পুঁজিবাজারের সিন্ডিকেট
পুঁজিবাজারের সিন্ডিকেট - ছবি : সংগ্রহ
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই পতন হচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারের। ক্রমাগত কমছে সূচক, লেনদেন ও শেয়ার দর। বাদ যায়নি মৌলভিত্তির কোম্পানিও। দীর্ঘমেয়াদীয় এই পতনের ধাক্কায় অনেকটাই কাবু হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তারল্য সংকটকে দায়ী করে সরকারের কাছে চাওয়া হয়েছে দশ হাজার কোটি টাকার তহবিল। অভিযোগ উঠেছে, কম দামে শেয়ার ক্রেতারা এই তহবিল যুগিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে বেশি দরে বিক্রি করে মুনাফা লুটতে পারে। অপরদিকে বিশেষকদের মতে পুঁঝিবাজারের প্রধান সমস্যা তারল্য সংকট নয়। সুশাসন ও বাজার তদারকির মাধ্যমে কারসাজি বন্ধ করতে না পারলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।
অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারকে বিবেচনা করা হয় খুবই স্পর্শকাতর খাত হিসেবে। অন্যান্য খাতের সঙ্গে এই খাতের সংযোগ সবচেয়ে বেশি। এজন্য খাত বিশেষের উন্নয়নে হুট করেই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। কিন্তু পুঁজিবাজারের সিদ্ধান্তের দ্রুত ফলাফল পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে।
পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদী মন্দায় ক্রমাগত লোকসান দিয়ে আসছে ব্যক্তিসহ সকল পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা। বিশেষ করে ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা। যেকোনো পুঁজিবাজারের ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা কতোটুকু নিরাপদ ও লাভবান হয়, তা দিয়েই বিবেচনা করা হয় বাজারের সক্ষমতা ও টেকসই ক্ষমতা। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ সক্ষমতা বেশি। এর বিপরীতে তাদের লোকসান বহন করার ক্ষমতাও বেশি।
এর জন্য গ্রামীণ ফোনসহ কয়েকটি ইস্যু দৃশমান রয়েছে পুঁজিবাজারে। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ এখনো কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেনি। দীর্ঘমেয়াদী পতনের জন্য তারল্য প্রবাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করা হয়। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার জন্য তহবিল গঠন করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়।
সরকারের কাছে দাবি তুলে ব্যাংকগুলোকে ঋণের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকও রেপোর মাধ্যমে টাকা ধার নেয়ার সুযোগ দেয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত একটি ব্যাংকই টাকা ধার নিয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলো সাড়া দেয়নি। ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, বর্তমান বাজারে বিনিয়োগ করে কোনো মুনাফা পাওয়া সম্ভব নয় বলেই তারা বিনিয়োগে যায়নি। উল্টো ঋণের সুদ দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
এর বাইরে গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রাতিষ্ঠানিক ব্রোকারদের (ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান) পক্ষ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিলের প্রস্তাব অর্থমন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। আর এই সুবিধা ব্রোকারহাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ সব মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ছয় বছরের জন্য এই তহবিল পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে। এই তহবিল থেকে তিন শতাংশ সুদে অর্থ ধার নিতে পারবেন তারা। ঋণের অর্থ শুধু সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে।
এখান থেকে বিনিয়োগকারীদেরও ঋণ দিবেন তারা। আবার এই অর্থ বাজারে বিনিয়োগ করলে অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে বলে তারা প্রস্তাব দেন। তহবিল পাওয়ার জন্য নিয়মিত তদ্বির পর্যন্ত করছেন তারা। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ ইতোমধ্যে কম দামে শেয়ার কিনে রেখেছেন। এখন বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়ে সেই শেয়ার তাদের কাছে বিক্রি করবেন। এই পদ্ধতি পুঁজিবাজারে পার্কিং শেয়ার নামে পরিচিত। অর্থাৎ একভাবে কিনে, কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে বিনিয়োগকারীদের কাছে গছিয়ে দেয়া।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই বেশি। অপরদিকে লোকসানের মুখে পড়তে পারে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলো। বিশেষ করে ব্যাংক ও আইসিবি। কারণ রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসার চেয়ে অর্থের প্রবাহ ধরে রাখার কাজটিই বেশি করে। এভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্টানের কাছে শেয়ার গছিয়ে দিয়ে লাভবান হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এক পর্যায়ে ফের পতন হবে বাজারের।
বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু পুঁজির নিরাপত্তায় কেউ আর দীর্ঘ মেয়াদের বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। ২০১০ সালের ধ্বসের ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি কেউ। ফের পতনের ধাক্কাও সামাল দেয়া কষ্টকর হয়ে পড়বে।
অবশ্য এই আচরণকে বিনিয়োগের স্বভাব না বললেও সমর্থন করছেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে, দীর্ঘ মেয়াদে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সাময়িক লোকসানকে মেনে নেয়ার মতো সক্ষমতা নেই বিনিয়োগকারীদের। বাজারকে টেকসই করতে প্রয়োজন সুশাসনের উন্নয়ন ও বাজার তদারকি ব্যবস্তার উন্নয়ন।
পুঁজিবাজার বিশেষক, বিনিয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতে, কারসাজি চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই এ বাজারের উন্নয়ন সম্ভব। এটি নিশ্চিত না করতে পারলে দশ হাজার নয়, লাখো কোটি টাকার তহবিল দিয়েও বাজারকে টেকসই করা সম্ভব নয়। শুধু তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি করলে দেশের পুঁজিবাজার কৃত্রিম বাজার হিসেবেই বিবেচিত হবে সবখানে।
সুশাসনের কারণেই প্রতিবেশি সব দেশের স্টক এক্সচেঞ্জগুলো এগিয়ে গিয়েছে। আমাদের পুঁজিবাজার বিশ্বে পরিচিত পাচ্ছে ফটকা বাজার হিসেবে। চীনা বিনিয়োগ যুক্ত হওয়ায় কিছুটা মর্যাদা বেড়েছে। কিন্তু বাস্তবে উন্নয়ন না হলে, পতনের ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসবে না বাজার। অর্থনীতি ও উন্নয়নের স্বার্থে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে চীনের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। দুর্নীতিবাজ ও অসৎ কর্মচারিদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে সরিয়ে দিতে হবে। এটি সরকারকেই করতে হবে। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই উন্নয়ন সম্ভব হবে না। এটি যদি ব্যর্থ হয়, বিশের সকল স্টক এক্সচেঞ্জে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বর্তা যাবে। ইতিমধ্যেই বিদেশি বিনিয়োগ কমতে শুরু করেছে। দ্রুত উদ্যোগ না নিলে তলানিতে নামবে বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জ।