নির্বাচন, আর মাত্র কয়েক ঘন্টা
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা - ছবি : সংগ্রহ
আর মাত্র এক দিন পরেই ভোট। সার্বিকভাবে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের অনীহা তৈরী হলেও এই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা, জনসংযোগ, দলগুলোর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা, গণমাধ্যমের প্রতি দিনকার রিপোর্ট অন্তত এ কথাটি প্রতিনিয়তই আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে সামনে ভোট। এবং যেহেতু এটি রাজধানী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, যেখানে ১৫ টি সংসদীয় আসন আছে, সেহেতু জাতীয় নির্বাচনের সমান না হলেও এর গুরুত্বও কম নয়।
যেকোনো নির্বাচন আসলেই প্রথম যে কথাটি আলোচনায় আসে, তা হলো লেভেল প্লেইং ফিল্ড অর্থাৎ পক্ষগুলো নির্বাচনে সমান সুযোগ পাচ্ছে কিনা। এই নির্বাচনটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই নির্বাচনেই জাতি প্রথমবারের মতো দেখলো নির্বাচন কমিশনের ভেতরেই লেভেল প্লেইং ফিল্ড নেই। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার উপায়ন্ত না দেখে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন নির্বাচন কমিশনে আমার প্রস্তাব বা সুপারিশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অগৃহীত হয়। তিনি আহ্বান জানান সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসেবে না দেখে তার বক্তব্যের বিষয়বস্তুর মেরিটকে বিবেচনায় নেয়া হোক। তিনি আরো বলেন, সভায় তার বক্তব্য প্রদানের স্থান সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এবং কমিশনের অভ্যন্তরেই ন্যুনতম কোনো লেভেল প্লেইং ফিল্ড নাই। যেভাবে দায়িত্ব পালন করা দরকার তা হচ্ছে না।
তার এই সংবাদ সন্মেলন থেকেই আমরা জানতে পারি নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পর থেকেই ২৭ তারিখ পর্যন্ত যে তিনটি সভা অনুষ্ঠিত হয় তার কোনোটিতেই প্রার্থীদের আচরণবিধি, অনিয়ম বা অভিযোগ সম্পর্কে কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি কোনো কমিশন সভায় এসব বিষয় এজেন্ডাভুক্তও করা হয়নি। আশ্চর্যের বিষয় হলো নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে গত ২৮ জানুয়ারি যে নির্বাচন কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতেও সিটি নির্বাচন সম্পর্কে কোন বিষয় এজেন্ডাভুক্ত ছিলো না। একজন কমিশনার হিসেবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় গত ৯, ১৩, ১৬ ও ২০ তারিখে যে চারটি ইউ ও নোট তিনি দিয়েছিলেন সেগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া দূরেই থাকুক এই সম্পর্কে কোনো আলোচনা পর্যন্ত হয়নি। তিনি ইউ ও নোটের মাধ্যমে কমিশনের সিনিয়র সচিব এবং দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থীদের অভিযোগ সম্পর্কে তথ্যাদি এবং সে অভিযোগের বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাও জানতে চেয়েছিলেন যার কোনোটিই তাকে সরবরাহ করা হয়নি। জনাব মাহবুব তালুকদারের অভিযোগের জবাবে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব যে কথাটি বলেছেন তা সর্ব মহলে বিষ্ময়ের জন্ম দিয়েছে। তার মতে একজন কমিশনার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে কোনো তথ্য চাইলে তিনি তা দিতে বাধ্য নন। অথচ সচিব হচ্ছেন নির্বাচন কমিশনারের অধীনস্ত একজন কর্মকর্তা। চারপাশে আমলাতন্ত্রের যে জয় জয়কার এবং সর্বত্র সরকারের আমলা নির্ভরতা তাতে একজন সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তি রিটার্নিং কর্মকর্তা বা সচিব কর্তৃক অবহেলার শিকার হবেন তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই।
স্বাভাবিকভাবেই একজন নির্বাচন কমিশনারের স্পষ্ট কথন সরকার দলের কর্তাব্যক্তিদের ভাল লাগেনি। যে কারণে এর পর পরই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রশ্ন তুলেছেন, ঘরের কথা বাইরে কেন? তিনি আরো যে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন তা হলো ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সরকারের সম্পূর্ন হস্তক্ষেপবিহীন এবং নিরপেক্ষ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে। তার ভাষ্যমতে প্রধানমন্ত্রী সরকারের সকল সংস্থার প্রধানদের বলেছেন তিনি এই নির্বাচনে কোনো ধরণের হস্তক্ষেপ বা বাড়াবাড়ি চান না। মজার বিষয় হচ্ছে রাতের অন্ধকারে ব্যালট বাক্স ভর্তি করতে করতে আমরা ভুলতে বসেছি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এক্তি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনই যথেষ্ট। এর জন্য কোনো এজেন্সিকে নির্দেশনা দেবার একটাই অর্থ দাঁড়ায়, আর তা হলো এই সংস্থাগুলো নির্ধারণ করে নির্বাচনটি কেমন হবে।
