ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে
ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে - ছবি : সংগ্রহ
‘ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে’ বহুল প্রচারিত একটি প্রবাদ। এর অর্থ, শুভঙ্করের ফাঁদে সরল মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ গরল মানুষের ভোগের জন্য ব্যবহৃত হয়।
১৭ অক্টোবর পত্রিকার পাতায় চোখ পড়তেই- আইএমএফের প্রতিবেদন, ‘২০১৯ সাল শেষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ’ এবং গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা বৈশ্বিক ক্ষুধার সূচকে ভারত পাকিস্তানকে পেছনে ফেলল বাংলাদেশ’। অপর একটি পত্রিকায় শিরোনাম ‘এক বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার’। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে যে, যত অর্থ পাচার হয়েছে সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দু’টি পদ্মা সেতুু নির্মাণ করা সম্ভব।’
প্রথম দু’টি সংবাদের শিরোনাম পাঠ করে হর্ষধ্বনি শেষ না হতেই বিষাদে তলিয়ে যাই শেষ সংবাদটি পড়ে। হাঁস সহজ-সরল নিরীহ গোবেচারা পাখি। বাগডাশ ডোরাকাটা হিংস্র জানোয়ার। গায়ের জোরে হাঁসের ডিম বাগডাশ খেয়ে যায়। প্রবাদটি মনে পড়ার কারণ খুঁজতে একটু পেছনে ফিরতে হয়।
এক সময় কৃষিই ছিল বাঙালির জীবন ও জীবিকার উৎস। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতসহ দেশের তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং এগুলোর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বিধৌত পলিগঠিত সমভূমি হওয়ার দরুন প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশ কৃষিকাজের উপযোগী।
একসময় সম্পূর্ণ রূপে প্রকৃতির (বৃষ্টি, বন্যা ও খরা) ওপর নির্ভরশীল কৃষির সাথে জড়িয়ে ছিল দেশের মানুষের হাসি-কান্না ও আনন্দ-বেদনা। প্রকৃতি যখন কৃষির অনুকূলে তখন পৌষপার্বণ, বৈশাখী মেলা, যাত্রা, পালা, ভাটিয়ালি গানের জোয়ার বইত।
নদীবেষ্টিত চর এলাকা। একসময় আমাদের গ্রামের ঘাটে বাঁধা দেখতাম আট-দশটি বড় নৌকা। উত্তরে সিলেট ও দক্ষিণে বরিশাল প্রধান ধান উৎপাদক এলাকা। বড় নৌকায় করে মাঝিমাল্লা নিয়ে উজান-ভাটিতে ধান কাটতে যেতেন বেপারিরা। কেটে মাড়াই করে মালিকের গোলায় তুলে দিতেন সে ধান। কঠোর শ্রমের বিনিময়ে ধানের একাংশ দিয়ে নৌকা বোঝাই করে দেড়-দুই মাস পর বাড়ি ফিরতেন। মূলধন, নৌকা ও বেপারির অংশ বাদ দিয়ে গরিব মাল্লাদের বণ্টন করা হতো। দায়দেনা পরিশোধসহ কয়েক দিন যেতে না যেতেই ফুরিয়ে যেত বণ্টনের ধান।
কখনো কখনো মহামারীর আকারে শুরু হতো মড়ক। ষাটের দশকে একবার অকাল বন্যায় মাঠের ধান তলিয়ে গিয়েছিল। ক্ষুধার্ত মানুষকে কাঁচালাউ ও আলুর ভাত খেতে দেখেছি। কর্মহীন ক্ষুধার্ত মানুষ কাজের সন্ধানে বহুদূর চলে যেত, বাড়ি ফিরত খালি হাতে। বেকার পুরুষের চেয়ে বেশি অসহায় ছিলেন বেকার মহিলারা। দেখতাম, অভুক্ত মহিলারা পেটেভাতে সারা দিন ধানভানার মতো কঠিন কাজ করে দিতেন। কাজ না পেলে ভাতের ‘লেই’ লবণ-পানি মিলিয়ে পান করতেন। এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে জোরেশোরে চালু হয় ‘পরিবার পরিকল্পনা’ কর্মসূচি। অর্থাৎ আইন করে নতুন শিশুর আগমন বন্ধ রাখা। সাধারণ মানুষ তখনো জানত না, আমাদের দেশের বাইরে আরো দেশ আছে যেখানে বহু মানুষের প্রয়োজন।
