কী করতে পারে ওআইসি
কী করতে পারে ওআইসি - ছবি : সংগৃহীত
সাম্প্রতিক ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সঙ্ঘাতের কারণে অনেকেই ওআইসির (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন) ভূমিকার সমালোচনা করছেন। একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে ওআইসির জন্ম হয়েছিল। আশা ছিল এই সংস্থা মুসলিম বিশ্বে ছায়াদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।
ইসরাইল ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট জেরুসালেমের আল আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগ করে। এর ফলে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ার জের ধরে ওই বছরের ২২-২৩ সেপ্টেম্বর মরক্কোর রাবাতে ২৫টি মুসলিম রাষ্ট্রের সম্মেলনে ওআইসির জন্ম হয়। ১৯৭৪ সালে এই সংস্থার দ্বিতীয় সম্মেলনে ৩২তম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভ করে। বর্তমানে ৫৭টি দেশ এর সদস্য। প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন ছিল এই সংস্থা হবে মুসলিম বিশ্বের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। মুসলিম বিশ্বের সমস্যাগুলোর সমাধানে বিশাল ভূমিকা রাখবে। কিন্তু অর্ধশতাব্দীকাল পেরিয়ে আসার পর বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি একে প্রশ্নের মুখেও দাঁড় করিয়েছে। সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছে বলে নানা মহলে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে বর্তমান বিশ্বের হানাহানি, সঙ্ঘাত নিরসনে এই সংস্থা তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সংস্থার নেতৃত্বের মধ্যে নানা রকম মতপার্থক্যও দেখা যায়। বিশেষ করে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যে সঙ্ঘাত ছিল তা এখানো রয়ে গেছে। মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যে সঙ্ঘাত চলছে তাতে আপাতদৃষ্টিতে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন প্রকট আকার ধারণ করছে বলেও মনে হতে পারে। এই বিভাজন রোধ করতে ভূমিকা রাখতে পারছে না ওআইসি।
কিন্তু বিষয়টিকে আমি কিছুটা অন্যভাবে দেখি। আমার কাছে এগুলোকে সুলক্ষণ বলে মনে হয়। ওআইসির সামনে আত্মসমালোচনা করার এবং এর আত্মউপলব্ধি সৃষ্টির সুযোগ এসেছে। এটা মুসলিম বিশ্বকে সুসংহত করতে পারে। মুসলিম বিশ্বের নেতাদের বোঝার সময় এসেছে এবং তাদের পুনর্জাগরণও শুরু হয়ে গেছে। একসময় তুরস্ক বেশ নীরব ছিল। মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি সরব। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়ায় বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যেগুলো আগে ওআইসির সদস্য ছিল না। সেগুলো এখন সদস্য হয়েছে। এগুলো ইতিবাচক লক্ষণ, যা উপেক্ষা করা বোকামি হবে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট মুসলিম বিশ্বের সামনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে সুযোগ তৈরি করেছে তা তাদেরকে লুফে নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সঙ্ঘাতে যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো সম্ভবত কোনো রাষ্ট্র এই প্রথম সরাসরি মার্কিনিদের চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখাল। ইরাকে মার্কিন ঘাঁটির ওপর সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কম দুঃসাহসের কাজ নয়। ক্ষয়ক্ষতি কি হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। এর প্রতীকী মূল্যও রয়েছে। পরাশক্তি আমেরিকানদের ঘাঁটির ওপর কোনো দেশের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্ভবত এটাই প্রথম। ইরানের এই কৌশলগত উপলব্ধি কিন্তু মুসলমানদের শক্তিকেই প্রকাশ করছে। ইরান যদি এই দুঃসাহস না দেখাত তাহলে হয়তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো। জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে তেহরান যদি পাল্টা হামলা করে তাহলে ইরানের অর্ধশতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করা হবে বলে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েও পরে সেই ঘোষণা থেকে পিছিয়ে গেছেন।
আসলে সঙ্ঘাত ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ঐকমত্য রয়েছে। আমেরিকানদের মধ্যেও রয়েছে এই ঐকমত্য। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কংগ্রেস দাঁড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শত শত শহরে যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। এর মানে হলো সাধারণ মানুষ কিন্তু শান্তির প্রত্যাশী। পারমাণবিক বোমা থাকলেই সবাই ভয় পাবে, তা নয়। ইরানের ঘটনা তার প্রমাণ। পারমাণবিক বোমা মারলে শুধু অন্যে মরবে না, নিজেকেও মরতে হবে। বিশ্বে যত পারমাণবিক অস্ত্র আছে তা দিয়ে ৩৮ বার পৃথিবীকে পুরোপুরি ধ্বংস করা যাবে। তাহলে কেন এসব অস্ত্রের মজুদ করা হচ্ছে? পারমাণবিক বোমা দিয়ে তো আঞ্চলিক সঙ্ঘাত নিরসন করা যাবে না। আরেকজনকে মারতে গিয়ে কেউ নিজে মরতে চায় না।