এই নির্বাচনে অসংখ্য আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, রাস্তা দখল করে নির্বাচনী কার্যালয় স্থাপন, এক ওয়ার্ডে একটির বেশি মাইক বাজানো, নির্ধারিত সময়ের পর উচ্চস্বরে মাইক বাজানো, দেয়ালে পোস্টার লাগানো, বিধি ভঙ্গ করে পোস্টার ছাপানো, পোস্টারে নিয়মের অতিরিক্ত ছবি ব্যবহার, প্রতিপক্ষের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, পরিবেশ দূষণকারী পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার লাগানো, প্রতিপক্ষের মাইক ভাঙা, মোটর সাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহনের শোডাউন, মিছিল, পথসভা করে যানজট সৃষ্টি, প্রচারনায় সাউন্ড বক্স ব্যবহার সহ আরো অসংখ্য অভিযোগ এলেও সেটা নিয়ে কোনো ধরণের কোনো ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনকে নিতে দেখা যায়নি, যদিও আচরণবিধি অমান্য করলে ৬ মাস কারাদণ্ড ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডেরই বিধান আছে। উল্টো ইশরাকের প্রচারণায় হামলা হবার পরে যখন এক পুলিশ কর্মকর্তা ‘আমাদের পার্টি’ বলে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন তখন তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন খোদ নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা ‘আমাদের পার্টি’ বলতে পুলিশ বাহিনীকে বুঝিয়েছেন। কী ধরণের নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা উপরিল্লিখিত কয়েকটি ঘটনাতেই স্পষ্ট।
এই নির্বাচনের শুরুতেই আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী আমির হসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদকে নির্বাচনী সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অথচ নির্বাচনী আইনে স্পষ্টই বলা আছে মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারণা কিংবা কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না। এই বিষয়ে প্রশ্ন তুললে দু’জনেই সংসদে স্পষ্টভাবে বলেন, বিএনপির সাবেক মন্ত্রীরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারলে তারা কেন নিতে পারবেন না। তাদের বিনীতভাবে মনে করিয়ে দেই তাদের সরকারের সময় তৈরি করা বিধিমালায় সাবেক এমপি বা মন্ত্রীদের প্রচারণায় কোনো বাধা রাখা হয়নি।
দু’দিন আগেই একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকে হেডলাইন হয়েছে আওয়ামী লীগের ভাবনায় শুধুই জয়। সেই রিপোর্টে এই কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে এসেছে, পরাজয়ের কথা ভাবছে না ক্ষমতাসীন দল। তাদের মতে গত জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারের প্রায় সব নির্বাচনে মাঠ পুরোপুরি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। এমনকি এক দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন “গত জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফলে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয়ই স্বাভাবিক ব্যাপার। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হারতে পারেন, এমন কথা দলের নেতা কর্মীরা এখন ভাবতেই চান না”। তাদের এই কথাতেই এটা স্পষ্ট, যেকোনো মূল্যে জয় ছিনিয়ে আনার কথাই ভাবছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং নেতা-কর্মীরা।
ইতিমধ্যেই ‘কেন্দ্র দখল ও নিয়ন্ত্রণে’ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর একজন সদস্য। তিনি জানিয়েছেন ইতিমধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দক্ষিনের প্রার্থী শতকরা ৫৭ ভাগ সমর্থন পেয়ে এগিয়ে আছেন। আরও মজার তথ্য হলো, তার মতে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাও একই রকম রিপোর্ট দিয়েছে। তার এই বক্তব্য বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
১) কেন্দ্র দখল ও নিয়ন্ত্রণে বলতে তিনি আসলে কী বুঝিয়েছেন?
২) এই কেন্দ্র দখল ও নিয়ন্ত্রণে কারা থাকবে?
৩) কেন্দ্র দখল ও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তারাই ব্যালট বাক্স ভরার দায়ীত্ব নেবে নাকি ভোটাররাও কিঞ্চিৎ ভোট দিতে পারবে?
৪) রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাজ কি সরকারি দলের হয়ে নির্বাচনের আগে মাঠ জরিপ পরিচালনা করা?
৫) সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্তৃক উদ্ধৃত বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা কারা?
৬) কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে? এই একটি বাক্যই কি যথেষ্ট না বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে?
সরকারি জোট ছাড়া সকল বিরোধী দল ইভিএম এর বিপক্ষে বললেও আমরা দেখেছি নির্বাচনে সকল পক্ষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করার চেয়ে ইভিএম ব্যবহারে কমিশনের উৎসাহ অনেক বেশি। এমনকি যে কমিশন স্পষ্ট বলেছিল সকল দল না চাইলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না কিংবা বুথ দখল করে ইভিএম এ জালিয়াতি সম্ভব, তারাই এখন সকল অংশীজনের মত অগ্রাহ্য করে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তে অটল।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন “সিটি ভোটে হেরে গেলে সরকারের ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে না” অর্থাৎ জাতীয় ভোটে হারলে যেহেতু মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাই সেখানে যে কোনো উপায়ে নির্বাচনে জেতা যেতেই পারে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে নিয়ে জনাব কাদের যা বলেছেন, সেটা জাস্ট পলিটিক্যাল রেটোরিকের বেশি কিছু না, সেটা স্পষ্ট হয়েছে নির্বাচনি প্রচারনার প্রতিটি দিন। নির্বাচনটিকে আর কিছু ঘন্টার দূরত্বে রেখে যে পরিস্থতি দেখা যাচ্ছে তাতে ‘আকাশ না ভেঙে পড়ার’ এই নির্বাচনটিও সুষ্ঠু হতে দিতে সরকার রাজি নয়। এই দেশের রাজনীতির একজন কর্মী এবং পর্যবেক্ষক হিসাবে আমি দেখতে পাচ্ছি ১ ফেব্রুয়ারি আবার প্রমাণ হতে যাচ্ছে এই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা বলে কিছুর অস্তিত্ব আর নেই।
লেখক : সদস্য, জাতীয় সংসদ