১৯৭৪ সালের দিকে আমার জ্যাঠা যখন ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন, তখন আমাদের গ্রামে ভোটারের সংখ্যা ছিল চার শ’র কাছাকাছি। সে সময় আমার এক কাজিন প্রথম সিঙ্গাপুর গেলেন। বর্তমানে আমাদের গাঁয়ে ভোটারের সংখ্যা চৌদ্দ শ’র মতো। বিদেশে কর্মরত লোকসংখ্যা দুই শতাধিক। গত ৪৫ বছরে নদীভাঙনসহ নতুন বসতি গড়ার কারণে ফসলি জমি কমেছে অর্ধেক। অর্থাৎ আগে যে পরিমাণ ফসল ফলত এখন ফলে তার অর্ধেকেরও কম। আগে মসজিদ ছিল একটি; এখন মসজিদ সাতটি। গাঁয়ে সবার হাতে হাতে মোবাইল, বিকাশ-এর দোকান, গ্রামজুড়ে বিজলি বাতি, গ্যাসের চুলা, কিছু দূর পরপর চায়ের দোকান, আধুনিক সেলুন, মুরগির ফার্ম ইত্যাদি। পাকা ইমারতসহ সেমিপাকা বাড়িঘর। ছোটখাটো অনুষ্ঠানেও গরু জবাইসহ রোস্ট-পোলাওয়ের ছড়াছড়ি। ডিশসহ প্রত্যেক বাড়িতে রঙিন টিভি। গ্রাম যেভাবে এগোচ্ছে সেভাবে এগোতে থাকলে, ‘ক্ষুধার সূচকে’ ভারত পাকিস্তান কেন, এশিয়ার অনেক দেশই আমাদের পেছনে পড়ে যাবে।
ফসলের উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকে, লোকসংখ্যা বেড়ে গেছে তিনগুণের বেশি। সেখানে অভাবের পরিবর্তে প্রাচুর্যের কারণ কী? কারণ, বিদেশ থেকে প্রেরিত অর্থ। দুই শতাধিক লোক গড়ে ২৫ হাজার টাকা করে পাঠালে প্রতি মাসে অর্ধকোটি টাকার বেশি গ্রামে প্রবেশ করছে। ফলে, বৈশ্বিক ক্ষুধা ও অপুষ্টির সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দুই বড় দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ।
জানা যায়, দুনিয়ার নানা দেশে এখন এক কোটি ২৪ লাখ ২৫ হাজার ৮৯৫ জন বাংলাদেশী কর্মরত আছেন। তাদের বদৌলতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত পোশাক শিল্পের পরের স্থানটি হলো, জনসম্পদ খাত। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বাধিক ১৬৪০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে এক কোটি ২৪ লাখ ২৫ হাজার ৮৯৫ জন বাংলাদেশীর পাঠানো ১৬৪০ কোটি ডলার রেমিট্যান্সের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে গার্মেন্ট শিল্প। কত মূল্যবান দৃষ্টিনন্দন পরিচ্ছদ আমাদের গার্মেন্ট কারখানায় তৈরি হয় তা দেশে অবস্থান করে টের পাওয়া যায় না। একবার আমেরিকাপ্রবাসী আত্মীয় দেশে এসে আমাকে একটি হাতাওয়ালা গেঞ্জি গিফট করেছিলেন। আমেরিকার গেঞ্জি; খুব যত্ন করে গায়ে পরতাম। গেঞ্জির গায়ে লাগানো স্টিকার থেকে একদিন জানতে পারি, গেঞ্জিটি আমার বাড়ির পাশের গার্মেন্ট থেকে তৈরি।
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরবে ছিলাম। গাইড সামসু ভাইকে বলি- ‘সামসু ভাই, আমাকে দামি টুপির দোকানে নিয়ে যান’।
