জীবন-মৃত্যুর মাঝে তিন মিনিটের প্রহরী
জীবন-মৃত্যুর মাঝে তিন মিনিটের প্রহরী - ছবি : সংগৃহীত
সে এক অদ্ভুত সময়। সার্জারি বা শল্য চিকিৎসা তখন দুর্লভ। আর ব্যথাহীন শল্য চিকিৎসা— নৈব নৈব চ। প্রভূত পরিমাণ অ্যালকোহল আর প্রচুর আফিম—অ্যানাস্থিয়ার উপকরণ বলতে এইটুকু মাত্র। তারপর এলো ১৮৪০ সাল। ম্যাসাচুসেটস হসপিটালে ডব্লু টি জে মোর্টোন প্রথম সারা পৃথিবীকে দেখালেন ইথার দিয়ে সার্জারি। মানুষ জয় করল ব্যথাকে। আর থেমে থাকা নয়। সারা পৃথিবীতে শল্য চিকিৎসা এগিয়ে চলল দুর্বার গতিতে।
কিন্তু হঠাৎই গতি গেল থমকে। দেখা গেল, বহু মানুষই অপারেশন চলাকালীনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। খোঁজ খোঁজ ‘অপরাধীকে’। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা গেল, জীবন আর মৃত্যু—তার মাঝের তিন মিনিট সময়ই হলো প্রধান অপরাধী। কোনো কারণে যদি মস্তিষ্কে তিন থেকে পাঁচ মিনিট অক্সিজেন না পৌঁছয়, তাহলে সেই মস্তিষ্ক চিরকালের জন্য মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে যাবে। যে অবস্থাকে এখন সবাই চেনে ‘ব্রেন ডেথ’ নামে।
তাহলে কে নেবে সেই তিন মিনিটের দায়িত্ব? কে আগলে রাখবে প্রাণ? ডাক পড়ল অ্যানেস্থেটিস্ট অথবা অজ্ঞানবিদ্যা বিশারদের। তারাই হলেন জীবন ও মৃত্যুর মাঝের অতন্দ্রপ্রহরী।
একটি ঘটনার কথা বলা যাক। মধ্য হাওড়ার ছোট এক হাসপাতাল। রাত দু’টা। অপারেশন টেবিলে সন্তানসম্ভবা মা। সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য সবাই প্রস্তুত। মায়ের শিরদাঁড়ায় সার্জারি হয়েছে আগে, তাই গলায় নল পরিয়েই জেনারেল অ্যানাসথেসিয়া করতে হল। তারপর হঠাৎই সব মনিটর এলোমেলো। অক্সিজেন পৌঁছাচ্ছে না মায়ের মস্তিষ্কে। চরম অশনি সঙ্কেত। মা- বাচ্চা দু’জনের প্রাণ নিয়ে টানাটানি।
স্থির সঙ্কল্পে দৃঢ় হলেন সেই অতন্ত্রপ্রহরী। একটিই মাত্র নির্দেশ—‘অতি দ্রুত বাচ্চাকে বের করুন।’ চলল অসমযুদ্ধ। অক্সিজেনের অভাবে নীল হয়ে আসছে মুখগহ্বর। হারলে চলবে না তার। সময় নেই, হাতে একেবারেই সময় নেই। অ্যানাফাইলেটিক শক-এ চলে যাচ্ছে মা।
এভাবে চললে সেই মা আর কোনো দিন তার সন্তানের কান্না শুনতে পারবে না, পারবে না তাকে আদর করতে। হারলে চলবে না, হাতে সময় নেই। চলল একের পর এক ওষুধের প্রয়োগ, চলল সিপিআর। এক চুল ভ্রান্তির অবকাশ নেই।
ধীরে ধীরে নীল শরীর স্বাভাবিক হতে থাকল। আবার অক্সিজেন পৌঁছচ্ছে মস্তিষ্কে। আর যুদ্ধ জয়ের নায়িকা যখন হাসপাতালের বাইরের গুমটিতে বসে তৃপ্তির চা খাচ্ছেন, ভোরের পাখিরা তখন ডাকাডাকি শুরু করেছে। কুর্নিশ জানাই সেই তিন মিনিটের অতন্দ্রপ্রহরী—অজ্ঞান বিদ্যা বিশারদকে!
সহযোগী অধ্যাপক, অ্যানাস্থেসিওলজি । পিজি হাসপাতাল
সূত্র : বর্তমান