ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সমস্যায় ভারত!

সুবীর ভৌমিক | Jan 23, 2020 08:37 pm
নরেন্দ্র মোদি

নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত

 

ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য থেকে ১৯৪৭ সালে সৃষ্টির পর থেকে ভারতীয় ফেডারেশন এখনই সবচেয়ে বড় ‘ফেডারেল সঙ্কটে’ পড়েছে। এখন পর্যন্ত ১২টি রাজ্য সরকার নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) প্রতি তাদের বিরোধিতার কথা ঘোষণা করেছে। উল্লেখ্য, এই আইনে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়া নির্যাতিত অমুসলিম সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।

তারা বলছে যে এই সংশোধনী ভারতের সেক্যুলার মূল্যবোধকে আঘাত হেনেছে, এ কারণে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেরালার বামপন্থী সরকার ইতোমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কংগ্রেস-শাসিত পাঞ্জাবের মতো অন্যান্য রাজ্যও একই পরিকল্পনা করছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আসামে প্রয়োগ করার পর অনেক রাজ্য অবশিষ্ট ভারতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বাস্তবায়নের বিরোধিতা করেছে। এনআরসি হালনাগাদ করার ফলে প্রায় ২০ লাখ লোক তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, এদের বেশির ভাগই বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম। তারা নাগরিকত্ব হারানোর শঙ্কায় রয়েছে।

মাক্সর্সবাদী নেতা ও কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সচিব প্রকাশ কারাত বলেন, আর ১০টি রাজ্য যদি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও এনআরসির বিরোধিতা করে এবং জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধনের (এনপিআর, যা এনআরসির প্রারম্ভিক পর্ব বিবেচিত হচ্ছে) বিরোধিতা করে তবে এসব বিতর্কিত আইন বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ করার বিজেপির পরিকল্পনা চিরদিনের মতো মাটিচাপা পড়বে।

কারাত বলেন, নরেন্দ্র মোদি সরকার সংবিধানের বিরুদ্ধে ‘ত্রিশূলের’ পরিকল্পনা করছে। এর প্রথমটি হলো সিএএ, দ্বিতীয়টি এনপিআর, তৃতীয়টি এনআরসি। তিনটিই পরস্পরের সম্পর্কযুক্ত।
এই বিশাল ফেডারেল সঙ্কটের কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা দলের (বিজেপি) অবস্থান সঙ্কোচিত হওয়া। ভারতের বর্তমানে রয়েছে ২৮টি রাজ্য ও ৯টি কেন্দ্রশাসিত ইউনিয়ন টেরিটরি (ইউটি)। দুটি ইউটির তথা পুদুচেরি (সাবেক পন্ডিচেরি) ও জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের (দিল্লি) আইনসভা রয়েছে।
বিজেপি ও এর মিত্ররা এখন ১৪টি রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে : উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা (জেজেপির সাথে), গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, বিহার (জেডি-ইউর সাথে), আসাম (এজিপি ও বিপিএফের সাথে), মেঘালয় (এনপিপির সাথে), মনিপুর (ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, নাগা পিপলস ফ্রন্ট, লোক জনশক্তি পার্টির সাথে), নাগাল্যান্ড (এনডিপিপি), ত্রিপুরা (আইএনপিটির সাথে), অরুনাচল প্রদেশ, গোয়া (গোয়া ফরোয়ার্ড পার্টি ও এমজিপির সাথে) হিমাচল প্রদেশ ও কর্নাটক।
কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ করে সাতটি রাজ্য : পাঞ্জাব, পদুচেরি, ছত্তিশগড়, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র (শিবসেনা ও এনসিপির সাথে), ঝাড়খন্ড (ঝাড়খন্ড মুক্তি মরচান্দ আরজেডির সাথে)।
৯টি রাজ্য আঞ্চলিক দলগুলো শাসন করে : দিল্লি- আম আদমি পার্টি, পশ্চিমবঙ্গ- তৃণমূল কংগ্রেস, তামিল নাড়ু- এআইএডিএমকে, অন্ধ্র প্রদেশ- ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানা- তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি, কেরালা- সিপিআই (এম)-নেতৃত্বাধীন লেফট ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট, উডিশা- বিজুজনতা দল, মিজোরাম- মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট, সিকিম- সিকিম ক্রান্তিকারি মোর্চা।

