যেভাবে সোভিয়েত বিমানগুলো ভূপাতিত করেছিল পাকিস্তান
যেভাবে সোভিয়েত বিমানগুলো ভূপাতিত করেছিল পাকিস্তান - ছবি : সংগৃহীত
জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের বেসামরিক প্রেসিডেন্টকে এক অভ্যুত্থানে উৎখাত করেন। তিনি পাকিস্তানজুড়ে কট্টরপন্থী ইসলামি আইন প্রাতিষ্ঠানিকরণে অগ্রসর হন, ১৯৭১ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধে শোচনীয় পরাজযের পর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পুনঃগঠন কাজ শুরু করেন।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত হামলার পর ওয়াশিংটন দেখতে পেল যে জিয়ার নীতি কমিউনিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত মুজাহিদিন বিদ্রোহীদের সমর্থন করার কাজে পাকিস্তানি সহায়তা পাওয়ার সাথে খুব সহজেই খাপ খাওয়ানো যায়। ফলে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে আফগান উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে থাকা মুজাহিদিনদের সংগঠিত ও অস্ত্র প্রদানে সহায়তা করতে থাকে।
এর বদলা নিতে সোভিয়েত ও গণ-প্রজাতান্ত্রিক আফগানিস্তান বিমান বাহিনীর (ডিআরএএএফ) জঙ্গি বিমানগুলো এসব উদ্বাস্তু শিবিরগুলো গুঁড়িয়ে দিতে পাকিস্তানি আকাশসীমা লঙ্ঘন করে ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। সীমান্ত রক্ষার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তখন ম্যাচ ১ গতিসম্পন্ন জে-৬ জঙ্গিবিমান (চীনা নির্মিত মিগ-১৯-এর ক্লোন) ও দুটি রাডার স্থাপন করে। কিন্তু এগুলো খুবই মন্থর প্রমাণিত হয়, টহল ও রাডার কভারেজও স্পটযুক্ত মনে হতে থাকে। ফলে সোভিয়েত হামলা রুখে দেয়া সম্ভব হয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮১ সালে রিগ্যান প্রশাসনকে রাজি করানোর চেষ্টা করেন তারা যাতে ৪০টি এফ-১৬এ ও দুই আসনের এফ-১৬বি বিক্রি করাটা অনুমোদন করে। ১৯৮৩-১৯৮৬ সময়কালে এগুলো তারা লাভ করে। চতুর্থ প্রজন্মের এসব অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমান ছিল ব্যবহারোপযোগী। এর অ্যারোডাইনামিক্যালি আনস্টেবল ডিজাইন, দ্রুত গতি ও ভারী বোমা বহন ক্ষমতার ফলে এটি কার্যকর অস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
অবশ্য প্রথম দিকে উৎপাদিক এফ-১৬গুলোতে দৃষ্টিসীমার বাইরে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য রাডার-গাইডেড ব্যবস্থা ছিল না। এর মানে হলো পাকিস্তানি ফ্যালকনগুলোকে তাদের এআইএম-৯পি বা আরো আধুনিক এআইএম-৯এল সাইড উইন্ডার তাপ-সন্ধানী ক্ষেপণাস্ত্র বা তাদের ২০ মিলিমিটার ভালক্যান কামানগুলো ব্যবহার করার জন্য তাদের টার্গেটের কাছাকাছি আসতে হতো।
১৯৮৬ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর নম্বর ৯ গ্রিফিন ও ১৪ শাহিন স্কোয়াড্রনের এফ-১৬গুলো আফগান সীমান্তজুড়ে টহল দিতে উড়তে সক্ষম হয়। ওই বছরে সোভিয়েত ও আফগান বিমানগুলো পানসির উপত্যকায় মুজাহিদ ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণাত্মকভাবে টার্গেট করছিল।
১৯৮৬ সালের ১৭ মে দুটি এফ-১৬এ পারাচিনারের কাছে পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশকারী দুটি ড্রাফ সু-২২এম৩কের দিকে ছুটে যায়। শক্ত সুইয়িং-পাখার সুখোই সুপারসনিক জঙ্গিবিমানগুলো স্নায়ুযুদ্ধের সময় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছিল।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এফ-১৬ ছয় মাইলের মধ্যে চলে আসে, স্কোয়াড্রন লিডার হামিদ কাদরি একটি সাইডউইন্ডার নিক্ষেপ করেন, কিন্তু তা আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। সু-২২ তখন দিক পরিবর্তন করে আফগান সীমান্তের দিকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কাদরি তখন দ্বিতীয় এআইএম-৯এল ছোঁড়েন, যা প্রথমে সুখোইয়ের অনেক দূর দিয়ে গিয়ে ঘুরে এসে এর টার্গেটে আঘাত হানে।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ভাষ্যমতে, কাদরি দ্বিতীয় একটি সু-২২-এর দিকে ধাবিত হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, অপর বিমানটি তখন বাম দিকে ঘুরছিল। তখন আমার আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। আমি দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে একে ক্ষেপণাস্ত্র ও বন্দুক উভয়টি দিয়েই ঘায়েল করতে পারব। আমার বিমানটিকে ঠিক পজিশনে নিয়ে গুলি ছুঁড়লাম। সেকেন্ডের মধ্যে দেখলাম, শত্রু বিমানের লেজে আগুন ধরে গেছে। পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে ঘাঁটিতে ফিরে গেলাম।
অবশ্য, আফগান বিমানবাহিনী মাত্র একটি বিমান হারানোর কথা স্বীকার করেছিল। তবে এরপর থেকৈ উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে বিমান হামলা বেশ কমে যায়। অধিকন্তু আফগান স২-২২ রক্ষার জন্য সোভিয়েত ভিভিএস মোতায়েন করে মিগ-২৩ এমএলডি জঙ্গি বিমান।
এক মাস পর কাদরি আবার মিগের মোকাবিলায় নামে। তবে কোনো পক্ষই গুলি করেনি। এর এক বছর পর ১৯৮৭ সালের ১৬ এপ্রিল এফ-১৬ থালের কাছে ড্রাফ সু-২২কে ধাওয়া করে ভুপাতিত করে। স্কোয়াড্রন লিডার বদর-উস-ইসলাম লে. কর্নেল আবদুল জামিলের সুখোইকে গুলি করে ভূপাতিত করেছিলেন। জামিল বিমান থেকে বের হয়ে পাকিস্তানি ভূখণ্ডে অবতরণ করলে তাকে আটক করা হয়।
১৯৮৭ সাল নাগাদ সোভিয়েত রেকর্ডে দেখা যায়, পাকিস্তানি বিমানগুলো আফগান আকাশসীমায় টহল দিচ্ছে, বিশেষ করে সীমান্তের মাত্র ১০ মাইলের মধ্যে থাকা খোশতের মতো অবরুদ্ধ ঘাঁটিগুলোতে আকাশপথে সরবরাহকাজে হয়রানি করারকাজটি করছিল।
১৯৮৭ সালের ৩০ মার্চ দুটি এফ-১৬ একটি এন-২৬ টুইন-টারবোপ্রপ কার্গো বিমানকে খোশতের কাছে আটকে দেয়। দুটি এফ-১৬ই এটিকে লক্ষ্য করে এক মাইল দূর থেকে একটি করে সাইডউইন্ডার নিক্ষেপ করে। কার্গো বিমানটি নিচে বরফঢাকা পার্বত্য এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। এতে ৩৯ আরোহীর সবাই নিহত হয়। সঙ্ঘাতের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি এফ-১৬-এর পাইলটেরা কয়েকটি এমআই-৮ পরিবহন হেলিকপ্টার, আরেকটি এন-২৬ (১৯৮৯ সালে) একটি এন-২৪ পরিবহন বিমান বিধ্বস্ত করে।
তবে পাকিস্তানি বিমানের সুদিনের অবসান ঘটে দুই সপ্তাহ পর। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মুজাহিদদের ঘাঁটিগুলোতে হামলায় নিয়োজিত চারটি মিগ-২৩ বিমানের দিকে ধেয়ে যায় দুটি এফ-১৬। তবে সোভিয়েত লে. কর্নেল পোছিতালকিন তার ইউনিটটিকে দ্রুত ফিরিয়ে নেন সঙ্ঘাত এড়াতে। তবে যাওয়ার সময় তিনি দেখতে পান যে নিচে একটি বিমান জ্বলছে।
