ্রুপগুলো বিশেষভাবে ভয় পাচ্ছে যে পরিকল্পিত দেশব্যাপী নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তাদেরকে রাষ্ট্রহীন করে ফেলতে পারে। গত বছর আসামে একই ধরনের প্রক্রিয়ায় প্রায় ২০ লাখ লোক নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
গণতন্ত্র উদযাপন
নয়া দিল্লির শাহিনবাগ ও অন্যান্য স্থানে বিক্ষোভকারীরা ছবি দিয়ে পাবলিক স্পেসগুলো ভরে ফেলেছে।
বিজ্ঞাপন পেশায় নিয়োজিত তানজিলার মতে, আর্ট আপনার প্রতিরোধ ও অটল থাকতে সহায়তা করে। তিনিই তেরঙা হিজাবে আবৃত নারী আইকন ইমেজের নেপথ্যের শিল্পী। তানজিলা ক্রোধ থেকেই উদ্দীপনা পেয়ে থাকেন। আমার ক্ষোভ অনেক দিক দিয়েই প্রকাশিত হয়।
আত্ম-প্রকাশের আকারে তানজিলা তার ইনস্টাগ্রাম পেজে ছবিটি পোস্ট করেছিলেন। তখন মনেই হয়নি যে আমার শিল্পকর্ম গোটা দেশে এভাবে ছড়িয়ে পড়বে।
তানজিলার মতে, ইলাস্ট্রেশনটি তার পরিচিতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এতে তেরঙ্গা হিজাবে এক ভারতীয় মুসলিম নারীকে আঁকা হয়েছে। ওই নারী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের (তার উর্দু কবিতা হুম দেখেঙ্গে) কথাই চিৎকার করে বলছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে পাকিস্তানি মার্কসবাদী এই লেখকই পরিণতি হয়েছেন প্রতিবাদের সবচেয়ে বড় ভাষা।
অভিজ্ঞ ডিজাইনার অনির্বান ঘোষ বলেন, প্রতিবাদ হিসেবে যেটা শুরু হয়েছিল, সেটি এখন গণতন্ত্র যেভাবে উদযাপিত হতে পারে, ভিন্নমত কেমন হতে পারে, সেটিতেই পরিণত হযেছে।
শাহিন বাগ ঘুরে ঘোষ উদ্দীপ্ত হয়েছেন সেখানে নেতৃত্বে থাকা নারীদের ইলাস্ট্রেশন সৃষ্টিতে। মোমবাতি আর ভারতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ঘোষের শিল্পকর্মের নারীরা তাদের মুষ্টি তুলে ধরেছেন।
কলকাতাভিত্তিক ঘোষ বলেন, এধরনের প্রতিবাদ সাম্প্রতিক সম্পর্কে অন্য কোথাও দেখা যায়নি। এখানে বিপুল আয়োজনে গান্ধীবাদী অহিংস দর্শনের প্রদর্শন চলছে।
শাহিন বাগের আগে ঘোষের ইলাস্ট্রেশন কখনো রাজনৈতিক ছিল না। তিনি বরেন, সবকিছুরই প্রবেশপথ আছে। তার শিল্প এখন শাহিন বাগের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে।
সংহতির হাতিয়ার শিল্পকলা
লামিয়া খানের বয়স ২১ বছর। তি স্বশিক্ষিত গ্রাফিক ডিজাইনার। নীরব থাকাটা তার কাছে এখন আর কোনো বিকল্প নয়। এই আইনই আমাকে পথে নামিয়েছে। তিনি বলেন, শিল্পের মাধ্যমেই আমি নিজেকে প্রকাশ করতে পারি। আমি অনেক বেশি সময় নীরব ছিলাম। সুস্পষ্টভাবে বিভাজিত এই আইনের পর আর বসে থাকতে পারি না।
লামিয়ার একটি ইলাস্ট্রেশনে তিন নারীকে মুষ্টি তুলে ধরতে দেখা যায়। এতে বিক্ষোভে নারীদের দৃঢ়তাই ফুটে ওঠেছে।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে মুসলিম নারীরা দুর্বল, তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অনুমতি পায় না। হিজাবধারী নারীদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে সত্যি। শাহিন বাগ বিক্ষোভ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, এসব নারী কেবল নিজের ওজনই বহন করাই নয়, নেতৃত্বও দিতে পারে, সেক্যুলার প্লাটফর্মের ব্যবস্থা করতে পারে।
লামিয়া মনে করেন, এটি প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এতে অনেক বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়।
নতুন মিডিয়া আর্টিস্ট আক্ষাত নুরিয়াল বলেন, শিল্পকলা হলো সংহতির খুবই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তিনি একটি ইনস্টাগ্রাম ফিল্টার সৃষ্টি করেছেন সিএএর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে তুলে ধরতে। দুই দিনের মধ্য ফিল্টারে ৮০ হাজার ছবিতে ভরে গেছে।
আন্দোলনকে কিভাবে সামাজিক মাধ্যমের প্লাটফর্মে ব্যবহার করা যায়, সে চেষ্টাতেই তিনি মনোযোগ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, অনলাইন ও অফলাইন বিক্ষোভের মধ্যে একটি সমন্বয় থাকা দরকার।
শাহিন বাগে ৪০ ফুট (১২ মিটার) উঁচু একটি প্লাটফর্ম বানানো হয়েছে। তাতে ভারতের মানচিত্রে এর আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা কী চায়, তাই এখানে বলা হয়েছে। এটি তৈরী করতে সময় লেগেছে আট দিন। স্থানীয় লোকজন লোহাসহ নানা কিছু দান করে সহায়তা করেছে বলে এর কারিগক কুমার জানান।
প্রতিরোধকে সম্মান জানান কিংবা প্রতিরোধ প্রত্যাশা করুন
শিল্পী গার্গি চানদোলা শিল্পসমাজের সচেতন প্রয়াস হিসেবে এই আন্দোলনকে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, নীরব জনগোষ্ঠীকে আন্দোলনে যোগ দিতে উস্কে দেয়ার একটি মাধ্যম হলো শিল্পকলা।
তিনি বলেন, যেকোনো স্বৈরশাসনকে প্রতিরোধ করার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হলো শিল্পকলা। তিনি সামাজিক মাধ্যম যোগে দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শিল্পদের সমবেত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। গত মাসে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিক্ষোভে পুলিশের নৃশংস দমন অভিযানের পর তারা একত্রিত হন।
তানজিলা আশা করছেন, তার শিল্পকলা ভীতির চক্রকে গুঁড়িয়ে দেবে, ভবিষ্যতের প্রজন্মকে নিজেদের প্রকাশে সহায়ক হবে। এখন থেকে ১০ বছর পর একটি প্রজন্ম যাতে কোনো ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় না থাকে, তা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শাহিনবাগেতেরঙা হিজাবি নারীল পাশে তানজিলার সাইনবোড ছবির পাশেই আরেকটি ছোট পোস্টার আছে। তাতে লেখা আছে : ‘প্রতিরোধকে সম্মান জানান কিংবা প্রতিরোধ প্রত্যাশা করুন।‘
আল জাজিরা