ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসার ৫ পদ্ধতি
ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসার ৫ পদ্ধতি - ছবি : সংগৃহীত
মিনিম্যাল সার্জারি
ক্যান্সার ধরা পড়ার পর চিকিৎসার প্রথম পদক্ষেপ হলো সার্জারি। সেক্ষেত্রে একটা কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, অপারেশন এখন অনেক রোগীমুখী হয়েছে। এখন ‘মিনিম্যাল সার্জারি’র সময়। অর্থাৎ যতটা সম্ভব কম কাটাছেঁড়া করে রোগ সারিয়ে তোলা যায়। উদাহরণ হিসেবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের কথা বলা যায়। আগে এই ক্যান্সার হলে, সমগ্র ব্রেস্ট বাদ দিতে হতো। ফলে চিকিৎসার পরেও, তৈরি হতো রোগীর মানসিক সমস্যা। বিশেষ করে, ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা হওয়ার পরে যাঁরা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ও ব্রেস্টফিডিং করাতে পারেননি, তাদের ক্ষেত্রে পুরনো পদ্ধতিতে সার্জারি ছিল পীড়াদায়ক। তবে আধুনিক নানা বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে শুধু টিউমার ও কিছু গ্ল্যান্ড বাদ দিলেই চলে। অবশ্য, ব্রেস্ট ক্যান্সার কোন পর্যায়ে রয়েছে তার ওপরেও নির্ভর করে আদৌ সমগ্র ব্রেস্ট বাদ দিয়ে অপারেশন করাতে হবে নাকি শুধু টিউমারটুকু বাদ দিলেই চলবে।
তবে শুধু ব্রেস্ট ক্যান্সার নয়, অন্যান্য কিছু অঙ্গে সার্জারির ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। এছাড়া ইউটেরাইন ক্যান্সারের মতো সমস্যায় বা পেটের ভিতরের টিউমারের ক্ষেত্রে আগে পেট ওপেন করতে হতো। এখন ল্যাপেরোস্কোপির সাহায্যে পেটে চারটে ফুটো করে সমগ্র টিউমার সহ আশপাশের গ্ল্যান্ড বাদ দেয়া যায়। ক্যান্সারের রোগীর অপারেশনের ধকল কয়েকগুণ কম হয়!
রোবোটিক সার্জারি
এখানেই শেষ নয়। মানব শরীরের বেশ কিছু জায়গায় অপারেশনের জন্য সার্জেনের আঙুল পৌঁছনোর সুযোগ ছিল না। আবার কিছু কিছু জায়গায় আঙুল পৌঁছলেও সার্জেন তাঁর ইচ্ছেমতো বা সুবিধামতো কুশলী হাতের ব্যবহার করতে পারতেন না। এই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে রোবোটিক সার্জারি। উদাহরণ হিসেবে প্রস্টেট ক্যান্সার সার্জারির কথা বলা যায়। প্রস্টেট ক্যান্সারের অপারেশন করার সময় একজন সার্জেনের পক্ষে ক্যান্সার আক্রান্ত প্রস্টেট ও তার আশপাশের রোগগ্রস্ত কোষগুলিকে বের করা বেশ জটিল ছিল। অথচ রোবোটিক আর্ম বা রোবটের হাত ঘুরতে পারে ৩৬০ ডিগ্রি অবধি। তাই সময়সাপেক্ষ অপারেশনও দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে করা যাচ্ছে।
লেজার সার্জারি
শুধু রোবট নয়, এখন লেজারের সাহায্যেও ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ-কলা বাদ দেওয়া যায়। বিশেষ করে মুখের বিভিন্ন আলসারের সমস্যায় লেজারের সাহায্যে অপারেশন করা যায়। এমনকী কোনো রক্তপাতও হয় না। লেজার সার্জারির আরও একটা বড় দিক হলো, খুব নিখুঁতভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত জায়গার সার্জারি করা যায়। আলাদা করে বিরাট ক্ষত তৈরি হয় না।
ইমেজ গাইডেড রেডিওথেরাপি
এখন ক্যান্সারের চিকিৎসায়, কম্পিউটার ও সফটওয়্যারের সাহায্যে প্রয়োগ করা হচ্ছে ইমেজ গাইডেড রেডিওথেরাপি (আইজিআরটি)। এছাড়াও আছে ইনটেনসিটি মডিউলেটর রেডিওথেরাপি (আইএমআরটি)।
আইজিআরটি প্রক্রিয়ায়, রেডিওথেরাপির মাধ্যমে টিউমার যত ছোট হয়, রেডিওথেরাপির রশ্মি প্রয়োগের পরিধিও ততটাই কমতে থাকে। আবার, রেডিয়েশন মেশিনের সঙ্গে এক্স-রে যন্ত্রও সংযুক্ত থাকে। ফলে রেডিয়েশন প্রয়োগের মেয়াদকালে (ছয় সপ্তাহ) এক্স-রে যন্ত্রের সাহায্যেই বোঝা সম্ভব হয়, টিউমার কতখানি ছোট হয়েছে! এই প্রযুক্তির সাহায্যে টিউমারের আশপাশের জরুরি অঙ্গ ও কোষে রেডিয়েশন থেরাপির কু’প্রভাব পড়ে না। চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম হয়।
