কালো গোলাপের সৌরভ
কালো গোলাপের সৌরভ - ছবি : অন্য দিগন্ত
রিনা বুবুর বিয়ের পর আজই তার শ্বশুরবাড়ি প্রথম এসেছি। নানা কারণে এই তিন বছর এখানে আসা হয়নি। যার সাথে রিনা বুবুর বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেই আতিক সাহেবের এটি দ্বিতীয় বিয়ে বলে আমার ঘোর দ্বিমত ছিল। আতিক সাহেবের আগের স্ত্রী দুই মেয়ে আর এক ছেলে রেখে ক্যান্সারে গত হয়েছেন। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর বাবা রিনা বুবুকে এই অসম পুরুষের সংসারে পাঠাতে রাজি হলেন। ফলে বাবার সাথে আমার এক ধরনের বিরোধ হয়। হোক আমার বোন অধিক বয়সের কিংবা গায়ের রং কালো, তাই বলে তাকে তো আর সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারি না।
আতিক সাহেবের সাথেই রিনা বুবুর বিয়ে হলো। বিয়ের আগে যেমন কিছু আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশী রিনা বুবুকে ‘আইবুড়ি’ বলে ব্যঙ্গ করত, বিয়ের পরও তারা অভিযোগ টেনে তাচ্ছিল্যে বলেছে, ‘কুমারি মেয়েকে তিন বাচ্চার বাপের কাছে বিয়ে দিয়েছে!’ ছোট চাচী তো মুখ ভেটকি মেরে বললেন, ‘অচল পয়সা তাহলে চলেছে!’
সবার এসব অবজ্ঞাময় কথা আড়াল থেকে কানে এলে আমার বুকটা ভেঙে খানখান হয়ে যেত। যেদিন আতিক সাহেব রিনা বুবুকে বিয়ে করে নিয়ে গেলেন, সেদিন সারারাত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেছি। ৩৬ বছর বয়সে রিনা বুবুর বিয়ে হয়েছে। এই সমাজ রিনা বুবুকে ‘আইবুড়ি’ বলে অনেকদিন বদনাম দিয়েছে। জন্মের পর থেকে রিনা বুবুর চেহারা অসুন্দর আর গায়ের রঙ কালো হওয়ার কারণে বাবা-মা মেয়েকে নিয়ে ঠেকে গেছেন। স্কুলে যাওয়ার বেলায় দুষ্ট ছেলেরা ‘মা কালি’ নামে ক্ষেপাত বলে রিনা বুবু সুশিক্ষিত হওয়ার আর স্বপ্ন দেখতে পারেনি। কালো হওয়ার কারণে তার বিয়ের সম্বন্ধগুলো একে একে বাতিল হতে হতে জীবনের পাল্লায় বয়স যখন ভারী হয়ে গেল, তখনই রিনা বুবু এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিলো, জীবনে আর বিয়ের কথাই ভাববে না।
কিন্তু অনেক পরে ঠিকই বিয়ে হয়েছে অসম পুরুষ আতিক সাহেবের সাথে।
রিনা বুবু আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বিচলিত গলায় বলল, ‘রঞ্জু তুই এসেছিস? এতদিনে বুবুকে দেখতে ইচ্ছে হলো! আয় ঘরে আয়।’ আমি ঘরে গেলাম। মুনমুন নামে এক তরুণী আমাকে বলল, ‘আপনি রঞ্জু মামা, ঠিক না?’ পাশের রুম থেকে মনিকা নামে প্রায় ১০ বছরের একটি মেয়ে দৌড়ে এসে রিনা বুবুকে বলল, ‘উনি কে আম্মা?’ রিনা বুবু বলল, ‘তোদের মামা। জানিস রঞ্জু, ওরা আমার দুই মেয়ে। ওরা আমাকে সৎমা মনে করে না। অনেক সম্মান দেয়।’ বলেই রিনা বুবু কেঁদে ফেলল।
