নতুন বছরে কী হবে?
নতুন বছরে কী হবে? - ছবি : সংগ্রহ
বিদায়ী বছর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পার করল বাংলাদেশের অর্থনীতি। ব্যাংকিং খাতে নগদ আদায় কমে যাওয়ায় পাহাড় ছুঁয়েছে খেলাপি ঋণ। কমে গেছে আমানত প্রবাহ। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এতে বেড়ে গেছে সরকারের ব্যাংক ঋণ। ব্যাংকে নগদ টাকায় টান পড়ায় বেড়ে গেছে ব্যবসায় ব্যয়। গুণগত বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছে না। একমাত্র রেমিট্যান্স ছাড়া বেশির ভাগ সূচকগুলোই এখন নিম্নমুখী। অর্থনীতির এ নেতিবাচক অবস্থার মধ্যেই শুরু হয়েছে নতুন বছর। বিগত বছরের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর গতি অব্যাহত থাকলে নতুন বছরে সরকারকে অর্থনীতির নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা, উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন, সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন জোরদারকরণ এবং সর্বশেষ ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায়। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যও কমিয়ে আনতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে।
বিদায়ী বছরে ব্যাংকিং খাতের সেরা চমক ছিল ঋণের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে অর্থাৎ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ ১০ বছর সময় দিয়ে ঋণ নবায়ন। সরকারি ব্যাংক ছাড়া আর কোনো ব্যাংকই ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে পারেনি। অথচ ব্যাংক খাতে নানাভাবে প্রভাব ফেলে এ ঘোষণা।
অথচ এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নামে আগের বছরের ধারাবাহিকতায় বিদায়ী বছরে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। বছরের শুরু থেকেই এ সুবিধা নিলেও উদ্যোক্তারা নানাভাবে আমানতকারীদের ঠকিয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের সুদহার ছয় শতাংশে নামিয়ে আনায় বছরের শুরুর দিকে আমানত প্রবাহ কমে যায় বেশিরভাগ ব্যাংকে। নগদ টাকার টান পড়ায় বছরের শেষ দিকে এসে আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনেকটা কাড়াকাড়ি বেধে যায়। এতে বছরের শেষ সময়ে আমানতের সুদহার বেড়ে গেলেও কাঙ্খিত হারে আমানত সংগ্রহ করতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
নতুন বছরে ব্যাংকিং খাতের জন্য আমানত সংগ্রহই হবে মূল চ্যালেঞ্জ। আমানতের সুদ হার কমে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এতে কমে গেছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। কিন্তু ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেনি, বরং তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি উন্নতি না হলে তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এদিকে আমানত যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে ঋণের প্রবৃদ্ধি। ব্যাংকাররা আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদ।
সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদ আমানতের সুদহারের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। এ কারণে বেশি মুনাফার আসায় আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন। আবার কেউবা পুঁজিবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করছেন। এতে কমে গেছে আমানতপ্রবাহ। আবার কেউবা বলছেন, ভালো বিনিয়োগকারী না পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ নিরাপদে রাখতে সরকারের দীর্ঘ মেয়াদের বিল বন্ডে বিনিয়োগ করছে। ফলে এক দিকে যেমন আমানত কমেছে, অন্যদিকে তহবিল সরকারের কোষাগারে দীর্ঘ মেয়াদে আটকে গেছে। ফলে বছরের শেষ সময়ে এসে আর্থিক খাতে নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আদায় সরকারের জন্য চলতি বছরের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত এই ঋণ এখন পাহাড় ছুঁয়েছে। বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে দেশের ব্যাংকিং খাতে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৫০০ শতাংশ। আর অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩০০ শতাংশ। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে। তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। আর ঋণ অবলোপন ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে সামগ্রিক খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা।
এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা দেখছেন ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দেয়া। বছরের শুরুতেই নতুন অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ২ শতাংশ সুদে ঋণ নবায়ন করা যাবে। আর এ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয় ১০ বছরের জন্য। ছাড় দেয়া হয় ঋণের সুদহারের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ১৪-১৫ শতাংশ পুরনো ঋণও নবায়ন করতে এলে ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে বছরের শুরু থেকেই যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারা বলা চলে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। সারা বছরই ব্যাংকগুলোতে নগদ আদায় কম হয়। এর প্রভাব পড়ে ব্যাংক মুনাফায়। বেশিরভাগ ব্যাংকেরই বছর শেষে পরিচালন মুনাফাসহ প্রকৃত মুনাফার প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে অবলোপনসহ ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে ব্যাপক সরব। খেলাপি ঋণ কমাতে এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত অর্থেই খেলাপি ঋণ কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। এ জন্য ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা দরকার। সরকার এই খেলাপি ঋণ নতুন বছরে কতখানি আদায় করতে পারবে তার ওপর অর্থনীতি তথা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে।
বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা নতুন সরকারের নতুন বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, নির্ধারিত সময় থেকে অনেক পিছিয়ে বেশির ভাগ মেগা প্রকল্প। পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এ কাজ এগিয়েছে ৮৪ শতাংশ। মেট্রোরেল প্রকল্পের অগ্রগতি ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি বলে জানা গেছে। কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভৌত অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে ৪৮ শতাংশ। একইভাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও দুহাজারি-কক্সবাজার ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্পের কাজও চলছে শম্ভুক গতিতে। নতুন বছরে এই প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু একই সাথে বেড়ে যাচ্ছে আয়বৈষম্য। এই বৈষম্য চলতি বছরে কিভাবে কমানো যায় তা সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে।
রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন : উচ্চভিলাষী রাজস্ব আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। রফতানি ও আমদানি কমে যাওয়া এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির মন্দার কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমেছে। সর্বশেষ হিসাব মতে, সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি প্রায় ২০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এই চার মাসের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের সামান্য বেশি, অথচ এবার গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের প্রধান তিন খাতেই আদায় কমেছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর থেকেই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ঘাটতি মেটাতে সরকারকে রাজস্ব আদায়ে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসির হিসেবে উদ্যোগ না নিলে বছর শেষে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সেই সনাতন পদ্ধতিতেই দেশে রাজস্ব আহরণের কাজ চলছে। এছাড়া লোকজন যে ট্যাক্স দিচ্ছে তা আসলে কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে তারও কোনো স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা নেই। যে কারণে মানুষ ট্যাক্স দিতে আগ্রহ পাচ্ছে না।
পুঁজিবাজারে পতনের ধারা অব্যাহত : বিদায়ী বছরের প্রথম মাসটা বাদ দিলে বাকি সময়টা পতনে ডুবেছিল বাজার। ফলে বছরজুড়েই বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর আর্তনাদ করতে হয়েছে। লোকসানের হাত থেকে বাঁচতে বিও (বেনিফিসিয়ারি ওনার্স) হিসেবে থাকা শেয়ার বিক্রি করে সাইডলাইনে চলে গেছেন অনেকেই। দেখা গেছে, বছরের শুরুতে ৫ হাজার ৩৮৫ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ডিএসইএক্স দেখতে দেখতে ঊর্ধ্বমুখী বাজারে হঠাৎ করে নেমে আসে পতনের প্রবণতা। ২৬ ডিসেম্বর লেনদেন শেষে ডিএসইএক্স চার হাজার ৪১৮ পয়েন্টে নেমে আসে। এ হিসাবে আগের বছরের ২৪ জানুয়ারি থেকে বিদায়ী বছরের ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে সূচকটি কমেছে এক হাজার ৫৩২ পয়েন্ট। বছরের শুরুতে বাজার মূলধন উত্থানে থাকলেও ২৬ ডিসেম্বর শেষে তা তিন লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকায় নেমে আসে। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। তারা বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে সরকারকে খুব দ্রুত পরিকল্পনা করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাপক ভিত্তিতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ বেড়ে গেছে। সারা বছরে যেখানে ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যশাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সেখানে ছয় মাসেই নেয়া হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাপকভিত্তিকে ঋণ নেয়ার কারণ হিসেবে বলা যায়, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। রাজস্বের ডেফিসিড জিডিপি ৫ শতাংশের ওপরে চলে যাচ্ছে। এজন্য সরকারকে ব্যাংকি খাত থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এ পরিমাণ ঋণ নেয়ার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ধাক্কা লেগেছে। তাই সরকারকে এর বিকল্প ভাবতে হবে।
বিদায়ী বছরে ব্যাংক খাত থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ নিয়েছে অনেক কম। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ধারাবাহিকভাবে কমেছে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার। সবশেষ নভেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আগের বছরের অর্থাৎ ২০১৮ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ছিল ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট, উচ্চঋণের সুদহার ও অবকাঠামোগত সমস্যা এবং নতুন বিনিয়োগের অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্টরা। এভাবে বেসরকারি খাতের ঋণ ধারাবাহিক কমতে থাকলে ভবিষ্যতে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য যেকোনো মূল্যে সরকারকে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিনিয়োগ না বাড়লে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে উন্নয়ন হবে না।