অন্যদিকে আইএমআরটি পদ্ধতিতে, টিউমার বৃত্তাকার হোক বা ত্রিভূজাকার, সেই আকার অনুযায়ী রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা যায়। আর আগের মতো বাধ্যতামূলকভাবে চৌকো অংশেই রেডিওথেরাপি প্রয়োগের প্রয়োজন থাকে না! কলিমেটরস নামে একটি বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে সমগ্র প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। একইসঙ্গে এই ব্যবস্থার সাহায্যে টিউমারের বিভিন্ন জায়গায় ‘রশ্মির’ ডোজের তীব্রতাও ভিন্নভাবে প্রয়োগ করা যায়। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরা যাক, টিউমারের একটি অংশে একশো শক্তির ডোজ দেওয়ার দরকার, আর অন্য জায়গায় কুড়ি শক্তির ডোজ দিলেই চলবে। আগে এইভাবে একই টিউমারের ওপরে ভিন্ন শক্তির ডোজ প্রয়োগ সম্ভব ছিল না। এখন তা করা যায়। ফলে সুস্থ কোষগুলির ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়।
ব্র্যাকি থেরাপি
এখানেই শেষ নয়। জরায়ু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রেডিয়েশন দিতে হলে ব্যবহৃত হয় ‘ব্র্যাকি থেরাপি’। আগে সিটি স্ক্যান করে কোন জায়গায় ব্র্যাকি থেরাপি প্রয়োগ করা হবে তার পরিকল্পনা করা হতো। এখন করা হয় অত্যাধুনিক এমআরআই। ফলে ব্র্যাকি থেরাপিতে অনেক ভালো ফল পাওয়া যায়।
টার্গেটেড বা বায়োলজিক্যাল কেমোথেরাপি
কেমোথেরাপির ক্ষেত্রেও বহু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এখন রোগীকে কেমোথেরাপি দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য নেওয়া হয় টার্গেটেড থেরাপি বা বায়োলজিক্যাল থেরাপির। অর্থাৎ নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করে তারপর চিকিৎসা। প্রশ্ন হল কীভাবে কাজ করে এই থেরাপি? শরীরের কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন হচ্ছে তা জানা ও সেখান থেকে ক্যান্সার সহায়ক কোনও রাসায়নিক নির্গত হচ্ছে কি না তা বোঝা খুব জরুরি। ক্যান্সারের উৎসমুখ জানতে পারলেই চিকিৎসা সহজ হয়ে যায়। এখন টার্গেটেড কেমোথেরাপি বা বায়োলজিক্যাল থেরাপিতে বিশেষ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ওষুধগুলি সরাসরি ওই উৎসমুখে আঘাত হানে। ফলে সুস্থ কোষ ও কলার কোনও ক্ষতি হয় না।
ইমিউনোথেরাপি ও হর্মোনথেরাপি
বহু ক্যান্সারের সঙ্গেই শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে শরীরের ক্যান্সার বাসা বাঁধার সুযোগ পায়। সেক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা জোরদার করতে পারলে, শরীরে ক্যান্সার থাবা বসানোর সুযোগ পাবে না। এমনকী ক্যান্সার হলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারবে না। এই কারণে ‘ইমিউনোথেরাপি’ নামে বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ইঞ্জেকশন ও ট্যাবলেটের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা হয়। কার্যকরী এই থেরাপি কেমোথেরাপির পাশাপাশি, এমনকী কেমোথেরাপির পরেও ইমিউনোথেরাপি করা হয় যা ক্যান্সারের প্রসার রোধ করে ও ক্যান্সারের ফিরে আসাও আটকায়।
হর্মোন থেরাপি
রয়েছে হর্মোন থেরাপিও। হর্মোন থেরাপি আগেও ছিল, তবে আজকাল প্রচুর নতুন ওষুধ এখন পাওয়া যাচ্ছে যা এই পদ্ধতিকে আরও উন্নত করেছে। বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসার হর্মোন থেরাপি যথেষ্ট কার্যকর।
লেখক : আর জি কর ও এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপি’র সাবেক প্রধান
সূত্র : বর্তমান