সামসুভাই মক্কার গাজা এলাকায় একটা বড় দোকানে নিয়ে বললেন, ‘দোকানদার ভাই, উনি আমার দেশের লোক, টুপির জন্য আপনার দোকানে নিয়ে এলাম। ভালো টুপি দেখান। শায়েখী টুপি।’ শত টুপির মাঝখান থেকে বাছাই করে গোটা তিনেক টুপি কিনলাম। প্রতিটি আট রিয়েল করে। মনের মতো টুপি পেয়ে খুশি মনে হোটেলে চলে আসি। দু’টি টুপির স্টিকার ছেঁড়া। একটির সাথে স্টিকার ঝুলছিল। স্টিকারে নজর পড়তেই চোখ কপালে উঠে যায়। মক্কার অভিজাত টুপির দোকান থেকে খরিদ করা টুপির সাথে নাইলন সুতা দিয়ে বেঁধে রাখা রঙিন স্টিকারে বেশ কিছু টুপির ছবিসহ ‘প্রো কোয়ালিটি, সাইজ, ৫৭ সি এম, ফ্যামাস ক্যাপ গার্মেন্ট’ এফসিজি, মেইড ইন বাংলাদেশ’ কথাগুলো লেখা রয়েছে (আমার দেখা আরব, পৃষ্ঠা ৩৬২)।
তৈরী পোশাকের প্রতিষ্ঠান এইচ অ্যান্ড এম প্রতিষ্ঠা করেন আর্লিন প্যার্সন নামের এক ব্যক্তি ১৯৪৭ সালে। তার প্রথম বিক্রয় কেন্দ্র ছিল সুইডেনের ভাস্তেরাসে। তখন এটি ছিল শুধু মহিলাদের পোশাকের জন্য। ১৯৬৮ সালে পুরুষদের জন্য পোশাক বিক্রি শুরু হয়। লন্ডনে প্রথম বিক্রয় কেন্দ্র খোলা হলো ১৯৭৬ সালে। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইউরোপজুড়ে সরাসরি ও অনলাইনে তার বাজার সম্প্রসারিত করতে থাকে। বর্তমানে এইচ অ্যান্ড এম কে সম্পর্কে জানে না, তেমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো। কারণ এ কোম্পানিটি বাংলাদেশের এমন কোনো পোশাক কারখানা নেই যেখানে কাজ করে না বা করেনি। ২০১৩ সালে যখন লন্ডন যাই তখন দীপন কাজ করত এইচ অ্যান্ড এম প্রতিষ্ঠানে।
দীপনের সাথে কাজ করত বার-অ্যাট-ল অধ্যয়নরত অন্য এক বাঙালি যুবকও। বহুতল ভবনের কয়েক তলাজুড়ে বিশাল শোরুম। জিন্সের প্যান্ট এবং বেশ কিছু টিশার্ট দেখতে গিয়ে গধফব রহ ইধহমষধফবংয লেখা চোখে পড়ে। পরিচ্ছদের গায়ে বড় দিনের ডিসকাউন্ট লেখা ছিল ‘৬০ শতাংশ’। দীপন জানায়, ৬০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিয়েও ১০ শতাংশ লাভ থাকে। চার সিজনে কাপড় আনা হয়। এক সিজনের কাপড় অন্য সিজনের আগেই বিক্রি করা শেষ করতে হয়। একেক সিজনের একেকটা লটে কয়েক লাখ পোশাক থাকে। বাংলাদেশের সাথে প্রতিযোগিতায় রয়েছে চীন। এই সহাবস্থান ধরে রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনামসহ অন্যদের সাথেও বাংলাদেশকে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, ‘বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করেছিল ষাটের দশকে। সত্তরের দশকের শেষের দিকে রফতানিমুখী খাত হিসেবে এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানিমুখী শিল্প। দেশের মোট রফতানি আয়ের বেশির ভাগই আসে তৈরী পোশাক থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শতকরা ৮৩ ভাগ আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৪ শতাংশই জোগান দিয়েছে এই খাত।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কাজ করছেন ৫০ লাখ শ্রমিক। তাদের ৮০ শতাংশই নারী।