বিজেপির বেশির ভাগ মিত্রও সিএএ ও এনআরসির কোনো একটির বা দুটিরই বিরোধিতা করছে বিজেপির মিত্র হিন্দি বেল্টের রাজ্য বিহারের নিতিশ কুমার কঠোরভাবে এনআরসির বিরোধিতা করছেন, তার দল সিএএর বিরুদ্ধেও অবস্থান গ্রহণ করেছে।
নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলটি ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে পাস হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাওয়ার পর বিলটি নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন (সিএএ) ২০১৯ হিসেবে পরিচিতি পায়। এর পরই সিএএ, এনআরসি ও এনপিআরের তীব্র বিরোধিতা শুরু হয় ভারতজুড়ে।
এরপর পরই দেখা দেয়া ছাত্র ও নগারিকদের বিক্ষোভ নৃশংসতার শিকার হয়। গেরুয়া ব্রিগ্রেডের গুন্ডারা পুলিশের সাথে যোগ দিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয়। ভারতজুড়ে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় অনেক রাজ্য সরকার বিতর্কিত সিএএ-এনআরসি-এনপিআরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার ও তার দল জনতা দল (ইউনাইটেড) (জেডি-ইউ) হলো বিজেপির মিত্র। জেডি-ইউ পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরোধিতা করেছে। এর পর থেকে ভারতব্যাপী বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে নিতিশ কুমার বিহারে এনআরসির বাস্তবায়নের বিরোধিতা করছে। গত সোমবার রাজ্য বিধান সভায় বক্তৃতাকালে তিনি এ নিয়ে আলোচনার কথা বলেন। তিনি বলেন, বিহারে এনআরসির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তিনি আরো উল্লেখ করেন, এনআরসি কেবল আসামের প্রেক্ষাপটে প্রবর্তন করা হয়েছিল, পুরো দেশের জন্য নয়। জেডি-ইউ অবশ্য প্রস্তাবিত এনপিআরের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেনি।

জরিপ বিশেষজ্ঞ থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া প্রশান্ত কিশোর (তিনি জেডি-ইউর সাথে রয়েছেন) আনুষ্ঠানিকভাবে সিএএ ও এনআরসি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করার জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বের, বিশেষ করে রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গন্ধীকে ধন্যবাদ জানান। এর আগে তিনি কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব রাজ্যে তারা যেন এনআরসি প্রত্যাখ্যান করেন। নিতিশের টুইটের সূত্র উল্লেখ করে কিশোর বলেন, বিহারে সিএএ ও এনআরসি বাস্তবায়ন হবে না।

মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথও সিএএর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি সম্প্রতি সংবাদপত্রে বলেছেন যে তার সরকার এমন কিছু বাস্তবায়ন করবে না যা সমাজকে বিভক্তি করে বা বিভক্ত করার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। এর মাত্র এক দিন আগে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর নিয়ে আলোচনা করে। ওই সভায় কংগ্রেসের সভানেত্রী সনিয়া গান্ধী এনপিআরকে এনসিআরের ছদ্মবেশ হিসেবে অভিহিত করেন।
কংগ্রেসের নেতা আনন্দ শর্মা ওই বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, সিএএ ও প্রস্তাবিত এনআরসি দেশে ভয় আর উদ্বেগের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে সমাজের ধর্মীয় ও ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘু, আদিবাসী, গরিব, অসহায়দের মধ্যে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সিএএ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে, এনআরসি বাস্তবায়ন বন্ধ করতে আহ্বান জানাচ্ছে।
কংগ্রেস ক্ষমতায় আছে পাঞ্জাব, রাজস্তান, মধ্য প্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে। তারা মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে ক্ষমতাসীন জোটের অংশ।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মহারাষ্ট্র কংগ্রেসের নেতা ও রাজ্য রাজস্ব মন্ত্রী বালাসাহেব থোরাট জোরালোভাবে বলেন যে রাজ্য সিএএ ও এনআরসি বাস্তবায়ন করবে না। রাজ্যের বিধান সভার নির্বাচন এগিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন সংকল্প ব্যক্ত করেছেন যে তিনি ক্ষমতায় এলে সিএএ ও এনআরসি পর্যালোচনা করবেন।
এখন পর্যন্ত কংগ্রেস ও এর মিত্ররা তাদের রাজ্যগুলোতে সিএএ-এনআরসি বাস্তবায়ন না করার ব্যাপারে সোচ্চার। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সিএএ ও এনআরসি প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান এখনো হয়নি। অবশ্য কেরালা বা পশ্চিমবঙ্গের বিষয়টি ভিন্ন। এই দুটি রাজ্য বিজেপিও নয়, কংগ্রেসও নয়।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারায়ি বিজায়ন রাজ্য বিধান সভায় একটি প্রস্তাব পাস করেন। এতে তিনি সিএএ বাতিল করার দাবি জানান। তিনি বলেন, এটি সংবিধানের নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি আশ্বাস দেন, তার রাজ্যে কোনো আটক কেন্দ্র হবে না।
পশ্চিমবঙ্গও স্পষ্টভাবে বলেছে, তারা এনআরসি, এনপিআর বাস্তবায়ন করবে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সিএএর বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি সিএএ ও এনআরসির বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার। গত মাসে এনপিআরের সাথে সম্পর্কিত সব কার্যক্রম স্থগিত করে পশ্চিমবঙ্গ।
এমনকি বিজেপি শাসিত রাজ্য আসাম ও ইউপিতেও সিএএর বিরুদ্ধে বিপুল বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে পুলিশের গুলিতে অনেক নিহত হয়েছে। সেখানে পুলিশ সন্ত্রাস চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিজেপি বলছে যে রাজ্যগুলো পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে পাস হওয়া কোনো আইন বাস্তবায়ন না করে থাকতে পারে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, সিএএ থেকে সরে আসার কোনোই সুযোগ নেই। তিনি অবশ্য এনআরসি থেকে কিছুটা পিছু হটেছেন।

অমিত শাহ বলেছেন, সিএএ ডিজিটাল মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে অনলাইনে আবেদনপত্র সংগ্রহের মাধ্যমে। কিন্তু মমতা বলেছেন, তা সম্ভব নয়। কারণ আবেদন তো যাচাই করতে হবে। সেগুলো কে করবে?
স্বাধীনতার পর থেকে ভারত আর কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েনি। রাজ্যগুলো মাঝে মাঝেই কেন্দ্রীয় আইনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কিন্তু কখনো এত সংখ্যায় পার্লামেন্টে পাস হওয়া আইন বাস্তবায়নে বিরোধিতা করেনি। অথচ বিজেপি বিপুল ব্যবধানে পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, উচ্চকক্ষে তাদের অবস্থান সংহত করেছে। এ কারণেই সিএএ পাস করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মহারাষ্ট্রের মতো অনেক রাজ্যে পরাজয় রাজ্যগুলোর ওপর বিজেপির নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে দিযেছৈ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক রনবির সমাদ্দার বলেন, এটা নজিরবিহীন সঙ্কট। এটি ভারতের ফেডারেল কাঠামো নিয়েই মারাত্মক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, কেন্দ্র-রাজ্য উত্তেজনা নতুন নয়, তবে তা কখনো কোনো সঙ্কটজনক অবস্থায় উপনীত হয়নি। এর মূল কারণ বিজেপির সমঝোতার রাজনীতি পরিত্যাগ করে যেকোনো উপাযে তার বিভেদমূরক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us