ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা : আড়ালের ছলচাতুরি
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা : আড়ালের ছলচাতুরি - ছবি : সংগৃহীত
ট্রাম্প প্রশাসনের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও কুখ্যাত শান্তি পরিকল্পনাটির অনেক লক্ষ্য থাকলেও শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্দেশ্য এর মধ্যে নেই।
এতে না আছে জোরালো আলোচনার উদ্যোগ, না আছে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য পক্ষগুলোকে রাজি করানোর চেষ্টা কিংবা অন্তর্নিহিত কোনো তাৎপর্যও নেই যাতে করে আশাবাদ সৃষ্টি হতে পারে যে ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিরা একান্তে কোনো সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করবে।
আর প্রস্তাবটি এমন দিনে দেয়া হয়েছে, যেদিন ইসরাইলি পার্লামেন্টে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দায়মুক্তি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটি হওয়ার কথা এবং এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আবার পরিকল্পনাটিতে সাজ সাজ রব থাকলেও বাস্তবে একেবারেই গতানুগতিক।
গতানুগতিক কারণের কথাই প্রথমে বলা যাক। এখন থেকে ছয় সপ্তাহ পর অনুষ্ঠেয় ইসরাইলি নির্বাচনে নেতানিয়াহুকে সহায়তা করার জন্য ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এটি যে একটি প্রয়াস, সে ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে সামান্যই। আবার এটি খোদ ট্রাম্পকেও সহায়তা করবে। তিনি এর মাধ্যমে ইভাজেলিক্যাল ও রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের সমর্থন পাবেন তার পুনর্নির্বাচনে জয়যুক্ত হওয়ার জন্য।
সমালোচকেরা যুক্তি দেন যে প্রশাসনের উচিত ছিল আগামী মার্চে অনুষ্ঠেয় ইসরাইলি নির্বাচনের ফলাফল ও নতুন সরকার গঠনের জন্য অপেক্ষা করা। তবে তাতে ঝুঁকিও ছিল। কারণ নির্বাচনী ফলাফল যদি ফয়সালাসূচক না হয়, তবে আবার নির্বাচন হতে পারে। সেক্ষেত্রে এটি আর কখনোই প্রকাশিত না হওয়ার ঝুঁকি থাকত। অধিকন্তু, এই পরিকল্পনা প্রকাশের ফলে ইমপিচমেন্টের ওপর থেকে দৃষ্টি বেশ সরে গেছে। এখন এখন প্রেসিডেন্ট দাবি করতে পারেন যে তিনি তিনি যখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত, তখন ডেমোক্র্যাটরা মুর্খতার রাজনীতিতে ব্যস্ত।
তবে পরিকল্পনাটি নেতানিয়াহু বা ট্রাম্পকে সহায়তা করবে কিনা তা অস্পষ্ট। তবে ট্রাম্পের দল মনে করে, এটি তাকে ও নেতানিয়াহু উভয়ের জন্যই ফলপ্রসূ হবে। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারে, এই প্রস্তাবে তো ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি দেশের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব বিষয় হলো, তেমন কিছু হতে হলে ফিলিস্তিনিদের অবাস্তব অনেক শর্ত পূরণ করতে হবে। আবার তা করার পরও এই অনুমিত রাষ্ট্রটি হবে ভঙ্গুর, অসংলগ্ন ও ইসরাইল দিয়ে ঘেরাও হওয়া, ইসরাইলি নিরাপত্তার ওপর নির্ভরশীল। এটি কার্যত হবে নামেমাত্র রাষ্ট্র। কেউ হয়তো বলতে পারেন যে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী হিসেবে পাবে। কিন্তু আসল কথা হলো, এটি নগরীর অংশবিশেষ হলেও পরিকল্পনায় এর এমন তুচ্ছ অংশ দেয়ার কথা বলা হয়েছে যার বলে বেশির ভাগ লোক একে জেরুসালেম বলেই চিনতে পারবে না। তাত্ত্বিকভাবে, কট্টরপন্থী ইসরাইলিরাও প্রতিবাদ জানাতে পারে এই যুক্তিতে যে বছরের পর বছর ধরে নতুন নতুন বসতি স্থাপন চলছি, তা আর থাকছে না। কিন্তু ওই আশঙ্কাও অমূলক। কারণ পরিকল্পনায় উদারভাবে পুরো পশ্চিম তীরই ইসরাইলকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা সেখানে নতুন নতুন বসতি দিয়ে ভাসিয়ে দিতে পারবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, এই পরিকল্পনায় ইসরাইল যা যা চেয়েছিল, তার সবই দিয়ে দেয়া হয়েছে। আর ফিলিস্তিনিদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে, যার কোনোই মূল্য নেই ইসরাইলিদের কাছে। ফিলিস্তিনিদের কিনে নিতে ৫০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে তাও কোনো দিন দিনের আলো দেখবে কিনা সন্দেহ আছে। আর এটাকেই বলা হয়েছে শান্তি প্রস্তাব।
ফলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই প্রস্তাবের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর নির্বাচনী সম্ভাবনা বাড়ানো। তবে এর কি কোনো বৃহত্তর তাৎপর্য রয়েছে? থাকলেও এত দ্রুত নেই।
ট্রাম্প প্রশাসন যে ধারণাটি সামনে এনেছে, সেটি ভবিষ্যত মধ্যপ্রাচ্য শান্তির ব্যাপারে তেমন কিছু বলেনি। যে পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে, তাতে বলা যায় যে দুই রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং পশ্চিম তীর ইসরাইলের দখলে যাওয়া বাস্তব বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইসরাইলিরা মোটামুটিভাবে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে নেবে। ফিলিস্তিনিরা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করবে। আবর রাষ্ট্রগুলো একদিকে চাইবে না প্রস্তাবটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ক্ষ্যাপাতে (তার তার প্রতিশোধের আশঙ্কায় তারা ভীত) অন্যদিকে তারা জনমতকেও ভয় করে বলে তাদেরও ক্রুদ্ধ করতে চাইবে না। তবে ট্রাম্প তার সহজাতভাবেই ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি আরো আগ্রাসীভাবে মুছে ফেলে নতুন কিছু চাপিয়ে দেয়ার নীতিই এখানে অবলম্বন করেছেন মাত্র।
এ ব্যাপারে কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার প্রসঙ্গও আসতে পারে। ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিয়ে ইসরাইলি-ফিলস্তিনি শান্তি নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে সোলাইমানিকে হত্যার পর। এখন ট্রাম্প প্রশাসন পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছে। তারা এখন কোনো প্রত্যাঘাতের শঙ্কা ছাড়াই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়া হলে আরব ও মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সোলাইমানিকে হত্যা করা হলে ইরানিরাপ বিপজ্জনক প্রতিশোধ নিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। ৩০টি ইরানি ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হলেও একজন আমেরিকানও নিহত হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের দর বলতেই পারে, যেসব হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল, সবই ফালতু ছিল।
এখন ট্রাম্প প্রশাসন বলতে পারে, তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। কিন্তু তারপরও কথা থাকে। সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কথাই বলা যাক। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রে আমেরিকান কেউ নিহত হয়নি সত্য, কিন্তু এসব ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবও কিন্তু আমেরিকা দেয়নি। আগে কখনো কি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল? তেহরান বা এর সমর্থক নানা গ্রুপ কিন্তু বলেনি যে তারা শেষ কথা বলে ফেলেছে। বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ কিন্তু সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আসলে ট্রাম্প প্রশাসন ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো ভাবছে, শক্তি যদি প্রয়োগ করা না হয় তবে তা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সবাইকে নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাবনা অতীতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চেষ্টা করা হয়েছিল, তা আর নেই। বরং ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার ফলে অনেক সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে। তার একটি হলো ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি শান্তির সম্ভাবনা।
পলিটিকো