সে হিসেবে গার্মেন্টে কাজ করা মেয়েদের সংখ্যা ৪০ লাখের মতো। কারো কারো মতে, প্রকৃত সংখ্যাটা আরো বেশি। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ‘এই সেক্টরে সব মিলিয়ে ৪০ লাখের মতো মহিলা কাজ করে। বিশ্বের ২৫টি পরিবেশবান্ধব শিল্পস্থাপনার মধ্যে বাংলাদেশের সাতটি। সব ক’টিই তৈরী পোশাক কারখানা। সারা বিশ্বে এই পোশাক তৈরিতে বাংলাদেশ শীর্ষ তিন দেশের একটি। ইউরোপের বিশাল বাজারে জিন্স রফতানিতে বাংলাদেশই শীর্ষে।
ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্বের মতো, বাংলাদেশে এখন আর বাসাবাড়িতে কাজ করার জন্য মহিলা পাওয়া যায় না। একদিন যে মহিলারা একবেলা অন্নের জন্য সারাবেলা বাড়িওয়ালির পেছনে ঘুরতেন, এখন বাড়িওয়ালিরা একবেলা কাজ করে দেয়ার জন্য সারাবেলা সে মহিলাদের পেছনে ঘোরেন।
বিশ্বে কেউ পেয়েছে তেল, কেউ পেয়েছে লোহা, স্বর্ণ ও হীরার খনি আর আমরা পেয়েছি ‘মানুষের খনি’। বিদেশের যে পরিমাণ সম্পদ আছে সে পরিমাণ মানুষ নেই- আর আমাদের যে পরিমাণ মানুষ আছে, সে পরিমাণ সম্পদ নেই। সম্পদ ভোগ করতে গেলেও মানুষ লাগে। মানুষের খনির কারণেই বিশ্বের নজর পড়েছে আমাদের জনসম্পদের দিকে। হু হু করে বাড়ছে রেমিট্যান্স।
এখন দেশের সাধারণ মানুষ মালয়েশিয়ায় কাজ করার জন্য তাকিয়ে থাকে আর ‘অসাধারণ’ মানুষ তাকিয়ে থাকে ‘সেকেন্ডহোম’ করার জন্য। ভৌগোলিক দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কর্কটক্রান্তির ওপর নদীবিধৌত, কৃষকের ছয় ঋতুর বঙ্গদেশ আর বিষুবরেখার ওপর জেলে-ঝোলা ও মালের এক ঋতুর দেশ, মালয়েশিয়া। একসময়ে উভয় দেশই ছিল ইংরেজদের উপনিবেশ। ইংরেজরা আমাদের ভূমি ছেড়ে যায় ১৯৪৭ সালে, মালয়েশিয়া ছেড়ে গেছে ১৯৫৫ সালে। আমাদের ছিল জনশক্তি।
মালয়েশিয়ার ছিল অনুকূল প্রকৃতি। আমাদের আট বছর পর একই লক্ষ্যে যাত্রা করে তারা আজ কোথায় আর আমরা কোথায়! বিশ্বের সর্বোচ্চ পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখতে ২০০০ সালে মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। দেশটার রাতারাতি উন্নয়নের পেছনে কাজ করছে আধুনিক মালয়েশিয়ার কিংবদন্তি ও রূপকার ডা: মাহাথির মোহাম্মদের কয়েকটি মাস্টার প্ল্যান। মালয়েশিয়া ২০২০ সালে পৃথিবীর শীর্ষ তালিকাভুক্ত দেশের শ্রেণীভুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে কয়েকটি মাস্টার প্ল্যান হাতে নিয়ে পোস্টডেট-এর অনেক আগেই জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় (ঘউচ) দেশটিকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দিয়েছে (টুইনটাওয়ারের দেশে পৃষ্ঠা ৭৬)।
ডা: মাহাথির মোহাম্মদ উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর বিদেশী বিনিয়োগ নির্ভর করে। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট দেশের উন্নয়ন হবে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোরই দায়িত্ব স্থিতিশীলতা বজায় রেখে বিদেশী বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া।’
