ঢাকা সিটি নির্বাচন : কী হতে পারে
ঢাকা সিটি নির্বাচন : কী হতে পারে - ছবি : সংগ্রহ
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ভোটাধিকার হলো নাগরিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার ও কর্তব্য। রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বশীল নেতা নির্বাচনে পছন্দমতো প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারা মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনস্বীকৃত ভোটাধিকার পদ্ধতি চালু করা সরকারের একটি মৌলিক দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা এখন ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। নির্বাচন কথাটি জনগণের কাছে ‘প্রহসনে’ পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের মাঝে অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে। এর দায় কখনো রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর; আবার কখনো জনসাধারণের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলছে।
ভোটের দিনের আগেই বিশেষ প্রতীকের পক্ষে আগাম সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার ঘটনা এখন ওপেন সিক্রেট। ভোটাররা মনে করেন, বিশেষ মার্কার প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিলেও পাস, না দিলেও পাস। অতএব, ভোট দিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নির্বাচনের প্রতি জনগণের এতটাই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে জনগণ ভোটের দিনকে উৎসবের দিন হিসেবে গণ্য করত; সেখানে নির্বাচন কমিশন মাইকিং করেও এখন ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের নিতে পারছে না; বরং ভোটকেন্দ্রগুলোতে উৎসাহী ভোটারের পরিবর্তে কুকুর-ছাগলের উপস্থিতি নির্বাচনব্যবস্থাকেই ব্যঙ্গ করছে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের চিত্র দেশের নাগরিকরা মন থেকে দূর করতে পারেননি। এবার নির্বাচন কমিশন ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করেছে। এ ঘোষণা শুনে জনমনে নতুন সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মনে প্রশ্ন এই নির্বাচনও ৩০ ডিসেম্বরের মতোই হবে না তো সে সংসদ নির্বাচন সমসাময়িক গণতান্ত্রিক বিশ্বের ইতিহাসে একটি ‘কলঙ্কময় নির্বাচন’ হয়ে গেছে। ওই নির্বাচনের ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কমপক্ষে ১৯৭টি কেন্দ্রে ‘শতভাগ’ ভোট পড়েছে এবং অন্তত এক হাজার ৮৮৯টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৫-৯৯.৯৯ শতাংশ।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সিইসি কে এম নুরুল হুদা নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই’ (ইত্তেফাক, ১ জুলাই, ২০১৯)।
কমিশনের যদি কিছু করার না থাকে তা হলে এ ক্ষমতা কার? অথচ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন নির্বাচনে কী হতে যাচ্ছে সেই বিষয়ে। নির্বাচনের পরও এমন ‘ভৌতিক’ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই নির্বাচনের ত্রুটি ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। নির্বাচন কেমন হয়েছে তা বিবেকবান এবং নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে বলেছেন। এবার সিটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি বলেছেন, কেন নির্বাচন নিরপেক্ষ, শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় না? এই প্রশ্নের উত্তরে নিজেই বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন (ইসি) আইনত স্বাধীন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দী।’ এ জন্য তিনি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হয়, তা হলে গণতন্ত্রের পদযাত্রা অবারিত করতে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হতে হবে। অবৈধভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জনগণের বা গণতন্ত্রের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট থাকে না’ (নয়া দিগন্ত, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯)।
মাহবুব তালুকদার গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে না চাইলেও দেশের মানুষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হয়ে গেছে। আর একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের দাফন সম্পন্ন হয়েছে বলেই অনেকে মনে করেন। হয়তো সেই কারণেই সিইসি নুরুল হুদা এবার জনগণকে নিরাপত্তা দিয়ে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে চান। মাইকিং করে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিতে ব্যর্থ হলেন। সামগ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাটিই সীমাহীন ক্ষতির মধ্যে নিপতিত হয়েছে।