তাই আমি বলছি ওআইসির সামনে আত্মসমালোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সংস্থা কোনো সুফল বয়ে আনেনি এ কথা মানতে আমি নারাজ। এই সংস্থা অনেক আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব মিটিয়েছে। ওআইসির কারণেই আজ গাম্বিয়ার মতো দেশের রোহিঙ্গা ইস্যুতে এগিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশ তাদের চেয়ে আয়তন ও সামরিক শক্তিতে বড়ো মিয়ানমারকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। চীন, ভারতের মতো মিয়ানমারের বন্ধু বড় বড় শক্তিগুলো গাম্বিয়াকে থামাতে পারেনি। সমস্যা হলো আমরা সব সময় নেতিবাচক দিকগুলোকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করি। সফলতাগুলো তেমন আলোচনায় আসে না। বর্তমান সময়ে ওআইসির সামনে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে তা নিয়েও কেউ কিছু বলছে না। আগামী এপ্রিলে পাকিস্তানে ওআইসির যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে সেখানে এই সংস্থাকে আরো শক্তিশালী করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন নেতারা। তারা মুসলিম বিশ্বের জন্য আগামী ৫০ বছরের এজেন্ডা নির্ধারণ করতে পারেন। কারণ এই শতাব্দী হবে মুসলমানদের।
অনেকগুলো কৌশলগত বিবেচনা সমানে রেখে আমি এ কথা বলছি। পিউ রিসার্সের মতো সংস্থা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে চলতি শতকের ষাটের দশক থেকে মুসলমানরা হবে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী, যার লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজ প্রতিবেশী ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার যখন মুসলিমদের একঘরে করার চেষ্টা করছে তখন সেখানকার অমুসলিমরাও মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। এটা কিন্তু মানবতার জয়, মনুষ্যত্বের জয়। এখানেই ওআইসির একটি ভূমিকা রয়েছে। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই এই সংস্থার জন্ম হয়েছিল।
এই মুহূর্তে ওআইসির সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া উচিত মৌলিক গবেষণার ওপর। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে শিক্ষা বিস্তারের ওপর নজর দিতে হবে। বিশ্বে এখন যা হচ্ছে তার সবকিছুই জ্ঞানভিত্তিক। জ্ঞানের ওপর জোর দেয়ার কারণেই ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে ইরান অনেকদূর এগোতে পেরেছে। তাই তাদের পক্ষে নিখুঁতভাবে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে। এটা এক দিনে হয়নি। মিসরের শাসনব্যবস্থা নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও জামাল আব্দুল নাসের সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছিলেন। আমি যখন আমেরিকায় পিএইচডি করতে যাই তখন দেখেছি প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই দু-একজন করে মিসরীয় অধ্যাপক ছিলেন। সৌদি আরবও একটি পর্যায়ে এসে শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে। তাই আমি বলব- মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশে শিক্ষা, বিশেষ করে কৌশলগত শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল তৈরি করতে কর্মসূচি নিতে হবে ওআইসিকে। বিভিন্ন দেশের স্থানীয় ভাষায় বড় বড় মনীষীর লেখাগুলো অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য এ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে। অস্ত্র কেনার পেছনে মুসলিম বিশ্ব আজ বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। ২০১৮ সালে সৌদি আরব তার জিডিপির ৮.৮ শতাংশ ব্যয় করেছিল এই খাতে- কল্পনা করা যায়? মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ প্রায় প্রতিটি দেশের একই অবস্থা। অথচ এসব দেশ গবেষণা খাতে জিডিপির ভগ্নাংশও ব্যয় করে না। সমস্যা হলো গবেষণা খাতে কেউ খরচ করতে চায় না। কারণ এর ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে দেখা যায় না। একটি বড় কোন অবকাঠামো প্রকল্প করে, অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমান বা মিসাইল কিনে বাহাবা কুড়ানো সহজ। মুসলিম বিশ্বে উদ্ভাবন, আবিষ্কার নেই বললেই চলে। সায়েন্টিফিক জার্নালে লেখার সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয়। মুসলিম বিশ্বে পাঁচ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে অথচ এসব দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নিজস্ব উদ্ভাবিত পণ্য আছে কয়টি? জিএনপিতে এর অবদান ৯-১০ শতাংশের বেশি নয়। অথচ বিশ্ব সম্পদের প্রায় ৭০ শতাংশের অধিকারী মুসলিম দেশগুলো। এ জন্যই গবেষণার ওপর আমি জোর দিচ্ছি।
একসময় মধ্যপ্রাচ্যের লিভারেজ ছিল তেল। এখন জ্বালানির নানা বিকল্প আবিষ্কার হচ্ছে। ফাঁকা বুলি হলেও ট্রাম্প এখন বলার সাহস পাচ্ছেন যে মধ্যপ্রাচ্যের তেল তার দরকার নেই। মোট কথা আমাদের গবেষণা করতে হবে লিভারেজ হাসিল করার জন্য। মুসলিম দেশগুলোকে পণ্য তৈরিতে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর অর্থনীতির মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। আমি মনে করি, পাকিস্তানের আসন্ন সম্মেলন থেকে ভারতকে এ ব্যাপারে বার্তা দেয়া দরকার।
আমরা ইতিহাসের এমন একটি বিশেষ সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। ইতিহাসের অনিবার্য ধারাবাহিকতায় সামগ্রিকভাবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো উন্নয়নের স্বর্ণযুগের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। আগামী দশকগুলোতে মুসলিম বিশ্বের বিশাল প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদ, অপেক্ষাকৃত সুলভ ও তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী উন্নয়নের জোয়ারে শামিল হবে। মানবতা ও বিশ্বশান্তির এ উন্নয়নের জোয়ারে ওআইসি বলিষ্ঠ অবদান রাখতে পারে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্য এখনই প্রস্তুতি শুরু করা দরকার। এর জন্য ব্যাপক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। কারণ বাকি সব ফ্যাক্টর মুসলমানদের অনুকূলে, যা আর কারো নেই, কোনো সভ্যতার নেই।
লেখক: ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, অর্থনীতির অধ্যাপক কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা