রোহিঙ্গা নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে মিয়ানমার!
রোহিঙ্গা নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে মিয়ানমার! - ছবি : সংগৃহীত
আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমার খুবই কঠিন একটি সপ্তাহ অতিবাহিত করেছে। দি হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যাতে আর ‘গণহত্যামূলক’ পদক্ষেপ গৃহীত না হয়, সেজন্য সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
দেশটি এখন রাখাইন রাজ্যের গোলযোগপূর্ণ পশ্চিমাঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলিমদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করা ও ধারা পরিবর্তনের জন্য মারাত্মক চাপের মুখে রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে রাখাইনে সামরিক বাহিনীর আচরণ গোপন ছিল, এখন তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে বলা হয়েছে।
আইসিজে চারটি সাময়িক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মিয়ানমারকে নির্দেশ দিয়েছে। এগুলো হলো : মুসলিম গ্রুপটির বিরুদ্ধে আর কোনো গণহত্যামূলক পদক্ষেপ প্রতিরোধ করা; সামরিক বাহিনী বা কোনো সহায়ক বাহিনী যাদে গণহত্যামূলক কাজ যাতে করতে না পারে তা নিশ্চিত করা এবং ধ্বংসযজ্ঞ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং গণহত্যার অপরাধের প্রমাণ সংরক্ষণ করা; এবং এ ব্যাপারে অগ্রগতি সম্পর্কে চার মাসের মধ্যে আদালতে অবহিত করা। এরপর প্রতি ছয় মাস পরপর প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
বিচারকেরা বলেছেন, আদালত অভিমত প্রকাশ করছে যে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা, জাতিগত সমন্বয় সাধনের ব্যবস্থা করা, রাখাইনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা, আন্তর্জাতিক মানবিক ও মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের জন্য সামরিক বাহিনীকে জবাবদিহিতায় আনার যেসব দাবি মিয়ানমার সরকার করেছে, তা পর্যাপ্ত বলে মনে হচ্ছে না।
মিয়ানমারকে অবশ্যই আইসিজের রায় বাস্তবায়ন করতে হবে, অন্যথায় জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে যেতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ বা সাময়িক পদক্ষেপের ব্যাপারে আদালতের দাবিতে বিস্মিত হয়নি। তারা বিশ্বাস করে যে এই রায় রাখাইনে সমন্বয় সাধনের সরকারি পরিকল্পনায় কোনো বিঘ্ন ঘটাবে না।
আদালত যদিও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়দের নিরাপত্তার জন্য কিছু করার দায়িত্ব মনে করলেও ২০১৬ সালের অক্টোবরে সংগঠিত নৃশংস ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেনি। আদালত এখনো ওই ব্যাপারে আইনগত শুনানি কয়েক বছরের মধ্যেই শুরু করতে পারছে না।
সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ তারা এখনো জোর দিয়ে বলছে যে ওই সময় কোনো গণহত্যা হয়নি বা গণহত্যার উদ্দেশ্যে কোনো কিছু করা হয়নি। আইসিজের রায়ের আগে মিয়ানমারের নিজস্ব স্বাধীন তদন্ত কমিশন (আইসিওই) যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, তাতেও এ কথাটি ছিল।
ওই তদন্তে বলা হয়েছে, সামরিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততায় অভিযান পরিচালনার সময় যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল। এতে এ ব্যাপারে আরো তদন্ত ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশও করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযানের সময় মুসলিম বা অন্য কোনো সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
সরকার গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বলে আসছে যে রাখাইনের ব্যাপারে তাদের নীতিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। তাছাড়া আগের সরকারি ভাষ্যে ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা ছিল বলেও গ্রহণ করে নেয়া হচ্ছে।
রাখাইনে যে নৃশংসতা ঘটেছে, সেটার স্বীকৃতি দিতেই এই তদন্তের আয়োজন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় সরকার দুর্ভোগের শিকাদের জন্য কিছু প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাচ্ছে এবং সঙ্ঘাতের গভীরে থাকা কারণগুলো সমাধানে বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে।
এটাও পরিষ্কার যে বেসামরিক সরকার সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক বাহিনীর শুদ্ধি অভিযানের সময়কার নৃশংসতা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়াস শুরু করেছে। ওই শুদ্ধি অভিযানের কারণেই লাখ লাখ লোক মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।
রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছে যে তারা তিন বছর ধরে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর হাতে হয়রানি, নির্যাতন, উচ্ছেদ, ধর্ষণ, গণ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সহিংসতা থেকে রক্ষা পেতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। পরে জাতিসঙ্ঘ প্রতিবেদনে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে’ জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।
