টালমাটাল ইরাক

মুহাম্মদ খায়রুল বাশার | Jan 29, 2020 05:38 pm
টালমাটাল ইরাক

টালমাটাল ইরাক - ছবি : সংগ্রহ

 

ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানী বাগদাদে সম্প্রতি স্মরণকালের বৃহত্তম মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ করেছেন ইরাকের জনগণ। গত ২৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই বিক্ষোভে রাজধানী বাগদাদ মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠেছিল। ওই বিক্ষোভে বাগদাদের অধিবাসী ছাড়াও ইরাকের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে শিয়া, সুন্নি, কুর্দি ও আরব গোত্রগুলো অংশগ্রহণ করে। কয়েক দশকের মধ্যে এত বড় মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ ইরাকে আর দেখা যায়নি। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা ‘আমেরিকা ধ্বংস হোক’, ‘ইসরাইল ধ্বংস হোক’ ‘মার্কিন সৈন্যরা ইরাক থেকে এখনই বের হও’ প্রভৃতি স্লোগানে চার দিক মুখরিত করে তুলেছিল।

মার্কিন হামলায় ইরানের এলিট ফোর্স কুদস ব্রিগেডের প্রাণ ও শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি এবং ইরাকের পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিট (পিএমইউ) নামক আধাসামরিক বাহিনীর উপপ্রধান আবু মুহানদিস আল মাহদি নিহত হওয়ার কিছু দিন পর ইরাকে মার্কিনবিরোধী এই বৃহত্তম বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হলো। ইরান অনেক দিন ধরেই ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পর ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইরান সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে এবং আমেরিকান সৈন্যদের ইরাক ত্যাগে বাধ্য করতে এমন সর্বাত্মক বিক্ষোভের মাধ্যমে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপরতা শুরু করেছে। ইরাকের শিয়া নেতা মুকতাদা আল সদরও ইরাকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের দাবিতে ইরাকে বিক্ষোভের ডাক দেন। শিয়া ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা মুকতাদা আল সদরের প্রভাবও ইরাকে বেশ জোরালো।

অতি সম্প্রতি তার সমর্থকগোষ্ঠী তাকে দেশটির দ্বিতীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু ইরাকে তার রাজনৈতিক দলকে দুর্নীতির সহযোগী, অদক্ষ ও গোষ্ঠীগত রাজনীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে। বাগদাদের কোয়ালিশন সরকার আল সদরের দল থেকে দায়িত্ব পাওয়া স্বাস্থ্য ও পরিবহন মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইরাকে আগে থেকেই দুর্নীতিবাজ সরকার হটানোর এবং বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ হয়েছে। বিদেশী সেনা বলতে ইরাকিরা শুধু মার্কিন সৈন্য নয়- ইরানি সৈন্যদেরও ইরাক থেকে বিদায় করতে চায়।

কিন্তু ইরানিরা ইরাক থেকে সরাতে আগ্রহী নয়। সোলাইমানি হত্যার পর এখন ইরাকে ইরানিরা তাদের অবস্থানকে আরো পাকাপোক্ত করার ফন্দিফিকির করছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে- সরকারের দুর্নীতি এবং ইরাকের ওপর ইরানের প্রভাব কমানোর দাবিতে সাধারণ মানুষের চলমান বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে ইরান ইরাকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এটা ইরানের একটি কৌশল। তারা মনে করে, তাদের এই কৌশল কার্যকর হবে, কারণ ইরাকের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ হচ্ছে শিয়া মুসলমান। ইরান একটি শিয়াপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে ইরাকে তারা সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের পর ইরাকের পার্লামেন্ট ইরাক থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর জবাবে বলেছেন, ইরাক থেকে সরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই তাদের নেই। ট্রাম্প সেই সাথে আরো বলেছেন, ইরাক থেকে আমেরিকার সৈন্যদের চলে যেতে হলে দেশটির ওপর এমন অবরোধ আরোপ করা হবে যা ‘ইরাক আগে কখনো দেখেনি।’ মার্কিন সৈন্যরা ইরাকে ১৬ বছর ধরে অবস্থান করছে। তাই চাপ দিলে বা বিক্ষোভ দেখালেই আমেরিকান সৈন্যদের সহজে সরিয়ে নেয়া হবে বলে মনে হয় না।

ডিসেম্বর মাসে ইরান সমর্থিত কাতাইন হিজবুল্লাহ কিরকুকের একটি মার্কিন ঘাঁটিতে রকেট হামলা চালিয়ে একজন মার্কিন ঠিকাদারকে হত্যা করে। ওই হামলায় বেশ কয়েকজন মার্কিন ও ইরাকি সৈন্য আহত হয়। এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে পশ্চিম ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া ঘাঁটিগুলোতে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এরপর ৩ জানুয়ারি ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের সেনাবাহিনীর অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তা জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ও ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদিকে হত্যা করে। আমেরিকার এই আকস্মিক হত্যাকাণ্ডে ইরানসহ অন্যান্য সবাই হতবাক হয়ে যায়।

তেহরান ইরাকে তাদের অনুগত রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে ইরাক থেকে বিদেশী তথা মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের যে চাপ দিচ্ছিল তারই প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা এই পথ বেছে নেয়। অবশ্য এটা ট্রাম্পেরই সিদ্ধান্ত। ট্রাম্পের এই টার্গেট কিলিং আমেরিকার জনগণও সমর্থন করেনি। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গোটা আমেরিকা বিভক্ত হয়ে পড়ে। রিপাবলিকানরা ট্রাম্পকে সমর্থন করলেও ডেমোক্র্যাটসহ অন্যরা তার নিন্দা করে। দ্য সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের লন্ডনভিত্তিক বিশেষজ্ঞ দিনা এসফানদিয়ারি বলেছেন, ইরাক বৈধ উপায়ে ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার চায়। এ জন্য তারা এ ব্যাপারে ইরাকি পার্লামেন্টকে চাপ দিয়েছিল। কিন্তু তার দল যে এত ভয়ঙ্কর হবে তা হয়তো তারা কল্পনাও করতে পারেনি।

মার্কিন সৈন্যদের ২০১১ সালে ইরাক থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। এরপর ইরাকে উল্লেখযোগ্য মার্কিন সৈন্য উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু ২০১৪ সালে উগ্রপন্থী আইএসএর উত্থান ঘটলে আমেরিকান সৈন্যদের ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে আবার ইরাকে ফিরিয়ে আনা হয়। বর্তমানে ইরাকে প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ আমেরিকান সৈন্য আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকান সৈন্যদের প্রত্যাহার করা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও চিন্তাভাবনা করেই সেনা প্র্যাহারের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন। আইএসবিরোধী সামরিক জোটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত জেমস জেফ্রি বলেছেন, আমরা বারবার বলেছি- ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা ইরাকের সিদ্ধান্ত। ভবিষ্যতে ইরাকে মার্কিন ও জোট সৈন্যরা থাকবে কি না সে ব্যাপারে তাদেরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জেফ্রি দাবি করেছেন, ২০১৪ সালের যে চুক্তির আওতায় মার্কিন ও জোট সৈন্যরা ইরাকে অবস্থান করছে, তা ইরাকের সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত হয়েছে, পার্লামেন্টের সাথে নয়। এটা সরকারের সাথে সরকারের চুক্তি। এর ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে অবস্থান করছে। তবে ইরান যেভাবে ইরাকে মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভকে চাঙ্গা করে তুলেছে, তাতে সেখানে মার্কিন সৈন্যরা কত দিন অবস্থান করতে পারবে তা ভবিষ্যতের ওপরই নির্ভরশীল বলা যায়। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসে তিন দফা রকেট হামলা চালানো হয়েছে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us