এখানেই আমরা হেরে গেছি। নয়তো আমাদের পালে যেভাবে বহির্বিশ্ব থেকে আগত রেমিট্যান্সের হাওয়া লাগতে শুরু করেছিল, হাল ঠিক থাকলে এতদিন মালয়েশিয়ার লোক সেকেন্ড হোম করার জন্য বাংলাদেশে আসার চিন্তা শুরু করে দিত।
পরিতাপের বিষয়, রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশে অস্থিরতাসহ বাড়ছে অশনিসঙ্কেতও। অশনিসঙ্কেতের কারণ, দেশের এই দুই সেক্টরের দিকে লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে শকুনিদের। নানা উপায়ে শুরু হয়েছে লুটপাট। লুটপাট করা অর্থের একটা অংশ চলে যাচ্ছে বহির্বিশ্বে। বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য দিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। শৈশবের ঐকিক অঙ্কের মতো চৌবাচ্চা পূর্ণ হওয়ার আগেই শূন্য হতে শুরু করেছে। ব্যাংকে নজরদারিসহ অবৈধ সম্পদের ভাগাড়ে নাড়া পড়তেই, বালিশ, সিন্ধুক, বিছানার তলায় বস্তা বস্তা টাকা, যেখানে নাড়া পড়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এত টাকা রাখবে কোথায়? এ দেশে বাড়ির ত্রিসীমানার বাইরে বস্তাভর্তি টাকা ফেলে রাখার খবরও পাওয়া যায়।
এক দিকে দেশের সহজ সরল ও নিরক্ষর মানুষ জমিজিরাত বিক্রি করে, পারিবারিক সুখ বিসর্জন দিয়ে, রাতদিন পরিশ্রম করে বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে দেশের দুর্বল বৈদেশিক মুদ্রাভণ্ডার সবল করছেন, অপর দিকে এক শ্রেণীর শিক্ষিত লোক অসততা ও কূটবুদ্ধির আশ্রয়ে সে টাকার বড় একটা অংশ করায়ত্ত করছে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট কলামিস্ট প্রফেসর আনু মুহাম্মদের এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ‘সর্বশেষ আন্তর্জাতিক রিপোর্টে (ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮) ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষস্থান লাভ করেছে। ধনিক শ্রেণী গঠনের প্রথম পর্বে ছিল লাইসেন্স, পারমিট, চোরাচালানি, মজুদদারি, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা, সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদি।
দ্বিতীয়পর্বে এর সাথে যোগ হয় ব্যাংক ঋণ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকানা লাভ। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে নামে বেনামে ঋণ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক যোগাযোগ, লেনদেন ব্যবস্থা, সম্পদ কেন্দ্রীভবনের একটি কার্যকর পথ হিসেবে দাঁড়াতে থাকে। বাংলাদেশের নব্য ধনীদের অনেকেই প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে ভবিষ্যৎ ‘ঝঞ্ঝাটমুক্ত’ করতে অর্থ পাচারসহ আমেরিকা কিংবা কানাডার মতো স্থানে সেকেন্ড হোম নির্মাণে ব্যস্ত। এতে আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতাসহ শুভঙ্করের ফাঁদে সরল মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ গরল মানুষের ভোগের সামগ্রী হতে দেখলেই, ডিম ‘পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে’ প্রবাদটি মনে চলে আসে।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক