ভারতের এক মুসলিম নেতার বিশেষ সাক্ষাতকার
ড. জাফরুল ইসলাম খান - ছবি : সংগৃহীত
সাউথ এশিয়ান মনিটরকে দেয়া এক বিস্তারিত সাক্ষাতকারে দিল্লি স্টেট মাইনরিটি কমিশনের প্রধান ড. জাফরুল ইসলাম খান নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভারতব্যাপী চলমান বিক্ষোভের কারণে নতুন বিভেদ রেখা সৃষ্টির মাধ্যমে বিপজ্জনক খেলাটি শোচনীয় হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ড. খান বলেন, বর্তমান বিক্ষোভের ফলে হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পটি টিকবে কিনা তা নিয়েও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে সাক্ষাতকারটি তুলে দেয়া হলো।
সাউথ এশিয়ান মনিটর : ভারতে সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা কেমন?
ড. জাফরুল ইসলাম খান : ভারতে সংখ্যালঘুদের ধীরে ধীরে প্রান্তিক অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ২০০৬ সালে সাচার কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে কোনো কোনো বিষয় দলিতদের চেয়েও পিছিয়ে আছে মুসলিমেরা। অথচ পিছিয়ে থাকার দিক থেকে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার সময় দলিতরাই ছিল শীর্ষে। সরকারি চাকরিতে মুসলিমরা বর্তমানে ২ থেকে ৩ ভাগ। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদী প্রপাগান্ডবাদীরা আগের কংগ্রেস সরকারের মুসলিম সংখ্যালঘুদের ‘তোষণ’ নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালাতে ক্লান্ত বোধ করছে না।
সাউথ এশিয়ান মনিটর : বর্তমান বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ভারত কোথায় যাচ্ছে?
ড. জাফরুল ইসলাম খান : বর্তমান সরকার সব ফ্রন্টেই ভারতকে অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বিরোধী বিক্ষোভের পর এই সরকার এমনকি বৈদেশিক সহানুভূতি পর্যন্ত হারিয়েছে। অথচ আগে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সব জায়গায় তাদেরকে স্বাগত জানানো হতো, আগ্রাধিকার পেত। কিন্তু এখন ভারতকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। ভারতের আগের অবস্থান পুনরুদ্ধার করার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হবে।
হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প
সাউথ এশিয়ান মনিটর : বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকার কোন কোন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. জাফরুল ইসলাম খান : মোদি-শাহ-দোভাল (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল) সিএএ ও এনআরসি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলে (যদিও তা নিয়ে সন্দেহ আছে) দেশকে ইউনিফর্ম সিভিল কোর্ডের দিকে নিয়ে যাবেন। অবশ্য অনেকে, বিশেষ করে মুসলিমেরা এর বিরোধিতা করছে। কারণ শরিয়াহ আইন, ১৯৩৭ দিয়ে তারা সুরক্ষিত। হিন্দুত্ব কার্যক্রম সবসময়ই সক্রিয় রয়েছে। তারা অনেক মুসলিম স্থানের নাম পরিবর্তন করেছে, ইতিহাস ও পাঠ্যপুস্তককে গেরুয়াকরণ করেছে, মুসলিমদেরকে কোণঠাসা করেছে, মুসলিম, দলিত, খ্রিস্টানদেরকে রাজনৈতিক ক্ষেত্র ক্ষেত্র থেকে নির্মূল করে দিয়েছে।
ছাত্র বিদ্রোহ