একজন ভোটার নির্বিঘ্নে পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দেয়ার পরিবেশ প্রয়োজন তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু বর্তমান কমিশন তা করতে ব্যর্থ। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে নির্বাচনে নিয়োজিত কর্মকর্তারা এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নন। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনিয়ম সম্পর্কে তারা কঠোর অবস্থান নিতে পিছপা হন না। ভারতের সুসংহত গণতন্ত্রের জন্য দেশটির নির্বাচন কমিশন বা ইসির ভূমিকা অনেক বেশি। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে সরকারের প্রতি কারচুপির অভিযোগ উঠলেও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বড় ধরনের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচনে তাদের ভূমিধস পরাজয় বরণ করেছে। কিছু দিন আগে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গোতাবায়ে রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসা নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ না তুলে বরং পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন। সম্প্রতি ব্রিটেনেও নির্বাচন হয়েছে। তবে বিরোধী পক্ষ থেকে ন্যূনতম অভিযোগ ওঠেনি।
তা হলে বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থার এই হালের জন্য কে দায়ী? সরকার, নির্বাচন কমিশন, জনগণ, নাকি বিরোধী দল? ভোটারশূন্য নির্বাচনের পর সম্প্রতি ভোটের আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে ভোটের দিন বিরোধী পক্ষকে ভোটকেন্দ্রে যেতে না দিয়ে একপক্ষীয় বিজয়কে সরকার তাদের ‘ক্রেডিট’ বলেই মনে করছে। অপর পক্ষে নির্বাচন কমিশন সরকারের ম্যান্ডেট অনুযায়ী, নির্বাচনী আয়োজন করতে পেরে খুশি বলেই মনে হচ্ছে। তাই সিইসিকে বলতে শোনা যায়, কত পার্সেন্ট ভোট পড়ল তা নির্বাচন কমিশনের ‘দেখার বিষয় নয়।’ এমন পরিস্থিতিকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞ মহল গণতন্ত্রের প্রতি ইসির ‘অরুচি’র বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে করেন। দেশে সরকার নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের প্রহসনের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি শক্ত কোনো প্রতিবাদ বা গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বিরোধী শক্তিকে দমন করতে সরকার পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করছে এবং বিরোধী শক্তিও এতটাই ক্লান্ত যে, জনবলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের ভোটাধিকার আদায়ে কোনো শক্তি প্রদর্শন করতে পারেনি। তার পুরো সুযোগ সরকার নিচ্ছে। বিরোধী দলের নিষ্ক্রিয়তায় জনগণও নিশ্চুপ।
বিগত কয়েকটি নির্বাচনে যেভাবে নির্বাচনীব্যবস্থাকে কলুষিত এবং নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে, তাতে মানুষের মনে গভীর ক্ষত, হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। এর প্রভাব আমরা বিভিন্ন উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌরসভার নির্বাচনগুলোতে প্রত্যক্ষ করেছি। মাইকিং করেও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেয়া যায়নি। ভোটের প্রতি জনগণের এই অনীহার মধ্যেই নির্বাচন কমিশন ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এক প্রকার জোর করেই ইভিএমের মাধ্যমে ভোট নেয়ার জন্য প্রস্তুত। বেশির ভাগ দল এর বিরোধিতা করলেও কেবল সরকারের মনোবাঞ্ছা পূরণে সিইসি গোঁ ধরেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সাফাই গাইতে গিয়ে সিইসি বলছেন, ইভিএমে নির্বাচন হলে আগের রাতে কেউ ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখতে পারবে না। সিইসির এ ধরনের বক্তব্যে, ‘৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগেই ব্যালট বাক্স বোঝাই করা হয়েছিল,’ বিরোধী দল এবং জনগণের এই অভিযোগ সত্য বলেই প্রমাণিত হলো।
নির্বাচনকালীন সময়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের এমনকি প্রার্থীদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করার আশঙ্কা রয়েছে। দেখা যায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় বিএনপির চার লাখ ৩৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এসব কারণে যখন ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে ইচ্ছুক নন; তখন সিইসি স্বয়ং ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান করছেন। দুই সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকালে তিনি বলেছেন, ‘নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোটারদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমরা নেবো। তারা ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরবেন, সেই নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব।’ এতে স্পষ্ট হয়েছে, অতীতে তারা ভোটারদেরও নিরাপত্তা দেননি; নির্বাচনও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে পারেননি। সিইসির এমন অভয়বাণীতে জনগণ যে আশ্বস্ত হতে পারছেন না; তা ভোটারদের সাথে কথা বললে যে কেউ বুঝতে পারবেন। অনেকে দুই সিটি নির্বাচনের ফল কী হবে, তাও আগাম বলে দিচ্ছেন। নির্বাচনে বিজয়ের জন্য সরকারের ‘কর্তৃত্ববাদী’ আচরণ এবং সরকারের প্রতি ইসির মোসাহেবি আচরণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি এই ‘বৈরী আচরণ’ অদূরভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর রূপ নেবে, যা সমাজে অস্থিরতা, ভারসাম্যহীনতা আর রাজনৈতিক শূন্যতা প্রকট করে তুলবে। এর ফলে জনমনে যে প্রতিরোধ-প্রতিহিংসার জন্ম নিতে পারে তা কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব হবে না হয়তো। দীর্ঘ দিন এ ধারা চলতে থাকলে কিছু মানুষ অতিমাত্রায় ক্ষমতার অপচর্চা করার সুযোগ পাবেন; এমনকি যা বর্তমানেও বিদ্যমান। ফলে সুবিধাবঞ্চিতরা আরো বেশিমাত্রায় নির্যাতিত-নিপীড়িত হতে পারেন।
harun_980@yahoo.com