কেমোথেরাপি’র নতুন পদ্ধতি : ক্যান্সার রোগীদের জন্য সুখবর

ডা. সৌমেন দাস | Jan 23, 2020 10:15 am
কেমোথেরাপি’র নতুন পদ্ধতি : ক্যান্সার রোগীদের জন্য সুখবর

কেমোথেরাপি’র নতুন পদ্ধতি : ক্যান্সার রোগীদের জন্য সুখবর - ছবি : সংগৃহীত

 

আমাদের পেটের অন্দরে একটি পর্দার মতো আস্তরণ রয়েছে। এর নাম হলো পেরিটোনিয়াম। এর মধ্যেই থাকে যকৃৎ, পাকস্থলী, প্লীহা, অগ্ন্যাশয়, খাদ্যনালী ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এবার শরীরের অন্যান্য অংশের মতো পেরিটোনিয়ামও ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি, দুই ধরনের পেরিটোনিয়াল ক্যান্সার হয়। পেরিটোনিয়াম সরাসরি নিজে ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে প্রাইমারি পেরিটোনিয়াল ক্যান্সার বলা হয়। আবার অগ্ন্যাশয়, অন্ত্র, ওভারিয়ান, পাকস্থলী বা পেটের অন্যান্য অংশের ক্যান্সারও পেরিটোনিয়ামে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধরনের ক্যান্সারকে সেকেন্ডারি পেরিটোনিয়াল ক্যান্সার বলে। তবে প্রাইমারির তুলনায় সেকেন্ডারি ক্যান্সারেই তুলনামূলকভাবে পেরিটোনিয়াম বেশি আক্রান্ত হয়।

সমস্যা হলো, কিছু বছর আগেও পেরিটোনিয়ামে ক্যান্সার হলে চিকিৎসার সুযোগ ছিল কম। প্রাণহানির হারও ছিল বেশি। ক্যান্সার চিকিৎসার মোক্ষম অস্ত্র কেমো শরীরের এই অংশে ভালোভাবে কাজ করতে পারত না।
সাধারণত রক্তনালীর মধ্যে সরাসরি কেমো দেয়া হয়। এবার সেই কেমো রক্তের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অংশে পৌঁছে সেখানকার ক্যান্সার কোষগুলিকে নষ্ট করে দেয়। এভাবেই কেমোথেরাপি কাজ করে। তবে পেরিটোনিয়ামে রক্তচলাচল ভীষণ সীমিত। ফলে রক্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ কেমো এখানে পৌঁছাতে পারে না। আর পর্যাপ্ত পরিমাণে কেমো না পৌঁছাতে পারার কারণে ক্যান্সার কোষগুলোকে মেরে ফেলা সম্ভব হয় না। তবে এখন পেরিটোনিয়াল ক্যান্সারের চিকিৎসা করা সম্ভব হাইপেক ও পাইপেক পদ্ধতিতে।

* হাইপেক— এর পুরো কথা হল, হাইপার থারমিক ইন্ট্রাপেরিটোনিয়াল কেমোথেরাপি। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে সার্জারি করে পেটের অন্দরের যেই যেই অংশে ক্যান্সার কোষ রয়েছে, সেগুলির অধিকাংশই বের করে ফেলা হয়। এই সার্জারিকে বলা হয় সিআরএস বা সাইটো রিয়্যাকটিভ সার্জারি (সিআরএস)। ধরা যাক, কোনো মানুষের অন্ত্রের ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে পেরিটোনিয়ামে। এবার সিআরএস-এর মাধ্যমে অন্ত্রের এবং পেরিটোনিয়ামের ক্যান্সার কোষগুলিকে বাদ দেয়া হয়। তবে এই সার্জারি হওয়ার পরও কিছু ক্যান্সার কোষ ওই নির্দিষ্ট অংশে থেকে যেতে পারে। সেই সমস্যা সমাধানে সার্জারির পরই রোগীর পেটের ওপেন অবস্থাতেই উষ্ণ কেমো প্রবেশ করানো হয়। এক্ষেত্রে হাইপেক যন্ত্রের মাধ্যমে পেটের একটি অংশ দিয়ে কেমো প্রবেশ করে অন্য একটি অংশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এভাবে গোটা পেটে কেমো ছড়িয়ে দেয়া হয়ে থাকে। ফলে সার্জারির পরও বেঁচে যাওয়া ক্যান্সার কোষগুলো এরপর ধ্বংস হয়। কেমোথেরাপি সম্পূর্ণ হওয়ার পরই রোগীর পেট জুড়ে দেয়া হয়। এরপর রোগীকে অ্যানাস্থেশিয়া থেকে ফিরিয়ে এনে এক থেকে দুই দিন আইসিইউ-তে রাখা হয়। সার্জারি এবং কেমো মিলিয়ে হাইপেক করতে প্রায় আট-নয় ঘণ্টা সময় লাগে।

হাইপেক পদ্ধতির অনেকগুলো লাভ রয়েছে। প্রথমত, এই পদ্ধতিতে একই সময়ে সার্জারি করা এবং কেমো দেয়া হয়ে থাকে। ফলে রোগীর ক্যান্সার কোষগুলোর বিনাশ হয়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর আগামী দিনে কোনো কেমো লাগে না। দ্বিতীয়ত, পেটের অন্দরে সরাসরি কেমো দেওয়ার ফলে সব জায়গায় পর্যাপ্ত পরিমাণে কেমো পৌঁছয়। এর ফলে কেমো সঠিকভাবে নিজের কাজ করতে পারে। তৃতীয়ত, এক্ষেত্রে পেটের অন্দরে গরম কেমো প্রবেশ করানো হয়। প্রশ্ন হল, কেন গরম কেমো? বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গরম অবস্থা নিজেই ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। এছাড়া, অ্যাবডোমিনাল ক্যান্সারে ব্যবহৃত কেমো ৪১ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতায় সবথেকে ভালো কাজ করে। তাই হাইপেক যন্ত্র ব্যবহার করে ৪১ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতায় কেমো গরম করে শরীরে প্রবেশ করানো হয়।

হাইপেকের অনুপস্থিতিতে আগে এই রোগের তেমন কোনও চিকিৎসাই ছিল না। এই চিকিৎসা পদ্ধতি আসার পর রোগী অনেকসময়ই সুস্থ জীবন পাচ্ছেন।

পাইপেক— রোগী ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা সার্জারির ধকল নিতে পারবেন না, বয়স অনেকটাই বেশি, পেটের গুরুত্বপূর্ণ রক্তবাহী নালীগুলিতে ক্যান্সার ছড়িয়ে গিয়েছে ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সিভিয়র প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি পেরিটোনিয়াল ক্যান্সারের সাইটো রিয়্যাকটিভ সার্জারি করে ক্যান্সার কোষগুলোকে বের করে আনা সম্ভব হয় না। ফলে হাইপেক আসার পরও এই ধরনের রোগীদের বিশেষ কোনো সুবিধা হতো না। এই সমস্যার সমাধানেই এসেছে অত্যাধুনিক পাইপেক বা প্রেশারাইজড ইন্ট্রাপেরিটোনিয়াল এরোসল কেমোথেরাপি। এক্ষেত্রে রোগীর পেটের মধ্যে দু’টি ছিদ্র করে ক্যামেরা প্রবেশ করিয়ে সেখানকার অবস্থা সম্বন্ধে ধারণা করা হয়। এরপর পাইপেক মেশিনের মাধ্যমে তরল কেমোকে বাষ্পে (এরোসল) পরিণত করা হয়। তারপর পেটের ওই ছোট দু’টি ছিদ্রর মধ্যে পাইপেক যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা এরোসল হাই প্রেশারে প্রবেশ করানো হয়।

এবার প্রশ্ন হতেই পারে, কেন এরোসল উচ্চচাপে প্রবেশ করানো হয়? এক্ষেত্রে উচ্চ চাপে এরোসল অবস্থায় কেমো দিলে অনেক গভীরের ক্যান্সার কোষগুলোতেও কেমো পৌঁছাতে পারে। অন্যদিকে তরল কেমো এতটা গভীরে পৌঁছাতে পারে না। এভাবে পাইপেকের মাধ্যমে কেমো দেওয়ার পর রোগীর অবস্থার বেশ কিছুটা উন্নতি হয়। রোগীর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর অবশ্য সার্জারি করে অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষগুলোকে বের করে দেয়া যায়। আবার প্রয়োজনে পাইপেকের পর হাইপেক পদ্ধতিরও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অত্যাধুনিক পাইপেক সার্জারি আসার পর গুরুতর পেরিটোনিয়াল ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেক রোগীরই প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া গেছে।

লেখক : নেতাজি সুভাষচন্দ বসু ক্যান্সার হাসপাতালের সার্জিক্যাল অঙ্কোলজি বিভাগের চিফ কনসালটেন্ট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us