ভারতের বিরুদ্ধে কঠিন প্রস্তাব ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে
ভারতের বিরুদ্ধে কঠিন প্রস্তাব ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে - ছবি : সংগৃহীত
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে শিগগিরই উত্থাপনের জন্য প্রস্তুত এক প্রস্তাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বামপন্থী এমপিদের গ্রুপ বলেছে যে ভারতের ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ‘বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রহীনতা সঙ্কট সৃষ্টি করেছে।‘
গ্রুপটি কাশ্মির প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্যও ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আর গ্রুপটি ইইউ ও এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ভারতে সাথে তাদের বাণিজ্য ও অন্যান্য চুক্তিতে মানবাধিকার বিষয়টি কঠোরভাবে অনুশীলনের বিধান রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
পাঁচ পৃষ্ঠার খসড়া প্রস্তাবটি প্রস্তুত করেছে ইউরোপিয়ান ইউনাইটেড লেফট/নরডিক গ্রিন ফেলের কনফেডারাল গ্রুপের ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট দস্যরা। এটি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের আসন্ন পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে উত্থঅপন করা হবে। প্রস্তাবটির শিরোনাম হচ্ছে : ‘ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট রেজুলিউশন অন ইন্ডিয়াস সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০১৯। ‘
খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সিএএর ফলে ভারতে নাগরিকত্ব লাভের ব্যাপারে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। এর ফলে বিশ্বে বৃহত্তম রাষ্ট্রহীনতা সঙ্কট সৃষ্টি করবে এবং মারাত্মক মানবিক দুর্ভোগের কারণ হবে।
মুসলিমবিরোধী
এতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয় যে নাগরিকত্ব লাভ করার ক্ষেত্রে কোটি কোটি মুসলিম সমান মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এতে আরো বলা হয়, সিএএ ও এর সাথে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) মিলে অনেক মুসলিম নাগরিককে নাগরিকত্বহীনে পরিণত করবে।
প্রস্তাবটিতে ১৯৯২ সালের ধর্ম, বর্ণ, ভাষানির্বিশেষে ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ ঘোষণার বাধ্যবাধকতা অনুসরণে ভারত সরকারের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়।
এতে আরো বলা হয় যে ভারত সরকারকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সংখ্যালঘু গ্রুপগুলো যাতে কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই তাদের মানবাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যালঘুরা যাতে আইনের চোখে সমান হয়, তাও নিশ্চিত করতে বলা হয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মূলনীতিগুলো ভারতের লঙ্ঘনেরও তীব্র সমালোচনা করা হয় এতে।
প্রস্তাবে জরুরিভিত্তিতে ধর্মনির্বিশেষে উদ্বাস্তু ও অভিবাসীদের সুরক্ষা পুরোপুরি নিশ্চিত করার জন্য ভারতের সরকার ও পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
কাশ্মিরবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব বাস্তবায়ন
খসড়া প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠত কাশ্মিরবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য ভারত সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়। উল্লেখ্য, ওই এলাকাটির সংবিধানস্বীকৃত মর্যাদা হ্রাস করা হয়েছে, সেখানকার অধিবাসীরা নির্যাতিত হচ্ছে।
এতে কাশ্মিরবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য ইউরোপিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয় এবং এই সঙ্কট নিসরনের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
এতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ভারত সরকারের কাশ্মিরবিষয়ক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও নাগরিকত্ব আইনের কারণে পরমাণু শক্তিসম্পন্ন দেশ দুটির মধ্যকার উত্তেজনা আরো বেড়ে গেছে। খসড়া প্রস্তাবে ভারতের একতরফাভাবে কাশ্মিরের মর্যাদা বাতিলের নিন্দা করা হয় এবং কাশ্মিরবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থার সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বিক্ষোভকারীদের সাথে সংলাপ
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রস্তাবে বিক্ষোভকারীদের সাথে গঠনমূলক সংলাপে অংশ নিতে ও বৈষম্যমূলক সিএএর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রস্তাবে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় ধর্মঘটের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে উল্লেখ করে বলা হয় যে সবার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, সরকারি কোম্পানিগুলোর বেসরকারিকরণ ও সিএএর বিরুদ্ধে ২৫ কোটি শ্রমিক রাস্তায় নেমে এসেছিল।
এটা বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন অভিযানে বাড়াবাড়ি শক্তি প্রয়োগের নিন্দা জানানো হয় এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর শক্তিপ্রয়োগের অভিযোগের ব্যাপারে সরকারের প্রতি বিশ্বাসযোগ্য, স্বাধীন তদন্ত পরিচালনা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
ইইউর খসড়ায় বিক্ষোভকারীদের দুর্বৃত্তকরণ বন্ধ করার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা নিয়ে জাতিসঙ্ঘ বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয়ার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়।
অর্থনৈতিক চুক্তিতে মানবাধিকার অন্তর্ভূক্ত করা
খসড়া প্রস্তাবে ইইউ ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাদের ভারতীয় অংশীদারদের সাথে চুক্তি ও আলোচনার সময় বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনটি উত্থাপন করার আহ্বান জানানো হয় এবং জোর দিতে বলা হয় যে ভঅরতের সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যেকোনো চুক্তিতে মানবাধিকার বিষয়টি যেন জোরালোভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বিজেপির এজেন্ডার নিন্দা
খসড়া প্রস্তাবে ভারতের সাম্প্রতিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৯ সালের মে মাসে দ্বিতীয়বার জয়ী হওয়ার পর বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবারো প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর থেকে ভারত সরকার তার জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা জোরদার করেছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, যেকোনো বিরোধিতা, মানবাধিকার গ্রুপ, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে।
২০১৯ সালের আগস্টে সরকার জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে এই রাজ্যটিকে দুই খণ্ড করে কেন্দ্রশাসিত ভূখণ্ডে পরিণত করে। সরকার ওই অঞ্চলে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করেছে, ইন্টারনেট ও ফোন বন্ধ করে দেয়, হাজার হাজার লোককে আটক করে, এমনকি নির্বাচিত নেতাদের পর্যন্ত আটক করে।
নাগরিকত্ব আইনে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ,জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যবস্থা করা হলেও মুসলিমদেরকে বাদ রাখা হয়েছে। তাছাড়া শ্রীলঙ্কার তামিল উদ্বাস্তু, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, তিব্বতের বৌদ্ধ উদ্বাস্তুদেরও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
ভারতের জাতীয় আইনে এই প্রথম নাগরিকত্ব আইনে ধর্মকে অন্তভূক্ত করা হলো। এটি ভারতীয় সংবিধানের সেক্যুলার প্রকৃতির পরিপন্থী। সিএএ ভারতের বৈষম্য না করার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন ঘটিয়েছে।
সিএএ মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক
সিএএ সুস্পষ্টভাবে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার (ইউডিএইচআর) অনুচ্ছেদ ১৫-এর লঙ্ঘন। এতে বলা হয়েছে যে প্রত্যেকেরই নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকা আছে এবং কাউকেই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না।
সব রাষ্ট্রের ব্যক্তির মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ব্যক্তি যাতে পূর্ণ মানবাধিকার লাভ করতে পারে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
এতে বলা হয়, সিএএ পাস হওয়ার পর ভারতজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। রাজধানী দিল্লি ছাড়াও মুম্বাই, কোলকাতা, ব্যাঙ্গালোর ও হায়দারাবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীরা নাগরিকত্ব আইনে মুসলিম অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের অন্তভূক্তি করার দাবি জানানো হয়। সিএএর ফলে আসাম, উত্তর প্রদেশে ও অন্যান্য রাজ্যে নতুন করে পুরনো ক্ষত জেগে ওঠে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো মনে করতে থাকে যে এর ফলে উদ্বাস্তু ও অভিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে বাংলাদেশ থেকে আরো অভিবাসী এসে রাজনৈতিক অধিকার, সংস্কৃতিক অধিকার ও ভূমি অধিকার থেকে স্থানীয় লোকজন বঞ্চিত হবে।
ভারতজুড়ে হওয়া বিক্ষোভে বলা হয় যে সিএএ সংবিধানবিরোধী ও মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক। তবে ভারত সরকার কারফিউ জারি করে, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, অ্যাক্টিভিস্টদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এর জবাব দেয়। বিক্ষোভাকারীদের ওপর নির্যাতন করা হয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছৈ।
পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি বেশ কিছু সম্পত্তির ক্ষতিও হয়।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে উত্তর প্রদেশে। সেখানকার বারানসিতে ৮ বছরের একটি শিশুরও মৃত্যু ঘটে। ২২ জনের বেশি বিক্ষোভকারী বুলেটবিদ্ধ হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট যথাযথভাবে হয়নি বলে স্বজনেরা অভিযোগ করেছে।
প্রস্তাবটিতে এই প্রস্তাবটি ভারত সরকার, কাউন্সিল, কমিশন, পররাষ্ট্রবিষয়ক ও নিরাপত্তানীতিবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইউরোপিয়ান এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিসের কাছে পাঠানোর জন্য ইইউ সভাপতির প্রতি আহ্বান জানানো হয়।