এক ইরাকি নারীর চ্যালেঞ্জ
হুদা কত্তন - ছবি : সংগ্রহ
হুদা কত্তন। তিনি একজন ইরাকি- আমেরিকান উদ্যোক্তা। অর্থাৎ একজন সফল মেকআপ শিল্পী, বিউটি ব্লগার ইত্যাদি হিসেবে বেশি পরিচিত বিশ্বে। তার জন্ম আমেরিকার ওকলাহোমা শহরে ২ অক্টোবর, ১৯৮৩ সালে। তার বাবা-মা উভয়ই এসেছেন ইরাক থেকে। পরিবারটি পরে চলে যায় টেনেসির কুকভিল এবং পরে ডার্টমাউথ, ম্যাসাচুসেটসে।
নিজস্ব ব্যবসা সফলভাবে চালানোর কারণে এখন হুদা কত্তনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হচ্ছে না। অর্থাৎ ব্যবসা শুধু বড়ই হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। তিনি এখন প্রভাবশালী নারীর তালিকায় আছেন ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে। অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে ৩৬তম স্থানে। হুদার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। আর প্রায় ২৫ কোটি ডলার বার্ষিক আয়। সবার কাছে তিনি এখন সুপরিচিত মিলিয়নেয়ার বিউটিশিয়ান হিসেবে। তাকে এমন উচ্চতায় (উন্নতির) নিয়ে যায় তারই প্রতিষ্ঠিত কসমেটিক লাইন আপ কোম্পানি ‘হুদা বিউটি’। ক্রমেই প্রতিষ্ঠানটির অ্যাসেট ভ্যালু দাঁড়িয়েছে ১.২ বিলিয়ন ডলার। ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে তিনি আছেন প্রভাবশালী নারীর তালিকায় ১০ নম্বরে।
বছর কয়েক আগেও হুদা কত্তন ছিলেন অতি সাধারণ মেয়ে। তিনি যে পেশা হিসেবে সাজগোজ বা সৌন্দর্য পণ্যকে বেছে নেবেন তা কখনো মনেও হয়নি তার।
তার বাবা বলতেন, হুদা বড় হলে শিক্ষক হবে। অর্থাৎ মানুষ গড়ার কারিগর হবে। অনেকে বলছেন, মহান সৃষ্টিকর্তা তার ভবিষ্যৎ আগে থেকে যেভাবে সাজানোর বিষয়টি ঠিক করে রেখেছেন তাই হয়েছে। তবে নিজের পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের সহায়তা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজ দিয়েছে। এখন হুদা বিউটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের নারীদের কাছে। তিনি সফুরা ব্র্যান্ড থেকে শোরুম খুলে বাজারে বিক্রি করছেন লিপ লাইনার, আইশ্যাডো প্যালেটস, হাইলাইটার, লিকুইড লিপস্টিকসহ আরো অনেক প্রসাধনী পণ্য। আর তা প্রায় ১৪০ ধরনের। বছর কয়েক আগে বাজারে আসে ফলস আইল্যাশ সিরিজ।
পড়াশোনা শেষে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে দুবাইয়ে চলে যান ২০০৬ সালের দিকে। কিন্তু এ কাজ তার কাছে একঘেয়ামি মনে হচ্ছিল। অর্থাৎ এ চাকরি করে মনের দিক থেকে একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। ক্রমেই নিরামিষ বা নিরানন্দ হয়ে উঠতে লাগল জীবন। তিনি মনে করেন, ছকে বাঁধা কাজের মধ্যে যেমন আনন্দ নেই, তেমনি সফলতাও কম। তাই তিনি সব সময় ভাবতেন, ছকে বাঁধা এমন কর্মময় জীবন থেকে কী করে বেরিয়ে আসা যায়।
তবে তিনি ভাবতেন, নতুন একটা কাজ না ধরে তো আর এ চাকরি ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না একেবারেই। তাতে বেকার জীবনের স্বাদ পেতে হতে পারে দীর্ঘদিনের জন্য। হঠাৎ করে তার মনে হলো, আমি (হুদা কত্তনের) তো নারীদের সাজাতে, সাজগোজের পরামর্শ দিতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। তাই জীবন এদিকে ঝুঁকাতে সমস্যা কিসের। তা এ-সংক্রান্ত কমবেশি অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এ ব্যাপারে তার মনোবল অনেক বেশি ছিল বলে একদিন সিদ্ধান্ত নেন চাকরিটা ছেড়ে দেয়ার এবং ছেড়েও দিলেন। বেশি দিন দেরি না করে ফিরে এলেন জন্মস্থান যুক্তরাষ্ট্রে। সিদ্ধান্ত নেন মেকআপ বিষয়ে পড়াশোনার। চলে আসেন লস অ্যাঞ্জেলেসে। একটানা পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে শেষও করলেন একাডেমিক শিক্ষা। অতঃপর কাজে নেমে পড়েন নিজে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে। বেশ অল্প সময়ের মধ্যে নামকরা তারকা ব্যক্তিদের মেকআপ করার কাজ পান। হুদা কত্তন বলেন, আমার কাছে রুচিশীল সাজগোজই ভালো লাগে। অনেকে উগ্র সাজগোজ বা মেকআপ পছন্দ করেন, যা আমার কাছে একেবারেই পছন্দ নয়। যতটা সম্ভব রুচিশীল মেকআপের দিকেই বেশি যাই আমি। অনেকেই আমার মেকআপের কাজ যথেষ্ট পছন্দ করেন। তাই বেড়েছে এ-সংক্রান্ত ব্যস্ততাও।
হুদা কত্তন বলেন, নামকরা তারকাদের মেকআপের কাজে যথেষ্ট সাহস ও ধৈর্যের প্রয়োজন। কাজ ভালো হলে অন্যরাও পাকা হাতের কারিগরের কাছেই আসতে চান মেকআপের জন্য। এভাবেই তো পরিচিতিটা বাড়ে। একপর্যায়ে তিনি যোগ দেন মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে। এখানেও তিনি পরিচিতি লাভ করতে থাকেন দ্রুত। এভাবে হুদার নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে চার দিকে।
এমন ঈর্ষণীয় সফলতা দেখে তাকে ব্লক লেখার পরামর্শ দিতে থাকেন তারই শুভাকাক্সক্ষীরা। এরপর ২০১০ সালের দিকে তাদের পরামর্শ তিনি ওয়ার্ডপ্রেসে শুরু করে দেন সৌন্দর্য বিষয়ে লেখালেখি। সেখানে তিনি হুদা বিউটি নামের ব্লগ থেকে টিপস এবং নানা টিউটোরিয়াল আপলোড করতে থাকেন। এসব লেখালেখিই তাকে ব্যাপক পরিচিতি ঘটায়। অর্থাৎ চলে যেতে থাকেন এ-সংক্রান্ত অনন্য উচ্চতায়। প্রথম অবস্থায় তার রোজগার ছিল অন্য আট-দশজন মেকআপ আর্টিস্টের মতো। একপর্যায়ে এসবেরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে উদ্যোক্তা হিসেবে। ইনস্টাগ্রামে হুদা কত্তনের অনুসারীর সংখ্যা হবে প্রায় পৌনে চার কোটি। নামকরা মেকআপ আর্টিস্টরা বলেছেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি ফলোয়ার বা অনুসারী সত্যিই অবাক বিষয়।
হুদা কত্তন প্রথম স্থান পেয়েছেন ‘২০১৭ ইনফ্লুয়েন্সার ইনস্টাগ্রাম রিচ তালিকায়।’ তাকে বিউটি প্রভাবক অর্থনীতিতে অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে টাইম ম্যাগাজিনের মাধ্যমে তাকে সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রথম অবস্থায় অর্থাৎ ব্যবসার শুরুতে ব্যবসায়িক পণ্যের নানা উপকরণ সংগ্রহ করতে হুদা কত্তনকে একটু বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। পরে বেশ দ্রুতই তা তিনি সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসেন। এতে তার পরিশ্রমও কমে এসেছে। হুদা কাত্তন বলেন, ‘পণ্যের প্রচারমূলক বিজ্ঞাপনে আমি কখনোই প্রচুর অর্থ ব্যয় করি না। যদিও বলা হয়ে থাকে প্রচারেই পণ্যের প্রসার।’ কারো পণ্য ভালো হলে ক্রেতারা তা খুঁজে বের করে কিনবেই। অনেক ক্রেতা প্রচারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেন না। তারা বলেন, অনেক সময় বেশি প্রচার করে নি¤œমানের পণ্য বেশি দামে গছিয়ে দেয় ভোক্তা বা ক্রেতাদের। হুদা বলেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে অতি মুনাফা লাভের আশা বা কাজ মোটেই ভালো ফল দেয় না। কোনো কারণে কোনো ব্র্যান্ডের কোনো পণ্যের ওপর থেকে ক্রেতা বা ভোক্তাদের বিশ্বাস খর্ব হলে হারানো সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে কোম্পানিকে অনেক বেগ পেতে হয়। এমনকি অনেক সময় সেই আস্থা আর ফিরেও আসে না।
হুদা কত্তন বলেন, আমার স্কুলজীবনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক নাটকগুলোতে মেকআপের দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার ওপর ছেড়ে দিতেন। কারণ এ ব্যাপারে তারা আমাকে খুবই ভরসা করতেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন শোগুলোতে সৌন্দর্য কাজে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগই আমি হাতছাড়া করিনি। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি এ কারণে যে, মেকআপের প্রতি আমার অগাধ ভালোবাসা রয়েছে এবং অনেক বছর এ ব্যবসায় জড়িত থাকার মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত একটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে সক্ষম হই। পেশাগত নানা সুযোগ আমাকে বিশ্বমানের মেকআপ শিল্পী, অতি আশ্চর্যজনক ব্র্যান্ড, বেশ কয়েকজন ভালো মডেল এবং সেলিব্রিটিদের সাথে কাজ করার সুযোগ পাই। তবে আমার ব্যবসার উত্থানের পেছনে দুই বোন মোনা এবং আলিয়ার অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, অনেকেই আমার বিউটি টিপস এবং পরামর্শগুলো ভাগ করে নিয়েছে বলে আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, পৃথিবীতে এখনো ভালোমানের প্রসাধনী সামগ্রী আছে। এসবই তাকে সৌন্দর্য পণ্যগুলোর বিশষজ্ঞ হিসেবে পরিণত করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হুদা বিউটি ব্লগটি এমন সময়ে চালু করা হয়েছে, যখন মানুষ প্রসাধনী এবং ব্যক্তিগত যত্ন পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে ভালোই অর্থ ব্যয় করে। ইউরো মনিটর ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, কসমেটিকস এবং ব্যক্তিগত যত্ন পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে মাথাপিছু প্রায় ২৯৪ মার্কিন ডলার ব্যয় করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রেতা বা গ্রাহকরা।
হুদা কত্তনের বোন মোনা কত্তন বলেছেন, সত্যই সৌন্দর্যের শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে চাই আমরা। ভোক্তাকে কম দামে সর্বোচ্চ মানের পণ্য উপহার দিচ্ছি। দুবাই মলেও এ ধরনের পণ্য ভালোই কিনতে পাওয়া গেছে। ব্যবসার প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব ডিস্ট্রিবিউটরের সাথে আমরা কাজ করেছিলাম তা সত্যিকার অর্থে অপেক্ষাকৃত ছোট সংস্থার সুবিধা করে দিয়েছিল। এখন অনেক দূরে এগিয়েছি। হুদা বলেছেন, কেবল চারজন মানুষ, যেমন আমরা তিন বোন এবং আমার সহকারীসহ যথাযথ অবকাঠামো ছাড়া একটি বিউটি ব্র্যান্ড দাঁড় করানো সত্যিই চ্যালেঞ্জজনক প্রচেষ্টা ছিল। অনেক সময় সঠিক পরিমাণে অর্ডার পাওয়া যায় না নানা কারণে। যার কারণে আক্ষরিকভাবে ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে মার খেতে হয়। তা সফল ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে বলতে চাই, এগুলো সত্যিই চ্যালেঞ্জিং। এক পর্যায়ে আমি পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করতে থাকি। তখন আমাদের সাথে যোগ দেন আমার স্বামীও। অতঃপর আমরা আমাদের প্রায় টার্গেটের দ্বারপ্রান্তে চলে চাই। কোম্পানির চিফ অপারেটিং অফিসার পদে যোগ দেন আমার স্বামী ক্রিস্টোফার। একটি উপযুক্ত বিতরণ চ্যানেল সৃষ্টি হতে লাগল। প্রসাধনীগুলোর জন্য তহবিল সরবরাহ করতে সক্ষম হতে লাগলাম।
এ দিকে, মিসরের কায়রো নারীদের চলার সময়ে তাদের ব্যবসায়ের ধারণাগুলো প্রকাশ করে অভিবাসী নারী উদ্যোক্তারা। এতে করেও সংস্থাটি একটি বিস্ময়কর মাত্রা পেয়ে যায়। হুদা বিউটি গ্লোবান ইন স্টোরে বিতরণ বেড়ে যায় প্রায় ১৮ গুণ। বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সারাবিশ্বে এর কর্মচারি ছিল প্রায় ১১৫ জন এবং এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এ সংখ্যাটি। হুদা বিউটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে প্রথম দফতর খোলার পরপর কোম্পানির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে।
হুদা বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের এক নম্বর ব্লগার হওয়াই ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই তার একটি লুকায়িত লক্ষ্য ছিল যা হুদা কত্তন হয়তো জানতেন না। হুদা বলেছেন, আমার কাছে রয়েছে গুগল, অ্যাপল, অ্যামাজনসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী সংস্থা। তাই বলতে হচ্ছে, এখনো আমাদের আরো অনেক কিছু করার আছে। ২০১৮ সালে হুদা কত্তন বোনরা চালু করেন সুগন্ধি বিভাগ। চারটি সুগন্ধির নাম হচ্ছে সাইট্রাস, এলিক্সির, কস্তুরি এবং ভ্যানিলা। এসবের প্রতিটির দাম ৮৫ ডলার থেকে ১১৮ ডলার প্রায়। মধ্যপ্রাচ্যের সুগন্ধি স্তর সমৃদ্ধির ঐতিহ্যকে সামনে রেখে করা হয়েছে এসব সুগন্ধি। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমেও। হুদা বলেন, একটা সময়ে আমার সব অর্থ ব্যয় করি ব্যয়বহুল পারফিউমের পেছনে।
মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক স্থানে যুগ যুগ ধরে নারীরা তাদের স্বামীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে এখন পরিবর্তন এসেছে। হুদা মনে করেন, আরব মুসলিম নারীরা কিছু করার ক্ষমতায়িত বোধ করছেন। তিনি বলেন, এখনো আমার স্বামী আমার দুর্গের রাজা। সংসার টিকিয়ে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। হিজাব পরিধানকারীরা এখন নিজেরাই নিজেদের প্রকাশ করতে পারছেন নানা মাধ্যমে। অর্থাৎ নারীরা নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হচ্ছেন রক্ষণশীল সমাজগুলোতে। এখন অনেক মুসলিম নারী হিজাব পরে নিজ নিজ ব্যবসা চালাচ্ছেন সফলভাবে।