সেটি কিন্তু মিগ ছিল না, ছিল এফ-১৬। লে. শাহি সিকান্দারের বিমানটি অসাবধনাতায় বিধ্বস্ত হয়। সেটি নিজের ক্রুর গুলিতেই। সিকান্দার প্যারাসুট দিয়ে আফগান মাটিতে নেমে আসেন। তবে মুজাহিদ বাহিনী তাকে চোরাই পথে পাকিস্তানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তবে রাশিয়ার কোনো কোনো সূত্র দাবি করেছে যে সোভিয়েট জেটই তার বিমানটি গুলি করে ভূপাতিত করেছে। কিন্তু আসলে ওইসময় মিগে বিমান থেকে বিমানে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না।
১৯৮৮ সালে সোভিয়েত স্থলবাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করার সময় ড্রাফ ও সোভেয়ত বিমান ইউনিটগুলো আফগান কমিউনিস্ট সরকাকে রক্ষার জন্য শেষ মরিয়া চেষ্টায় নামে।
৮ আগস্ট কর্নেল আলেক্সান্ডার রাটস্কই সু-২৫ নিয়ে মারানশাহ উদ্বাস্তু ক্যাম্পে নৈশ হামলা চালান। তার চার বিমানের ইউনিটটি মুখোমুখি হয় দুটি এফ-১৬-এ-র। রাটস্কই জোরালোভাবে এফ-১৬-এর দিকে ধাবিত হন। তিনি মনে করেছেলেন যে তিনি যদি পিছু হটেন তবে তাপ-সন্ধানী ক্ষেপণাস্ত্র তার বিমানের পেছনেই আঘাত হানবে। কিন্তু এআইএম-৯এল সব দিক থেকেই আঘাত হানতে সক্ষম ছিল। রাটস্কইয়ের বিমানটি ঠিকই আঘাত হানে পাকিস্তানি ক্ষেপণাস্ত্র।
রাটস্কই বিমান থেকে বের হয়ে পাকিস্তানি মাটিতে অবতরণ করেন। তাকে আটক করা হয়। পরে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে দেশে তাকে বীরের মর্যাদায় গ্রহণ করা হয়।
এর এক মাস পর কুনার উপত্যকায় ঢুকে পড়ে ১২টি সোভিয়েত মিগ-২৩। ৩২ হাজার ফুট উপড়ে উড়তে থাকা এসব বিমান পাকিস্তানি বিমানকে এগিয়ে আসতে প্রলুব্ধ করছিল। তবে মাত্র ১১ হাজার ফুট উপড়ে উড়তে থাকা পাকিস্তানি বিমানগুলোকে তারা দেখতে পায়নি। স্কোয়াড্রন লিডার খালিদ মাহমুদ একটি মিগ-২৩কে লক্ষ করে গুলি করেন। এটি তখনই বিধ্বস্ত না হলেও দেশে ফিরে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করে। দুটি মিগ এরপর আকাশযুদ্ধে মত্ত হয় এফ-১৬-এর সাথে। পাকিস্তানি পাইলটেরা দাবি করেছেন দু্টি মিগ-২৩ ভূপাতিত করার। তবে সোভিয়েত রেকর্ডে এ ধরনের কোনো কথা নেই।
১৯৮৮ সালের ৩ নভেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনী শেষ বিমানটিকে ভূপাতিত করে। লে. খালিদ মাহমুদ একটি ড্রাফ সু-২এম৪কে বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করে।
পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ১০টি বিমান ভূপাতিত করার জন্য ১০ এফ-১৬ পাইলটকে কৃতিত্ব দেয়। আর সোভিয়েতরা তাদের তিনটি সু-২২, একটি সু-২৫ ও একটি এন-২৬ হারানোর কথা স্বীকার করেছে। কয়েকটি সূত্র জানায়, পাকিস্তান বিমান বাহিনী আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অন্তত এক ডজন বিমান ভূপাতিত করেছে। তবে সেগুলো আফগান আকাশসীমা লঙ্ঘন করে করা হয়েছিল বলেই সম্ভবত সেগুলোর কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয় না।
যারা পাকিস্তান-আফগানিস্তান বিমানযুদ্ধের ব্যাপারে আরো বেশি আগ্রহী, তারা পাকিস্তানি বিমান যুদ্ধের ভাষ্যগুলো দেখতে পারেন।
ন্যাশনাল ইন্টাররেস্ট