ভারতের জন্য অশনি সঙ্কেত
ভারতের জন্য অশনি সঙ্কেত - ছবি : সংগৃহীত
গত ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্ট নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাস হওয়ার পর থেকে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ হচ্ছে। এর কারণ অনেক। বিক্ষোভকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন নির্ভর করছে, ওই রাজ্যে কোন দল সরকার পরিচালনা করছে।
১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনীর ফলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে পালিয়ে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর জন্য ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এ সংক্রান্ত যে গ্যাজেট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ধর্মীয় নির্যাতনের কথাটি উল্লেখ নেই। আবার এই ব্যবস্থায় ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হচ্ছে না মুসলিমেরা। ভারতে এই প্রথম ধর্মীয় বিবেচনায় নাগরিকত্ব মঞ্জুর করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অবশিষ্ট ভারত থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বৈশিষ্ট্য ও মাত্রা ভিন্ন। সিলিগুড়ি করিডোর তথা ‘চিকেন নেক’ নামের ২১ থেকে ৪০ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট ভারত থেকে আলাদা থাকা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সমান্ত রয়েছে ৫,১৮২ কিলোমিটার (যা মোট ভৌগোলিক সীমানার প্রায় ৯৯ ভাগ)।
এর মধ্যে উত্তর দিকে ১,৩৯৫ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে চীনের তিব্বত স্বায়াত্তশাসিত এলাকার সাথে। আর পূর্ব দিকে মিয়ানমারের সাথে রয়েছে ১,৬৪০ কিলোমিটার, দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশের সাথে রয়েছে ১,৫৯৬ কিলোমিটার, পশ্চিমে নেপালের সাথে রয়েছে ৯৭ কিলোমিটার, উত্তর-পশ্চিমে ভুটানের সাথে রয়েছে ৪৫৫ কিলোমিটার। এসব সীমান্ত ঐতিহাসিকভাবে ভারতের চেয়ে উত্তর-পূর্ব এশিয়ার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে বেশি। এর ফলে এই অঞ্চলটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও পরিচিতি গঠন করেছে, আর তা সিএএর ফলে অস্তিত্বগত হুমকির সৃষ্টি করেছে।
এই অঞ্চলের রয়েছে নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট। ফলে সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর জন্য এটি পরিণত হয়েছে উত্তপ্ত ক্ষেত্রে। এখানে এছাড়াও আন্তঃসীমান্ত অভিবাসন, মাদক ও অস্ত্র পাচারের যেসব সমস্যা রয়েছে, তা মূল ভারত থেকে ভিন্ন। সাত দশক ধরে এখানে সংগ্রাম-লড়াই চললেও এখনো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। মনিপুর ও ত্রিপুরা ছিল ব্রিটিশ আমলে রাজা শাসিত রাজ্য। তারা স্বাধীন ভারতে একীভূতি হয়ে যায়। তাদেরকে রাখা হয় গ শ্রেণির রাজ্য হিসেবে। এসব রাজ্য ভারতের রাষ্ট্রপতির নিযুক্ত প্রধান কমিশনারের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এর ফলে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্ত কোনো রাজ্য বিধান সভা ছিল না।
আদিবাসীদের পরিচিতির প্রতি হুমকি সিএএ
১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, ভারতের নাগরিক হতে হলে অন্তত ১২ বছর ভারতে অবস্থান করার প্রয়োজন হতো। কিন্তু এখন অমুসলিমদের জন্য তা ৫ বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে। মুসলিমরা এই সুবিধা পাবে না। এই আইনটি আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরার মতো উপজাতীয় এলাকাগুলোতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
কিছু কিছু ছাড় দেয়া সত্ত্বেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা আশঙ্কা করছে, নতুন ব্যবস্থার ফলে তারা নিজ রাজ্যেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে, তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, অরুনাচল প্রদেশ, মেঘালয় ও সিকিমের জনসংখ্যা ১০.৮৮ মিলিয়ন। আর ২০০৪ সালের ১৪ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সাল বলেন, এসব এলাকায় ২০ মিলিয়ন অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছে।
আর নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেন, ভারতে বাস করছে ২৪ মিলিযন অবৈধ বাংলাদেশী। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ত্রিপুরা ৩.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার মাত্র ২৮ ভাগ আদিবাসী, বাকিরা অভিবাসী। আসামের বরাক উপত্যকায় বাঙালিদের প্রাধান্য রয়েছে। ভারতের সবচেয়ে ছোট রাজ্য সিকিমে গত ৫ দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আদিবাসী সিকিমিজ ভাষাভাষী লেপচা ও ভুটিয়ারা এখন সংখ্যালগু, নেপালি ভাষাভাসীরা প্রায় ৬২.৬ ভাগ। বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, সিএএ বাস্তবায়িত হলে মনিপুর, মিজোরাম ও মেঘালয়েও একই অবস্থার সৃষ্টি হবে। এ কারণেই ওই সব রাজ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
এসব রাজ্যের অনেকে মনে করে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি তাদের জন্য অস্তিত্বগত সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিজেপি ক্ষমতায় থাকার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উত্তর-পূর্ব এলাকায় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে নির্ধারিত রয়েছে ২৫টি আসন। এর মধ্যে ১৪টি আসামে, ত্রিপুরায় ২টি (এখানে হিন্দু বাঙালিদের প্রাধান্য রয়েছে), মনিপুর ও মেঘালয়ে ২টি করে, অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও সিকিমে ১টি করে আসন রয়েছে। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে আসামের আসন রয়েছে সাতটি। আবা বাকি উত্তর-পূর্বে আছে সাতটি। ফলে সাম্প্রদায়িক কার্ড ব্যবহার করে এই অঞ্চল থেকে কেউ যদি ১৫টি আসন নিশ্চিত করতে পারে, তবে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা তাদের জন্য খুব সহজ হয়ে যায়।
বিরোধী দল ও সমালোচকেরা বলছেন, নির্যাতিত জনসংখ্যার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, শ্রীলঙ্কার হিন্দু, পাকিস্তানের আহমদয়িা, চীনের ইউঘুরদের। সুপ্রিম কোট এ নিয়ে ৫৯টি আপিলের ওপর শুনানি করছে। এদিকে সিএএর বিরুদ্ধে ভারতব্যাপী বিক্ষোভ বাড়ছে। তবে আমিত শাহ বলছেন, বিক্ষোভ সত্ত্বেও সরকার তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না। ফলে ভারতের আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক অখণ্ডতার প্রতি ভবিষ্যতে ভয়াবহ আলামত ফুটে ওঠেছে।
এশিয়া টাইমস