মিন্নি প্রতিদিন নয়ন বন্ডের বাসায় আসত : বন্ধু ও কাজের বুয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য
মিন্নি প্রতিদিন নয়ন বন্ডের বাসায় আসত : বন্ধু ও কাজের বুয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য - ছবি : সংগ্রহ
বরগুনার বহুল আলোচিত শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় দায়রা আদালতে সোমবার তিনজন সাক্ষ্যের ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। এ সাক্ষ্যরা হলেন মো. হেলাল সিকদার, মো. দুলাল খান ও নয়ন বন্ডের বাসার কাজের মহিলা মোসা: ফুলি বেগম।
বরগুনা জেলা ও দায়রা মো. আছাদুজ্জামান তাদের সাক্ষ্য ও জেরা রেকর্ড করেন। এ ছাড়া শিশু আদালতেও দু'জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ পর্যন্ত ২৫ জন সাক্ষ্য ও শিশু আদালতে ৯ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
সোমবার সকাল সাড়ে নয়টায় বরগুনা জেলা কারাগার হতে পুলিশ পাহারায় ৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক আসামীকে দায়রা আদালতে উপস্থিত করেন। জামিনে থাকা আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিও আদালতে উপস্থিত হয়। আসামি মুছা পলাতক রয়েছেন। সকাল সাড়ে নয়টায় আদালত এজলাসে বসেন জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান। আদালতে সাক্ষ্য দেয় হেলাল সিকদার, দুলাল খান ও নয়ন বন্ডের বাসার কাজের মহিলা মোসা: ফুলি বেগম।
আদালতে সাক্ষ্য শেষে হেলাল সিকদার বলেন, নয়ন বন্ড আর আমি ক্লাস ৬ষ্ঠ শ্রেণি হতে এসএসসি পর্যন্ত বরগুনা জেলা স্কুলে পড়াশুনা করেছি। এরপর একত্রে কম্পিউটার শেখেছি। নয়ন বন্ড আমার ভালো বন্ধু। নয়ন বন্ড ২০১৮ সালের শেষ দিকে মিন্নিকে বিয়ে করে। ২০১৯ সালে বরগুনা ইউটিডিসি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের পূর্ব পাশে নয়ন বন্ড জন্মদিন পালন করে। আমি ওই অনুষ্ঠানে ছিলাম। মিন্নি একটি ফুলের তোরা নিয়ে সেখানে আসে। রিফাত ফরাজি, তানভির, নাঈমসহ ১০/১৫ জন ছিল। মিন্নি নয়ন বন্ডকে কেক খাইয়ে দেয়। সে দৃশ্য আমি মোবাইল ফোনে ধারণ করে ফেস বুক আইডিতে পোষ্ট দেই। ঘটনার দু'দিন আগে রিফাত শরীফের সঙ্গে সকাল ১০টার সময় মিষ্টি পট্টির রোডে দেখা হয়। রিফাত আমাকে বলে তোর সঙ্গে কথা আছে।
দেখা করিস। ওইদিন বরগুনা প্রেস ক্লাবের সামনে আবার দেখা হয়। আমাকে রিফাত শরীফ তার মটর সাইকেলে করে জেলা স্কুলে নিয়ে যায়। রিফাত আমাকে জিজ্ঞেস করে তুই ভিডিও ছাড়ছো কেন। এরপর রিফাত আমার ফোন নিয়ে যায়। আমি নয়ন বন্ডকে বলে দেই। নয়ন বন্ড মিন্নিকে ফোন করে বলে রিফাত শরীফ যেন আমার ফোনটি দিয়ে দেয়। মিন্নি রিফাত শরীফকে আমার ফোন দিতে বলে। এতে রিফাত শরীফ ক্ষিপ্ত হয়ে মিন্নিকে চর থাপ্পর দেয়। আমি শুনেছি এতে মিন্নি ক্ষুব্ধ হয়।
সাক্ষ্য দুলাল খান বলেন, ঘটনার দিন ২৬ জুন সকাল ১০টায় একজন যাত্রী নিয়ে আমি ঘটনাস্থল ক্যালিক্স একাডেমির সামনে যাই। যাত্রী নামিয়ে দিয়ে আবার যাত্রীর অপেক্ষায় থাকি। তখন দেখি ৭/৮ জন পোলাপান একটি ছেলেকে টানাহেচরা ও কিল ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে আসে। একটু পরে দুইজন ছেলে দুইটি দা নিয়ে এসে ওই ছেলেটাকে কোপাতে থাকে। ছেলেটি রক্তাক্ত অবস্থায় আমার রিক্সায় উঠে বলে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমি একটু দূরে আসার পরে একটি মেয়ে এসে আমার রিক্সায় উঠে। আমি মেয়েটিকে ছেলেটার কাটা জায়গা চেপে ধরতে বলি। রক্তে আমার রিক্সা ভিজে যায়। সকল রোডে রক্ত পরেছে। আমি বরগুনা হাসপাতালে নিয়ে আসি। ওই মেয়েটাও ছিল। পরে জানতে পারি নয়ন বন্ড, রিফাত ফারাজি, রশিান ফরাজিরা রিফাত শরীফকে কুপিয়েছে।
নয়ন বন্ডের বাসার কাজের মহিলা মোসা: ফুলি বেগম বলেন, আমি প্রায় দুই বছর নয়ন বন্ডের বাসায় কাজ করি। তারিখ মনে নেই। তবে দেড় বছর আগে নয়ন বন্ড আর মিন্নির বিয়ে হয় নয়ন বন্ডের বাসায় বসে। ওই সময় আমি ছিলাম। নয়ননের মা সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। আমিও মিস্টি খাই। পরে দিন নয়ন বন্ড আর মিন্নি কুয়াকাটা যায়। এক সপ্তাহ কুয়াকাটা থাকার পর আাবার বাসায় আসে। মিন্নি প্রতিদিন নয়ন বন্ডের বাসায় আসতো। রাতেও থাকছে। মিন্নি মা নয়ন বন্ডের মাকে ফোন করে বলতো, বেহাইন আমার মেয়েকে গরম পানি করে দিবেন। ও ঠাণ্ডা লাগাতে পারে না।
ফুলি বেগম আরো বলেন, রিফাত শরীফ মারা গেছে বুধবার। আগের দিন মঙ্গলবার সকাল অনুমান ১০টার সময় মিন্নি নয়ন বন্ডের বাসায় আসে। আমি দরজা খুলে দেই। নয়ন বন্ড তখন ঘুমে ছিল। মিন্নি নয়ন বন্ডের রুমের দরজায় টোকা দেয়। নয়ন বন্ড দরজা খুলে দিলে মিন্নি ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। অনুমান দেড় ঘন্টা থাকার পর মিন্নি চলে যায়। এমনি ভাবে মিন্নি প্রত্যেকদিন নয়ন বন্ডের বাসায় আসতো। মিন্নির স্যালোয়ার কামিজ নয়নদের বাসায় থাকতো। রাতেও মিন্নি নয়নের বাসায় থাকছে। নয়নের মা জানতো না মিন্নিকে রিফাত শরীফ বিয়ে করেছে। আমিও জানতাম না। রিফাত শরীফ খুন হওয়ার পর শুনি মিন্নি আবার বিয়ে বইছে। আসামী পক্ষের ৭ জন আইনজীবী তিনজন সাক্ষ্যকে জেরা করেন।
আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, আদালতে যে ভাবে সাক্ষ্য দিয়েছে তাতে আসামিরা ন্যায়বিচার পাবেন। অন্য আসামিদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা সাক্ষ্যদের জেরা করেনি।
রাষ্ট্র পক্ষের পিপি ভুবন চন্দ্র হাওলাদার বলেন, যারা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা সকলেই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র পক্ষ আশা করে বাদী ন্যায় বিচার পাবেন। মিন্নি রিফাত শরীফের হত্যা কান্ডের সঙ্গে জড়িত। তা নয়ন বন্ডের বাসার কাজের মহিলা সাক্ষ্য দিয়ে প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে।
শিশু আদালতে ১৪ আসামি বিরুদ্ধে দুইজন সাক্ষ্য প্রদান
বরগুনায় আলোচিত শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় শিশু আদালতে সোমবার দুইজন সাক্ষ্যের ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। ওই আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মঞ্জুরুল আলম জন ও আনোয়ার হোসেন মৃধা শিশু আদঅলতের বিচারক মো. হাফিজুর রহমান তাদের সাক্ষ্য রেকর্ড করেন। তাদেরকে ১০ জন আইনজীবী জেরা করেন।
সোমবার সকালে নিত্য দিনের মত বরগুনা কারাগার থেকে শিশু আসামি ৯ জন ও জামিনে থাকা ৫ জন আসামি আদালতে উপস্থিত হয়।
শিশু আদালতে সাক্ষ্য শেষে মঞ্জুরুল আলম জন বলেন, ঘটনার দিন ২৬ জুন সকাল অনুমান ১০-২০ মিনিটের সময় আমি মনিরের ফোন পাই যে, রিফাত শরীফকে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজি, রিশান ফরাজি, টিকটক হৃদয়সহ আরো ১০/১৫ জন লোক রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম করেছে। আমি বরগুনা হাসপাতালে যাই। ওই সময় রিফাত শরীফের বাবা দুলাল মরীফ, আপন চাচা আবদুল আজিজ শরীফ ও সালাম শরীফ হাসপাতালে আসে। রিফাত শরীফকে রক্তাক্ত অবস্থায় বরিশাল হাসপাতালে নিয়ে যায়।
আমিও একটি গাড়ি নিয়ে বরিশাল যাই। ওখানে রিফাত মারা যায়। আমি রিফাতের সুরাত হাল রিপোর্টে স্বাক্ষর করি। রিফাতের পড়নে জিন্সের প্যান্ট আমার সামনে জব্দ করেন। আমি আদালতে রক্তমাখা জিন্সের প্যান্ট শনাক্ত করেছি।
সাক্ষ্য আনোয়ার হোসেন মৃধাও অনুরুপ সাক্ষ্য দেয়। আসামী নাজমুল হাসানের পক্ষের আইনজীবী মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ওই দুইজন সাক্ষ্য কেহ রিফাত শরীফকে কোপাতে দেখেনি। সবাই শোনা সাক্ষ্য। শোনা সাক্ষ্যর কোনো মূল্য নেই।
রাষ্ট্রপক্ষে বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল বলেন, সাক্ষ্যরা যে ভাবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাতে সকল আসামীদের সাজা হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ৮ জন আসামি ১৬৪ ধারায় ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আমি আশা করি রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য দিয়ে মামলা প্রমান করতে সক্ষম হবে।