ক্ষণিকের অতিথি
ক্ষণিকের অতিথি - ছবি : নয়া দিগন্ত
পরীক্ষার হলে ডিউটি রয়েছে। তাই সকালবেলায় বাসা থেকে বের হয়েছে রাহাত। ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তায় কোনো রিকশা নেই বললেই চলে। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে। রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রীতিমতো অস্থির। ঠাণ্ডার মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে তার একদম ইচ্ছে করছে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা রিকশার দেখা মেলে। ‘বাসস্ট্যান্ড যাবেন?’ রাহাতের প্রশ্নের উত্তরে রিকশাওয়ালা জবাব দেয়, ৬০ টাকা লাগবে। রাহাত বুঝতে পারে, যাওয়ার ইচ্ছা নেই তাই সে ভাড়া বেশি চাচ্ছে। কোনো উপায় না দেখে রাহাত সে ভাড়ায়ই রাজি হয়ে যায়। বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা ঠাণ্ডায় জড়োসড়ো। ধীরে ধীরে চালাচ্ছে। কিছু দূর যেতে না যেতেই রাহাত দূর থেকে লক্ষ করে, একটা মেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে বারবার ঘড়ি দেখছে। রাহাত বুঝতে পারে মেয়েটিও হয়তো রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়েটির নিকটবর্তী হতেই সে রাহাতকে জিজ্ঞাসা করছে, ভাইয়া ওপাশে কোনো রিকশা নেই? কই দেখলাম না তো। বুঝতে পারছি, পরীক্ষা আর দেয়া হবে না। কোথায় যাবেন? কলেজে। কিছু মনে না করলে আমার সাথে যেতে পারেন। আমি ওদিকেই যাচ্ছি। না ভাই, ধন্যবাদ।
কথোপকথনের সময় রিকশাওয়ালা থেমে গিয়েছিল। মেয়েটি যেতে না চাওয়ায় সে আবার চলতে শুরু করে। কয়েক গজ যেতেই রিকশাওয়ালাকে থামিয়ে দেয় রাহাত। ভাড়া মিটিয়ে সে রিকশাওয়ালাকে বলে মেয়েটিকে নিয়ে যান। নইলে সে পরীক্ষা দিতে পারবে না। রিকশা থেকে নেমে রাহাত মেয়েটিকে বলে, রিকশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন যেতে পারেন। আমি সামনে থেকে রিকশা নিয়ে নেবো। লজ্জাবনত দৃষ্টিতে মেয়েটি রিকশার দিকে এগিয়ে যায়। আর রাহাত সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। রিকশায় উঠে মেয়েটি রিকশার হুড তুলে দেয়। কৃতজ্ঞতা ও লজ্জা কেমন যেন একাকার হয়ে যায়। রাহাতকে ক্রস করার সময় সে ধন্যবাদ দিতেও ভুলে যায়। খানিকটা দূরে গিয়ে রিকশাটি হঠাৎ থেমে যায়। রাহাতকে ডেকে মিয়েটি বলে, আমার সাথে আসেন। না না। প্লিজ আপনি যান। কোনো দ্বিধা করবেন না। আমার কোনো সমস্যা হবে না। আসেন বলছি। আপনি না গেলে কিন্তু আমি যাবো না।
মেয়েটির অনুরোধ রক্ষার্থে একপ্রকার বাধ্য হয়েই রাহাত রিকশায় ওঠে। যতটুকু সম্ভব কারোর গা স্পর্শ না করেই তারা রিকশার সিটে বসে। তার পর দু’জন চলতে শুরু করে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। রাহাত এই প্রথমবারের মতো কোনো অপরিচিত মেয়ের সাথে একই রিকশায় যাচ্ছে। রাহাত মেয়েটিকে বলল, ছুটির দিনে কিসের পরীক্ষা? চাকরির। ও আচ্ছা। কখন শুরু হবে? ৯টায়। সমস্যা নেই। যথেষ্ট সময় আছে। আবারো চলতে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না। রিকশার হালকা ঝাঁকুনি দু’জনার মধ্যকার দূরত্বকে কমিয়ে দেয়। একে অপরের গা স্পর্শ করায় মনের মধ্যে একটা ভিন্ন অনুভ‚তির সৃষ্টি হয়। রাহাতের সম্পর্কেও কিছু জানতে মেয়েটির মনে কৌত‚হলের জন্ম হয়। কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস পায় না।
রাহাতেরও একই অবস্থা। কিছু জিজ্ঞাসা করে না। হাওয়ায় ভাসছে মেয়ের মাথার কয়েকটি কেশ। মাঝে মধ্যে তা রাহাতের কপোলকেও স্পর্শ করছে। তনুর মিষ্টি ঘ্রাণ রাহাতকে এক ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে মেয়েটির কণ্ঠস্বর- চাচা, একটু থামেন। এখানেই নামব। কোনো পরিচিত জনের নজরে যেন না পড়ে, তাই কলেজের কাছাকাছি এসেই মেয়েটি রিকশা থেকে নেমে যায়। রিকশা ভাড়া দেয়ার জন্য মেয়েটি অনুনয়-বিনয় করলেও রাহাত নেয় না।
মেয়েটি যেন রাহাতের ভালোবাসার এক অদৃশ্য ফাঁদে আটকে গেল। যদিও তার নাম-ঠিকানা রাহাতের জানা হয়নি। তবুও ক্ষণিকের অতিথিকে সে কোনোভাবেই ভুলতে পারে না। তার মনের মধ্যে মেয়েটির চেহারার একটা স্থায়ী ছাপ পড়ে যায়। তার কথাগুলো সুর হয়ে বাজে। সে দিনের পরও রাহাত ওই পথ দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করেছে, কিন্তু মেয়েটিকে আর কখনো দেখা যায়নি। ভোরের শিশিরবিন্দুর নয়নাভিরাম রূপে অনেকেই মুগ্ধ হয় ঠিকই, কিন্তু হারিয়ে গেলে তাকে আর কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনিভাবেই রাহাতও হয়তো সেই মেয়েটিকে আর কোনো দিন খুঁজে পাবে না। তবুও ওই পথ দিয়ে গেলেই রাহাতের সেদিনের স্মৃতিগুলো হুবহু চোখের সামনে ভেসে আসে।