মারাত্মক বিপদের মধ্যে মানবজাতি

মীযানুল করীম | Jan 25, 2020 06:03 pm
মারাত্মক বিপদের মধ্যে মানবজাতি

মারাত্মক বিপদের মধ্যে মানবজাতি - ছবি : সংগ্রহ

 

আমেরিকার সাথে চীনের দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্য যুদ্ধের আংশিক নিরসনের স্বস্তিকে এবার ডুবিয়ে দিয়েছে চীন দেশে নতুন এক জীবাণুর আকস্মিক হানার মহাবিপদ। ‘করোনা’ নামের এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে শত শত মানুষ এবং তাদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু ঘটেছে। এই ভাইরাসের শিকার হলে সুস্থ হওয়ার কোনো ভ্যাকসিন/অ্যান্টিভাইরাল, অর্থাৎ কোনো প্রকার ওষুধ আজো উদ্ভাবন করা যায়নি বলে সময়ের সাথে সাথে করোনা ভাইরাসজনিত মহামারীতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এবং এ কারণে মৃত মানুষের সারি আপাতত দীর্ঘতর হতে থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চীনে শুধু ব্যাঙ আর শূকর নয়, সাপও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় খাবার। সেই সাপ থেকেই করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়েছে। এ কারণে চীনারা সাপখোপ খাওয়া বন্ধ করবেন কি না জানা যায়নি। এ ভাইরাস আমাদের বাংলাদেশেও ভীতির জন্ম দিয়েছে। এ জন্য বিমান ও স্থলবন্দরে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি শুরু হয়েছে।

চীন গত বেশ কিছু দিন ধরে সোয়াইন ফ্লু’র সংক্রমণে পশুসম্পদ নিয়ে দিশেহারা। এ রোগ প্রতিরোধ করতে না পেরে বরং কয়েক লাখ শূকরকে হত্যা করা হয়েছে সে দেশে। এখন করোনা ভাইরাসজনিত মহামারীর মহাবিপদের মুখে পড়েছে চীনের পশু, তথা প্রাণিসম্পদ শুধু নয়, অসংখ্য মানুষও। চীনে শূকরের মতো সাপও জনপ্রিয় খাবার এবং এবারে করোনা ভাইরাস প্রথম ছড়ায় সাপের মাধ্যমেই।

একজন চিকিৎসক জানান, প্রথমে বোঝা যায়নি, কোন ধরনের করোনা ভাইরাস সর্বশেষ আতঙ্কের উৎস। জানা গেছে, এর আগে ছড়িয়েছিল SARS এবং MERS ভাইরাস। এবারেরটির নাম ২০১৯=n Cov বা এনকভ ভাইরাস। ‘করোনা’ শব্দটির অর্থ MERS বা মুকুট। দেখতে মুকুটের মতো দেখায় বলেই এই নামকরণ হয়েছে। এ ধরনের ভাইরাসগুলো আগে ছিল পশু-পাখির মধ্যে। অনেক Mutation বা পরিবর্তনের পরে এখন মানবদেহে এসব ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে। আগে বাদুড় থেকে সংক্রমিত হলেও এবার করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে সাপের মাধ্যমে। এমনটা মনে করার কারণ, মধ্যচীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের যে মার্কেট থেকে এটি ছড়িয়েছে, সেখানে বিক্রি করা হয় সাপ এবং সমুদ্রের মাছ। সামুদ্রিক প্রাণীতে এই ভাইরাসের সংক্রমণ সম্ভব নয় বিধায় ধরে নিতে হয়, সাপের মাংস ভক্ষণ করাই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণ। মনে করা হচ্ছে, বাদুড় খেতে গিয়ে সাপ এ ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছিল। কোরিয়ানদের কাছে যেমন কুকুরের মাংস খুব প্রিয়, তেমনি অমুসলিম চীনারা সাগ্রহে খেয়ে থাকে সাপ ও শূকরের মাংস। আর সাপ খাওয়াই করোনা ভাইরাসে অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ বলে জানা যায়। একটি সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ১১ শ’ জন আক্রান্তের মধ্যে ৪১ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এর আগে SARS ভাইরাসে প্রায় ৯ শতাংশ আক্রান্তের মৃত্যু ঘটেছিল। উল্লেখ্য, SARS মানে, Severe Acute Respiratory Syndrome (শ্বাসযন্ত্রের মারাত্মক ও সূক্ষ্ম রোগ)।

সাপখোপ আর শূকর-কুকুর খাওয়া প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে হয়। বিগত শতাব্দীর আশির দশকের প্রথম দিকে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত জ্বালানি গ্যাসলাইন বসানোর কাজ শুরু হয়। সম্ভবত কিছু দিন পরে দেশের আরো কয়েক স্থানে একই কাজে হাত দেয়া হয়েছিল। শত শত কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন বসানোর কাজে জড়িত ছিল কোরিয়ান কোম্পানি। এই সুবাদে সে দেশের বহু লোক বাংলাদেশে কাজ করতে আসেন। তাদের একটি প্রিয় খাবার ছিল কুকুরের মাংস। কিন্তু এত কুকুর কোথায় পাওয়া যাবে?

মুসলিমপ্রধান এ দেশে খাওয়ার জন্য কুকুর পালন করা হয় না। শখ করে কেউ কেউ বিদেশী বা উন্নত জাতের কুকুর পুষে থাকেন। আর আছে পথেঘাটে অসংখ্য নেড়িকুত্তা বা stray dogs। যা হোক, কোরিয়ানদের কাছে ‘কুত্তার গোশত’ উপাদেয় আইটেম জেনে এ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তখন ‘কুকুরের হাট’ বসার কথা শোনা গিয়েছিল। এতে নাকি পথের খেঁকি কুকুরদের ধরে এনে বিক্রি করা হতো মুফতে মুনাফা কামানোর লোভে। কিছু দিন পরে এই সারমেয়সেবী বিদেশনন্দনদের বিদায়ের সাথে সাথে কুকুর কেনাবেচারও অবসান ঘটে।

সাপ খাওয়ার কথা একসময় অবিশ্বাস্য মনে হলেও আজকাল আর তা হওয়ার কথা নয়। আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলের কোনো কোনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। তাদের পরিচালিত রেস্টুরেন্টও আছে নিজেদের এলাকায়। বাঙালিসহ কিছু পর্যটক নাকি সেখানে এসব খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। স্মর্তব্য, দীর্ঘ দিন এ দেশের চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ব্যাঙের মাংস পরিবেশন করা হতো। ব্যাঙ ছাড়া ‘চাইনিজ’ খাওয়া অনেকটা অসম্ভব মনে করা হতো। ব্যাঙ ধরে রফতানিও করা হতো ব্যাপকভাবে। সত্তর দশকের শেষ দিকে ব্যাঙ ধরার বাতিক এত লাভজনক ছিল যে, অনেকে এটাকে তাদের পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ ধরার ব্যাপকতায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়। কারণ ব্যাঙ না থাকলে কিংবা অপর্যাপ্ত সংখ্যায় থাকলে, ক্ষেত-খামারে ক্ষতিকর পোকামাকড় অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায়। বাস্তবে এটা হওয়ায় সরকার ব্যাঙ ধরা নিষিদ্ধ করে দেয়। এতে ব্যাঙেরাই কেবল নয়, আমাদের দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশও রক্ষা পেয়ে যায়।

গত মঙ্গলবারের খবর। গত ডিসেম্বর মাসে প্রথমে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাস দেখা দেয়। চীনের সরকারি কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, করোনা ভাইরাস নিউমোনিয়ার মহামারী সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশে মাঝে মাঝে নিউমোনিয়া সংক্রমিত হয়ে থাকে। এ রোগে শিশুদের পাশাপাশি বয়স্ক মানুষও আক্রান্ত হন। চীনের উহান নগরীতে এক কোটি ১০ লাখ মানুষের বাস। সেখানে প্রথমে জানা গিয়েছিল ৬২ জন এতে আক্রান্ত হওয়ার খবর। গত সোমবার পর্যন্ত ১৩৬ জন এ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তবে করোনা ভাইরাসের শিকার অন্তত এক হাজার ব্যক্তি বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি, ব্রিটেনের বিশেষজ্ঞদের অভিমত, করোনাতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ শ’ মতো হবে।

পত্রিকায় যখন চীনের বাদুড় থেকে সাপ হয়ে করোনা ভাইরাস দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে, একই সময়ে খবর পাওয়া গেছে, বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। শীতের এমন দিনে এ দেশে অনেকেই খেজুরের রস কাঁচা খেয়ে থাকেন। বাদুড় রাতের বেলায় এ রস খাওয়ার জন্য খেজুরগাছে হানা দেয়। তাদের মুখ থেকে নিঃসৃত নিপাহ ভাইরাস খেজুরের রসে মিশে যায়। পরে যারা এটা খায়, তারা এ ভাইরাসের শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে পারেন। বাংলাদেশে নিকট অতীতেও নিপাহ ভাইরাস অনেকের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

করোনা ভাইরাসটি ২০০২ সালের দিকে এশিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়া ঝঅজঝ ভাইরাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেটিও আসলে একপ্রকার করোনা ভাইরাস। সেবার ওই জীবাণু দ্বারা আট হাজার ৯৮ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন আর প্রাণ হারান ৭৭৪ জন। জানা গেছে, করোনা ভাইরাস আছে অনেক প্রকার। এর মধ্যে মাত্র ৬ ধরনের ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে। এবারকার ভাইরাসটি করোনা বলে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া গেলে, তা হবে সপ্তম। বিশেষজ্ঞদের মতে, SARS ভাইরাসের সাথে সর্বশেষ ভাইরাসটির মিল বেশি।

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, ভাইরাস ছোঁয়াচে কি না, তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি আজো। কারণ, চীনের উহান নগরে যারা করোনা ভাইরাসের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকে মাছের বাজারে গেলেও এমন কয়েকজন রোগী আছেন যারা মাছ বা অন্য কোনো পণ্যের বাজারেই যাননি। এ দিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা নিয়েও কথা উঠেছে। কারণ জাতিসঙ্ঘের এ সংস্থা এখনো ‘বৃহৎ পরিসরে’ ভাবেনি করোনা নিয়ে। অপর দিকে, তারা নিজেরাই আশঙ্কা করেছেন, করোনা ভাইরাসটি একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়াতে পারে। যদি তা হয়, তা হলে বলতে হবে, করোনা ভাইরাস ছোঁয়াচে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়নি। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেছেন, শ্বাসতন্ত্রের অসুখে হাঁচিকাশি থেকেও সংক্রমণ ঘটে নতুন নতুন লোক আক্রান্ত হতে পারেন। তখন দ্রুত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ‘সাবধানের মার নেই।’ তাই এ মুহূর্তেই সবারই পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। এতে বিলম্ব ঘটলে পরে ক্ষতি পোষানো যাবে না।

করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পুরো দুনিয়াটা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উন্নতির কল্যাণে এত কাছাকাছি এসে গেছে যে, একে বলা হচ্ছে ‘বিশ্বগ্রাম’। বিশেষ করে বিমানযোগাযোগের কল্যাণে যেকোনো কিছু অতিদ্রুত সারা বিশ্বে প্রসার লাভ করছে। কোনো ক্ষতিকর জীবাণু কিংবা রোগব্যাধির বেলাতেও এ কথা সত্যি। চীনের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমানযোগাযোগ রয়েছে নিয়মিত। সে দেশের বহু নরনারী প্রতিদিন অন্যান্য দেশে যাতায়াত করছেন। তেমনি, অন্যান্য দেশের লোকজনও চীনে আসা যাওয়া করছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কথাটা বাস্তব। তাই ঢাকার শাহজালাল (রহ:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীন থেকে আসা যাত্রীদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা শুরু হয়েছে।

যাতে করোনা ভাইরাসের অনুপ্রবেশ বা সংক্রমণ না ঘটে এ দেশে, সে জন্যই এই সতর্কতা। গত সপ্তাহেই এই স্ক্রিনিং শুরু হয়ে গেছে হংকং, সিঙ্গাপুর, নিউ ইয়র্কসহ কয়েকটি বিশ্বখ্যাত বিমানবন্দরে। করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে চীনের উহান ও হুয়াংগংসহ অন্তত ১৩টি শহর কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। শহরগুলোর বাসিন্দারা কোথাও যেতে পারছেন না। এসব শহরের সাথে বাইরের পরিবহন যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ দিকে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের মিছিল হচ্ছে দীর্ঘ।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনা ভাইরাস আগে ছিল ‘জুন্যাটিক’, অর্থাৎ এটা আগে পশুপাখির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা মানুষকেও আক্রমণ করছে। তেমনি বার্ড ফ্লু বা অ্যাভিয়ান ফ্লু নামের মারাত্মক রোগ অতীতে শুধু হাঁস মুগরগিসহ পাখিদের মড়ক সৃষ্টি করত। পরে তা মানুষকেও টার্গেট করেছে। বিশেষ করে পোলট্রির (খামারের মুরগি) মল থেকে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। অথচ বাংলাদেশের পোলট্রিতে সাধারণত ডিম পরিষ্কার না করেই তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে আমরা অহরহ দোকানে দেখতে পাই মুরগির মল লেগে থাকা অসংখ্য নোংরা ডিম। মানুষ সেগুলোই কিনতে বাধ্য হয়ে থাকে।

যা হোক, করোনা ভাইরাসের কোনো ওষুধ এখনো উদ্ভাবন করা যায়নি। তাই এর সংক্রমণ প্রতিরোধ করাই উত্তম।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us