বিপর্যয় নেমে এসেছে কাশ্মিরিদের ওপর
শিকারা - ছবি : সংগৃহীত
চলতি গ্রীস্মে কাশ্মিরে বিপুলসংখ্যায় পর্যটক না এলে ৫২ বছর বয়স্ক গোলাম জিলানি তার চাকরিটি হারাতে পারেন। শ্রীনগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত যে হোটেলে তিনি চাকরি করেন, সেটির ম্যানেজার তাদের কর্মীদের এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
গত ৫ আগস্ট ভারত সরকার কাশ্মিরের আধা-স্বায়াত্তশাসন মর্যাদা বাতিল এবং এরপর যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়ার করার পর থেকে কাশ্মিরে পর্যটক আসা কমে গেছে। ব্যাপক সৈন্যের উপস্থিতির মধ্যে নিরাপত্তা বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও প্রায় ছয় মাস পরও বন্ধ করে দেয়া ইন্টারনেট খুলে দেয়া হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের ১০ জানুয়ারির আদেশের পর সরকার ঘোষণা করেছিল যে কাশ্মিরের সকল জেলায় পোস্ট-পেইড মোবাইল ফোনের ২জি মোবাইল ডাটা আবার চালু করা হবে। কিন্তু সাদা তালিকায় থাকা কিছু এলাকায় তা চালু করা হলেও বিশাল এলাকায় তা মোটামুটিভাবে অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে।
২০১৯ সালের ৫ আগস্টের ঠিক এক দিন আগে জিলানির হোটেলটি (তিনি এর নামটি প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না) ছিল পুরোপুরি ভর্তি। এর ৮৮টি কক্ষের ৬৩টিই ছিল রিজার্ভ। আর কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার দিন বুকিং নেমে আসে তিনে এবং এখন পর্যন্ত ওই সংখ্যার চেয়ে তা বাড়েনি। জিলানি জানান, কোনো কোনো দিন তো একজন অতিথিও থাকে না।
২০১৮ সালে কাশ্মিরে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩১৬,৪৩৪ জন পর্যটক গ্রহণ করেছিল। ২০১৯ সালে একপর্যায়ে সংখ্যাটি নেমে আসে ৪৩,০৫৯ জনে। কমার হার ছিল ৮৬ ভাগ। ইন্ডিয়াস্পেন্ড যে তথ্য পেয়েছে, তাতে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে কাশ্মিরে পর্যটন এসেছিল ১৫২,৫২৫ জন। কিন্তু আগস্টে এসেছিল মাত্র ১০,১৩০ জন। তাদের বেশির ভাগই এসেছিল ওই মাসের প্রথম দিকে। এই সংখ্যাটি সেপ্টেম্বরে আরো হ্রাস পেয়ে হয় ৪,৫৬২ জন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ১২,০৮৬ জনে।
এক পর্যটন কর্মকর্তা বলেন, গুলমার্গে শীতকালীন গেমস উপলক্ষে পর্যটকের সংখ্যা সামান্য বেড়েছিল। গত ডিসেম্বরে সংখ্যাটি নেমে আসে ৬,৯৫৪ জনে।
সংখ্যার এমন পতন সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় পর্যটনমন্ত্রী প্রহ্লাদ সিং প্যাটেল বলেন, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যটির পর্যটনে কোনো প্রভাব পড়েনি। তিনি পার্লামেন্টে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, জম্মু ও কাশ্মিরে পর্যটক বাড়ছে। জম্মুতে বিষ্ণুদেবীর মন্দিরে তীর্থযাত্রী বেড়েছে।
যোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে থাকায় রাজ্যটিতে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। লোকজন ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারছে না, স্বাস্থ্য পরিচর্যা সুবিধা পাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, রাজ্যটির মোট জিডিপির ৭ ভাগ অবসান পর্যটন বিভাগের।
কাশ্মির পর্যটনের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে
২০১৯ সালের ৫ আগস্টের সিদ্ধান্তের পর ইন্ডিয়াস্পেন্ড ২০১৯ ও ২০১৮ সালের পর্যটকের কাশ্মিরে আগমনের পরিসংখ্যান তুলনা করেছে। ২০১৮ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পর্যটক এসেছিল যথাক্রমে ৮৫,৫৩৪ ও ১০৩,১৯৫ জন। আর ২০১৯ সালে তা দাঁড়ায় যথাক্রমে ১০,১৩০ ও ৪,৫৬২ জনে। হ্রাস পেয়েছে যথাক্রমে ৮৮ ভাগ ও ৯৫ ভাগ।
কাশ্মিরের পর্যটন খাতে চাকরি খোয়া গেছে ১৪৪,৫০০টি, হস্তশিল্প খাতটি প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল পর্যটকদের কাছ থেকে আয়ের ওপর।
২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে সার্বিকভাবে সাবেক এই রাজ্যের বাণিজ্যিক ক্ষতি হয়েছে ১৫,০০০ কোটি রুপি (২.১ বিলিয়ন ডলার) এবং চাকরি গেছে ৪৯৬,০০০টি। এই হিসাব কেসিসিআইয়ের।
কেসিসিআইয়ের সহসভাপতি আবদুল মজিদ বলেন, ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের ঘটনায় কাশ্মিরের পর্যটনের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। অনুকূল পরিবেশ ও ইন্টারনেট ছাড়া বর্তমান বিশ্ব অচল। এ দুটি না থাকায় রাজ্যের অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি থেকে কোনো একটি খাতও রেহাই পায়নি।
হোটেল ম্যানেজার হিসেবে জিলানি মাসে বেতন পান ২২ হাজার রুপি। কিন্তু এখন মাসে বেতন কমে হয়েছে ৬ হাজার রুপি। এই টাকা দিয়ে কিভাবে সংসার চালানো যায়? আর আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পর্যটক না এলে এই আয়ও থাকবে না।
জিলানি শিকারাওয়ালাদের (কাশ্মিরি নৌকার মাঝি) সাথে গল্প করেন। তারাও বেকা হয়ে গেছে। শ্রীনগরে প্রায় চার হাজার মাঝি আছে। পর্যটকদের আগমনের ওপরই নির্ভর করে তাদের আয়।
জিলানি তার মেয়ে মারিয়ার স্কুলের বেতন গত অক্টোর থেকৈ পরিশোধ করতে পারছেন না। আর তারা নিত্যপণ্য কিনছেন বাকিতে।
অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে পারে
বর্তমান অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মাঝি মোহাম্মদ শাফি বলেন, স্কুলের বেতন বা বিদ্যুৎ বিলের কথা তো বাদ, খাওয়ার টাকা কিভাবে ব্যবস্থা করা হবে তারই ঠিক নেই।
সাধারণত ভরা মওসুম হয় জুলাই থেকে নভেম্বর। তখন শিকারাতে আয় হয় দিনে ১৫ শ’ থেকে দুই হাজার রুপি। এখন কারফিউয়ের কারণে ভরা মওসুম বলতে কিছু নেই। ইন্টারনেট নেই। আর যদি বিক্ষোভ শুরু হয, তবে পর্যটন আরো ভেঙে পড়বে।
লেখক : শ্রীনগরভিত্তিক নিরপেক্ষ সাংবাদিক
ইন্ডিয়া স্পেন্ড