সরকার ও সামরিক বাহিনী অব্যাহতভাবে একে শুদ্ধি অভিযান বলা হচ্ছে। তারা বলছে, সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে আদর্শ সামরিক পদক্ষেপ হিসেবেই এই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ও ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) কয়েকটি সীমান্ত চৌকির ওপর হামলা চালালে নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েক ডজন সদস্য নিহত হয়। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর মতে, সেনাবাহিনী সেকবল আসরাকে নির্মূল করার জন্যই অভিযান পরিচালনা করেছিল।
আইসিওইর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে সারমর্ম প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার গ্রুপগুলো এই ‘নিরপেক্ষ’ তদন্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, এর কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই, এখানে ভুতুরে তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদনটি সত্যিকার অর্থে কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছে। এতে গোপন করার চেষ্টার বদলে অপরাধের কথা জোরালোভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
আইসিওইতে উপসংহার টানা হয়েছে যে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর ২০১৭ সালের অভিযানের সময় যুদ্ধাপরাধ, মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন, দেশীয় আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নির্দোষ গ্রামবাসীদের হত্যা ও তাদের বাড়িঘর ধ্বংসের কাজটি বাড়াবাড়ি রকমের শক্তি প্রয়োগ করে করেছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।
গ্রুপের প্রতিবেদন ও সুপারিশশালা সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তবে কিছু কিছু সুপারিশের ব্যাপারে বেশ জটিলতার সৃষ্টি করেছে।
সরকার এখন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের পরিকল্পনা করছে। কূটনীতিকদের মতে, আন সান সু চি এই প্রতিবেদনের সুপারিশমালার সাথে জাতিসঙ্ঘ সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার সমন্বয় সাধন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
আইসিওই সুপারিশে অপরাধী বেসামরিক ও সামরিক লোকদের বিচারের কথা বলেছে। সামরিক বাহিনী অবশ্য বেশ কয়েক মাস আগেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল শুরু করেছে। সাউথ এশিয়ান মনিটরকে সামরিক সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা এ ব্যাপারে আর কিছু করবে না।
আর স্টেট কাউন্সিলর আং সান সু চি আরো কোর্ট মার্শালের কথা বলেছেন। কূটনীতিকরাও আরো কিছু কোর্ট মার্শালের কথা বলেছেন।
অবশ্য মিয়ানমারের সামরিক বিচারব্যবস্থার প্রতি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা সন্তুষ্ট নন। তারা এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব দেখতে পান। স্টেট কাউন্সিলর নিজেও আইসিজের বক্তৃতায় বিষয়টি অভিহিত করেছেন।
সু চি দি হেগে বলেছেন, বেসামরিক সরকারের দায়দায়িত্ব বেসামরিক সরকার স্বীকার করছে। তারা এর জন্য কিছু করার কথাও ভাবছে। তবে রাখাইনের ঘটনাবলীর দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি রাখা এক কূটনীতিক বলেন, এখন কথায় নয়, কাজ করে সু চিকে তা প্রমাণ করতে হবে।
সবচেয়ে জটিল ও বিরোধমূলক বিষয় হবে বিচারপ্রক্রিয়া। সমন্বয় সাধনের অনেক প্রক্রিয়া সামনে আছে। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন, কম্বোডিয়ার খেমার রুজ ট্রায়াল, ইন্দোনেশিয়া, গুয়েতেমালা ও সিয়েরা লিয়নের সাময়িক ট্রাইব্যুনালের কথা বলা যেতে পারে। এগুলোর সব প্রক্রিয়ার মধ্যেই বেসামরিক সরকার, সামরিক বাহিনী, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক বিচারক ও আইনজীবীদের সম্পৃক্ততা ছিল।
মিয়ানমারকে এখন বেছে নিতে হবে তারা কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করবে। রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত সুবিচার পেতে পারে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এছাড়া রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণের পরিকল্পনার কথাও এসেছে। তারা যাতে অবাধে চলাচল করতে পারে, শিশুরা যাতে পড়াশোনা করতে পারে, চিকিৎসা সুবিধা পেতে পারে, তার নিশ্চয়তা দিতেও বলা হয়েছে।
একটি বিরোধপূর্ণ বিষয় হলো আইডি কার্ড বা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড প্রদান করার সুপারিশ। সরকার এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য নাগরিকত্ব প্রদান করতে রাজি নয়। সরকার যদি বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী থাকে, তবে তাদেরকে তা মানতে হবে।