বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজ : যা বললেন পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অধিনায়ক - ছবি : সংগ্রহ
দুঃসময়ে বন্ধু ও শত্রুর আসল চেহারা সামনে চলে আসে। কিছু মানুষ আপনার কাছে সর্বদা বন্ধুত্বের দাবি করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। কখনো যদি আপনার দুঃসময় আসে, তখন পেছন থেকে আঘাত করে বসে। কিছু মানুষকে আপনি সবসময় শত্র“ ভাবেন এবং তাদের ব্যাপারে বেশির ভাগ সময় বিভ্রান্তির শিকার হতে থাকেন। কিন্তু দুঃসময়ে তারাই আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
দুঃসময়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা মানুষদের উচ্চকণ্ঠে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই। বাংলাদেশ সরকার এমন এক মুহূর্তে তাদের ক্রিকেট দলকে পাকিস্তান সফরে পাঠিয়েছেন, যখন ভারত বিশ্বজুড়ে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র প্রমাণ করতে আদা জল খেয়ে নেমেছে। আর মোদি সরকারের মিশন হচ্ছে, ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) পাকিস্তানকে গ্রে লিস্ট থেকে ব্ল্যাক লিস্টে আছড়ে ফেলুক। ভারত অনেক চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশ যেন তাদের ক্রিকেট দলকে পাকিস্তান সফরে না পাঠায়। পাকিস্তানে অনেক লোক মনে করেছিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ক্রিকেট দলকে পাকিস্তান যেতে দেবেন না।
কিন্তু তিনি তার দলকে তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সিরিজ খেলতে পাকিস্তান সফরে পাঠিয়েছেন। পাকিস্তান সিরিজ জিতেছে। তবে বাংলাদেশীরা পাকিস্তানিদের মন জয় করে নিয়েছেন। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচ শেষ হওয়ার পর জিও নিউজের রিপোর্টার আদনান মালিক তামাশা করে কথা বলছিলেন। তখন এক বালক বেশ নিষ্পাপ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘পাকিস্তান জেতায় আমি খুশি, তবে যদি বাংলাদেশ দল জিতত, আরো বেশি খুশি হতাম।’ এ বালককে ওইসব প্রবীণ মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান মনে হলো, যারা আজো বাংলাদেশকে ‘শত্রু’ মনে করে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এমন লোকের সংখ্যা কম নয়, যারা আজো অতীতের মধ্যে ডুবে আছে এবং বিদ্বেষের আগুনে পুড়তে ও পোড়ানোকেই জাতীয় মর্যাদাবোধ ভাবে।
কিন্তু নতুন প্রজন্ম এ বিদ্বেষকে ভালোবাসার রূপ দিতে চায়। পাকিস্তানে কিছু মানুষ বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের প্রদত্ত দণ্ডের বেশ সমালোচনা করে থাকেন, কিন্তু পাকিস্তান কি কখনো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক চেষ্টা করেছে যে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলার পরিবর্তে পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবা হোক?
বাংলাদেশের মানুষকে এতটাই ‘খারাপ’ মনে করা হয় যে, তাদের সাথে বন্ধুত্বের কথা বলতে আপনাদের মর্যাদাবোধে আঘাত হানে, তাহলে আপনারা বাংলাদেশিদের পাকিস্তানে এসে ক্রিকেট সিরিজ খেলার জন্য বারবার কেন আমন্ত্রণ করেছেন? বাংলাদেশ সরকারের জন্য তাদের ক্রিকেট দলকে পাকিস্তান সফরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ ছিল না। পাকিস্তানে বাঙালিদের প্রতি বিদ্বেষকে কিছু মানুষ নিজেদের জাতীয় মর্যাদাবোধের জন্য বেশ প্রয়োজন মনে করে, তেমনি বাংলাদেশেও পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষপোষণকারীদের সংখ্যা মোটেই কম নয়। এটা সেই বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি, যে ব্যাপারে কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ঢাকা থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন- হাম কে ঠেহরে আজনাবি এতনী মুদারাতুঁ কে বাদ/ ফের বানেঙ্গে আশনা কেতনী মুলাকাতুঁ কে বাদ/ কাব নাযার মেঁ আয়েগী বেদাগ সাবযে কী বাহার/ খুন কে ধাব্বে ধোলেঙ্গে কেতনী বারসাতুঁ কে বাদ- অর্থাৎ এত আতিথেয়তার পরও আমরা অনাত্মীয় হিসেবে বিবেচিত/ আবার হবো আত্মীয় কতো সাক্ষাতের পর/ কবে চোখে পড়বে নির্মল সবুজের বসন্ত/ রক্তের দাগ ধুয়ে যাবে কত বর্ষার পর?
বেশ ভালো লাগল যে, ১৯৭১ সালে ঝরা রক্তের দাগ ধোয়ার জন্য ২৫ জানুয়ারি ২০২০ সালে লাহোরে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে কিছু পাকিস্তানি যুবক বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে এবং এ বার্তা দিয়েছে যে, ক্রিকেট ম্যাচে পাকিস্তান জিতুক বা বাংলাদেশ জিতুক, এ জয় আমাদের কাছে কোনো দেশের জয় নয়, বরং এটা বন্ধুত্ব ও শান্তি-নিরাপত্তার বিজয়। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, গত বছর ২০১৯ সালে অধিকৃত কাশ্মিরের পুলওয়ামা এলাকায় ক্ষুব্ধ এক কাশ্মিরি যুবকের আত্মঘাতী হামলায় ভারতের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের চল্লিশ জন জোয়ান মারা যাওয়ার পর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জোর চেষ্টা চালায়। এ বোর্ডকে একটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস কমিটি পরিচালনা করে থাকে, যার প্রধান হিসেবে বিনোদ রায় প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, যেভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক বর্ণবাদী সরকারের পলিসির বিরোধিতায় দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল, ওইভাবে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভারতে এ দাবিও জোরালো হয়ে উঠেছিল যে, ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ভারতের ক্রিকেট দল পাকিস্তানের সাথে খেলতে অস্বীকার করুক। ভারত সরকার ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল প্রধান শশাঙ্ক মনোহরকে তাদের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য চেষ্টা চালায়, যিনি ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান হিসেবে আগে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে মনোহর এ বিষয়টি থেকে দূরে সরে থাকেন এবং পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ষড়যন্ত্রে অংশ নেননি।
২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দলের ওপর হামলার পর পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৫ সালে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট দলকে এক দিনের সিরিজ খেলার জন্য লাহোরে আসতে প্রস্তুত করা হয়। স্টেডিয়ামে নিরাপত্তা ছিল, কিন্তু স্টেডিয়ামের কাছে একটি আত্মঘাতী হামলা হলো। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দল তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে করাচি আসে এবং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যায়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের শেষে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দল পাকিস্তানে টেস্ট সিরিজ খেলতে এসেছে। যে দলের ওপর ২০০৯ সালে হামলা হয়েছিল, ওই দলই ২০১৯ সালে পাকিস্তান আসে। এভাবে দশ বছর পর পাকিস্তানে টেস্ট ক্রিকেট ফিরে এলো।
২০২০ সালে প্রথম মাসে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের পাকিস্তান আসা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গত ২৫ জানুয়ারি ইংরেজি পত্রিকা ‘দ্য নিউজ’-এ মোশাররফ জায়েদী তার কলামে প্রস্তাব দিয়েছেন, ১৯৭১ সালের তিক্ততাকে ভুলে যেতে জরুরি হচ্ছে, পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা। একটু ভাবুন, ক্ষমাপ্রার্থনা দ্বারা পাকিস্তানের লাভ, নাকি ক্ষতি হবে? এ ক্ষমাপ্রার্থনা শুধু বাংলাদেশের জনগণকে নয়, বরং ওইসব পাকিস্তানিকেও সন্তুষ্ট করবে, যারা ১৯৭১ সালের ঘটনায় আজো ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। এ ক্ষমাপ্রার্থনা দ্বারা ওই চিন্তাকেও পরাস্ত করা যাবে, যা যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায় আদায় করে প্রতিশোধের আগুন নেভানোতে ব্যস্ত। আমি জানি, বাংলাদেশের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। কিন্তু জাতি কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের পাকিস্তান আসা একটি কার্যকর শুভ পদক্ষেপ। বাংলাদেশ দুঃসময়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে। আর দুঃসময়ে সাহায্যে এগিয়ে আসা ব্যক্তিদের খোলা মনে ও উচ্চ কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা প্রতিটি খাঁটি পাকিস্তানির দায়িত্ব।
দৈনিক জং ২৭ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)