সাউথ এশিয়ান মনিটর : দেশে বর্তমান ছাত্র বিদ্রোহ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. জাফরুল ইসলাম খান : ছাত্র ও তরুণরা সমাজের এমন এক অংশ যারা সঙ্কটের সময় অন্যরা যখন সন্ত্রস্ত্র থাকে, তখন তারা এগিয়ে আসে। এটা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে দেখা গেছে। তারাই রাজনৈতিক খেলা পরিবর্তনের জন্য সামনে এগিয়ে আসে। আমাদের দেশের ছাত্ররাও এগিয়ে এসেছে। তারা, বিশেষ করে মেয়েরা দারুণ কাজ করছে। কৃতজ্ঞ জাতি তাদের ভূমিকা ও সাহসিতকার কথা দীর্ঘ দিন স্মরণ করবে। মনে রাখতে হবে, ২০১৪ সালে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৩১ ভাগ ভোট, ২০১৯ সালে ৪০ ভাগের কম ভোট পেয়েছে। ফলে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না। বিজেপি দেশের সেক্যুলার ও অন্তর্ভুক্তমূলক রাজনীতি শেষ করে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে হিন্দুরা থাকবে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে, আর মুসলিম, খ্রিস্টান, দলিত, আদিবাসীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে নেমে যাবে।
সরকার গত সাড়ে ৫ বছর ধরে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। তবে তারা জনগণের মনের ভাব পড়তে ভুল করেছে। বর্তমান সিএএ/এনআরসিবিরোধী বিক্ষোভের পর হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। ২০২৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
সিএএ, এনপিআর ও এনআরসি
সাউথ এশিয়ান মনিটর : সরকার দাবি করছে যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) মাধ্যমে তিনটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দিতে চায় সরকার। আপনি কেন এটাকে দেশের জন্য বিপজ্জনক মনে করেন?
ড. জাফরুল ইসলাম খান : নির্যাতিত সংখ্যালঘু কেবন এই প্রতিবেশী তিন দেশে অস্তিত্বশীল নয়। শ্রীলঙ্কা, (তামিল হিন্দু), মিয়ানমার (রোহিঙ্গা, চিন ও অন্যরা) ইত্যাদি অনেক দেশেও রয়েছে। মোদি সরকার আসলে পেছনের দরজা দিয়ে লাখ লাখ ভারতীয় হিন্দুকে নাগরিকত্ব দিতে চায়। এর মাধ্যমে নথিহীন মুসলিমদের কোণঠাসা করা হবে, তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হবে, দাস শ্রমিকে পরিণত করা হবে।
সাউথ এশিয়ান মনিটর : আপনি কি মনে করেন এনপিআর, এনআরসি একই মুদ্রার দুটি পিঠ?
ড. জাফরুল ইসলাম খান : সরকার যদি জনসংখ্যা সম্পর্কে তথ্য চায়, তবে আদমশুমারিই যথেষ্ট। পরবর্তী আদমশুমারি হওয়ার কথঅ ২০২১ সালে। তাহলে কেন এনপিআরের আয়োজন? যাদের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে, তাদের বাছাই করে বাদ দেয়ার জন্যই এনপিআর করা হচ্ছে। এনপিআর-এর তথ্য নিশ্চিতভাবেই এনআরসিতে হালনাগাদ করা হবে।
পুলিশের নৃশংসতা
সাউথ এশিয়ান মনিটর : বিক্ষোভরত ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশের নৃশংসতার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আপনি প্রধান বিচারপতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পুলিশ কেন বিক্ষোভরত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করল?
ড. জাফরুল ইসলাম খান : বিক্ষোভরত মুসলিমদের বিরুদ্ধে পুলিশের এ ধরনের নৃশংসতা আগে কখনো দেখা যায়নি। আবার জাট ও গুজ্জারদের (তারা হিন্দু) বিরুদ্ধেও পুলিশ এমন নৃশংসতা প্রদর্শন করেনি।
সাউথ এশিয়ান মনিটর : আপনি কি আশার কোনো রেখা দেখতে পাচ্ছেন?
ড. জাফরুল ইসলাম খান : ভারতের সাধারণ নারী-পুরুষ, বিশেষ করে তরুণরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কথা বলছে, অবস্থান গ্রহণ করেছে। সরকার যতই শক্তিশালী ও ঔদ্ধত্য হোক না কেন, তারা এ ধরনের শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে না। মোদি-শাহ-দোভাল টিমকে অবশ্যই ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।