দুলাভাই, মানে আতিক সাহেব বাড়ি নেই। ব্যবসার কাজে বগুড়া গেছেন। দুপুরে দারুণ রান্না করল রিনা বুবু। লতি দিয়ে ইলিশ মাছ, কবুতরের বাচ্চা, পটল ভাজা, গরুর ভুনা আর তিন পদের ভর্তা। রান্না দারুণ ছিল। প্রশংসা করতেই রিনা বুবু বলল, ‘ভর্তা কিন্তু আমার বড় মেয়ে মুনমুন করেছে। অনেক গুণ ওর। ইন্টারে পড়ে এবার। ছেলেরা ডিস্টার্ব করে বলে কলেজে দেই না।’ পাশ থেকে মুনমুন হি হি করে হেসে উঠল। মনিকা বলল, ‘মামা, আজ রাতে এখানে থাকতে হবে। রাতে আমাদের গান শোনাবেন। আম্মা বলেছে, আপনি নাকি ভালো গান পারেন।’ আমি আলতো করে হাসলাম। রিনা বুবু বলল, ‘রঞ্জু আমার কিন্তু একটা ছেলেও আছে। মোহন নাম। স্কুলে পড়ে। ফাইভে এখন।’
বিকেলে স্কুল থেকে মোহন এলো। রিনা বুবু মোহনের স্কুলব্যাগ সরিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসার তাগিদ দিলো। মোহন আমাকে দেখে বলল, ‘রঞ্জু মামা না আপনি?’ বললাম, ‘আমাকে তুমি কিভাবে চেনো?’ ফোকলা দাঁতে হেসে মোহন বলল, ‘আব্বুর মোবাইলে আপনার ছবি দেখেছি।’ রিনা বুবু বলল, ‘রঞ্জু, তোর দুলাভাইয়ের মোবাইলে তোর অনেক ছবি। ফেসবুক থেকে নিয়েছে। তোর সাথে অ্যাড আছেন। কিন্তু তুই তোর দুলাভাইকে চিনিস না। কখনো পরিচয় দেয়নি তোকে। আমরা রোজ রাতে শুয়ে শুয়ে তোকে ফেসবুকে দেখি। হা হা হা।’
রিনা বুবু হাসছে। আমার কান্না পেল খুব। আমার বোন এখানে কত সুখে আছে, যা আমি কল্পনাই করতে পারিনি। ভেবেছিলাম সতীনের সন্তানেরা তাকে জ্বালিয়ে মারবে, কিন্তু এখানে এসে ভিন্নজগত দেখলাম। আজ আমি অনেক সুখি। গায়ের রঙ কালো আর বদসুরতের কারণে নিন্দুকদের নিন্দার কাঁটা চিরকাল সয়ে যাওয়া আমার রিনা বুবু আজ কালো গোলাপ হয়ে এই সংসার বাগানকে সৌরভে মাতিয়ে রেখেছে। আজ আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
মোহন হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসল। কিন্তু সে নিজ হাতে খাবে না। খাইয়ে দিতে হবে। রিনা বুবু মোহনকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে আর আমাকে বলছে, ‘ওকে রোজ খাইয়ে দিতে হয় রঞ্জু। আমার হাত ছাড়া খাবে না। দেখলি কাণ্ড! হা হা হা।’
মোবাইল বাজছে। আতিক সাহেবের কল এসেছে। মুনমুন মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। কিছুক্ষণ পর এসে রিনা বুবুকে বলল, ‘আম্মা, আব্বু জানতে চাইছে আপনি বগুড়ার দই খাবেন কি না! আনতে বলি?’ রিনা বুবু মোহনের মুখে ভাতের লোকমা ভরে দিতে দিতে বলল, ‘না, লাগবে না। টাকা খরচ করে দূর থেকে কষ্ট করে এসব আনার দরকার নেই।’
আমি উঠোনে চলে এলাম। আমগাছের তলে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকাই। আজ সুন্দর সুন্দর মেঘ ভাসছে আকাশে। কোনো কোনো মেঘ দ্রুত উড়ে এসে আরেক মেঘকে ঢেকে দেয়। মেঘেদের আজ কিসের এত আনন্দ কে জানে! নাকি আমার রিনা বুবুর দাম্পত্য জীবনের এত সুখ দেখে মেঘেরা আজ মনের সুখে নাচন করছে!
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী