একাকিনী, সাহসিনী
দীপিকা পাড়ুকোন - ছবি : সংগ্রহ
স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটে তিনি হাজির হয়েছিলেন জেএনইউয়ে (দিল্লির জওহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়)। দীপিকা পাড়ুকোনই এখনো একমাত্র চরিত্র, যিনি দ্বিতীয়বার এই কলামে। আবার খবরে। লিখলেন ।
সংখ্যালঘু। ইদানীং অতি–আলোচিত, অতি–চর্চিত বিষয়। ভারতের উন্নয়ন–অনুন্নয়নের বাঁক যেভাবে মিনিটে মিনিটে বদলাচ্ছে, তাতে সংখ্যালঘুর সংজ্ঞাও পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। সেই পথে হেঁটেই নতুন সংখ্যালঘুর দলে নাম লেখালেন তিনি।
সংখ্যালঘু? তিনি তো ধর্মে হিন্দু! সংখ্যালঘু হলেন কী করে? প্রাচীন প্রলাপ। শুধু ধর্ম ধরে মেজর–মাইনর ভাগ হবে? হিন্দি সিনেমার আপাত অনামী পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী তো বলেই দিয়েছেন, ‘দীপিকা পাড়ুকোন ৯৮ শতাংশ ভারতপ্রেমী পড়ুয়াকে সমর্থন করলেন না।’ মানে ২ শতাংশের মধ্যে বিচরণ দীপিকার। সংখ্যালঘুই তো। বর্তমান দেশশাসকের কথা না ভেবে সটান চলে গেলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। একাই গেলেন। আর ক’জন গেলেন বলিউডের? কেউ না! সংখ্যালঘুই তো। ভয় পেলেন না মেরুকরণের কোনো মূর্তিকেই। তাই দীপিকা এখন একাকিনী। সাহসিনী। অনেকে তেড়ে আসতে পারেন। আসছেনও। কিন্তু আগের মতো হতাশা ও উৎকণ্ঠা এখন আর তার জীবনের সঙ্গী নয়। ‘মেন্টাল হেল্থ’ ঠিক রাখার জন্য খুলে ফেলেছেন ‘দ্য লিভ লাভ লাফ ফাউন্ডেশন’। মনোবিদ অ্যানা চ্যান্ডি তার সঙ্গে থাকেন সর্বক্ষণ। ‘ছপাক’–এর শুটিংয়েও ছিলেন। ফলে এক স্বাস্থ্যসম্মত সাহস দীপিকার ভেতরে লালিত–পালিত হচ্ছে। নো ডিপ্রেশন, নো অ্যাংজাইটি। তাই দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তার উপলব্ধি, ‘মানুষ যেভাবে পথে নেমে প্রতিবাদ করছে, সেটা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, আমরা কেউই আর ভীত নই।’
মুখে মেকআপ নেই, আশেপাশে ফ্ল্যাশবাল্ব বা চ্যানেলের বুম নেই। পড়ুয়া, শিক্ষকদের ভিড় ঠেলে করজোড়ে সটান হাজির ছাত্র–সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষের সামনে। মুখ–ঢাকাদের হামলায় আক্রান্তদের পাশে থাকার বার্তা দিলেন। বিনা বাক্যব্যয়েই। কিন্তু টুইটার, ইনস্টাগ্রামে গজিয়ে উঠল ‘বয়কট দীপিকা’, ‘বয়কট ছপাক’। কেউ লিখলেন ‘দীপিকাকে ব্লক করা উচিত প্রত্যেকের।’ কেউ স্বশিক্ষিত শিক্ষক হয়ে বললেন, ‘দেশ আপনাকে উচিত শিক্ষা দেবে।’ অথচ শিখিয়ে গেলেন দীপিকাই। পড়ুয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে, নমস্কার করে তিনি দেশবাসীকে শিক্ষা দিলেন শিক্ষাঙ্গনে দাঁড়িয়েই।
বলিউডের বড় বড় ব্যক্তিত্ব যখন সিএএ, এনআরসি–সহ জেএনইউ কর্মকাণ্ড নিয়ে নীরব, তখন দীপিকা মিনিট দশেক ‘নীরব’ থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, গেরুয়া গলাবাজি তিনি গায়ে মাখেন না। তিনি যে একলা চলতে হলেও চলবেন, তার প্রমাণ তার পরদিনের নীরবতা ভঙ্গকারী বচন। টিভিতে তাকে বলতে শোনা গেল, ‘দু’বছর আগেই আমার যা বলার বলেছিলাম। পদ্মাবত মুক্তির সময়। এখন যা দেখছি, তাতে কষ্ট হচ্ছে। দুঃখ হচ্ছে। এটা আমাদের দেশের ভিত্তি নয়।’
দীপিকা এখন অনেক অভিজ্ঞ। পরিণত। এই অভিজ্ঞতা শুধু ছবির সংখ্যায় বাড়েনি। বেড়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রোষের মুখে বারবার পড়েও। সঞ্জয় লীলা বনশালির ‘জুলিয়েট’ লীলা হওয়াতেই ছিল প্রথম অভিজ্ঞতা। ‘... রামলীলা’ ধর্মীয় আবেগে আঘাত হেনেছে বলে আদালতে মামলা হয়েছিল পরিচালক, অভিনেতা–সহ দীপিকার বিরুদ্ধেও। ‘বাজিরাও মস্তানি’–র সময় অভিজ্ঞতার ঝুলি আরো একটু পূর্ণ হলো। সেখানে ‘ইতিহাস বিকৃতি ও ঐতিহ্য অবমাননা’র দায় বহন করতে হয়েছিল ‘মস্তানি’ দীপিকাকেও। আর রাজপুত করণী সেনার লোকেরা তো ‘পদ্মাবতী’ দীপিকার নাকই কেটে নিচ্ছিল! শেষ পর্যন্ত সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র ও ‘পদ্মাবত’–এর ব্যবসায়িক সাফল্যে তাদেরই নাক কাটা গিয়েছিল।
এহেন দীপিকার ‘ছপাক’ বয়কটের ফল কী হলো? দর্শকদের দিলখোলা প্রশংসায় ছবি ‘হাউসফুল’। অনেকে বলেছিলেন, ‘ছপাক’–এর প্রচারকৌশল সামলাতেই তার জেএনইউ গমন। সেটা কি সম্ভব? ‘দেশভক্ত’রা এমন কাণ্ডের পর তার ছবি দেখা ছেড়ে দেবেন জেনেও নিজের ছবির (‘ছপাক’–এর সহ–প্রযোজক স্বয়ং দীপিকা) ব্যবসাকে জেএনইউয়ের মাঠে মারা যেতে দেবেন? এমনই তার পাবলিসিটি স্টান্ট, যে একটাও ঝকঝকে–তকতকে ছবি পাওয়া গেল না গণমাধ্যমে জ্বলজ্বল করার মতো? সাধে কি প্রতিবাদী পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ টুইট করেছিলেন, ‘ম্যাড রেসপেক্ট ফর হার’।
বলিউডের অনেকেই পথে নেমেছেন জেএনইউয়ে হিংসার প্রতিবাদে। তাপসী পান্নু, দিয়া মির্জা, রিচা চাড্ডা, বিশাল ভরদ্বাজ, অনুরাগ কাশ্যপরা মুম্বইয়ের গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায় একজোট হয়েছেন। সেটা ছিল রোববার হামলার পরদিন সোমবারের রাত। পরদিন, মঙ্গলবার রাতে দীপিকা হাজির জেএনইউয়ে। প্রতিবাদের ধারাকে নতুন নেতৃত্ব দিতে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার কোনো ব্যক্তিগত যোগাযোগ নেই। বড় হওয়া, পড়াশোনা বেঙ্গালুরুতে। তবু এলেন। স্বরা ভাস্কর যেমন জেএনইউয়ে সমাজবিদ্যার সাবেক ছাত্রী। তার মা জেএনইউয়ের অধ্যাপিকা। সেই আবেগ থেকে স্বরার প্রতিবাদী স্বর আরো উঁচু হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু দীপিকা? বহু প্রতীক্ষিত, বহু আকাঙ্ক্ষিত, বহু স্বপ্নজড়িত ‘ছপাক’ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারতেন! কিন্তু করলেন কী? ঐশী, কানহাইয়াদের আন্দোলনকে শ্রদ্ধা এবং সমর্থন জানিয়ে নিজে ‘রেসপেক্ট’ হ্যাশট্যাগের কেন্দ্রবিন্দু হলেন টুইটারে।
‘বলিউডের বীরাঙ্গনা’? হয়তো তা–ই। ‘কংগ্রেসি’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’–এর প্রতিনিধি ইত্যাদি উপাধিকে তিনি যে বীরবিক্রমে গ্রহণ করেছেন, তাতে ‘বীরাঙ্গনা’ বললে অত্যুক্তি হবে না। পর্দায় বীর ঐতিহাসিক চরিত্রেও তো কম নম্বর পাননি। ‘মালতী’ হয়ে ওঠাও কি খুব স্বাভাবিক পথ পেরিয়ে? প্রস্থেটিক মেক আপে ওই ‘মুখ’ নিয়ে দর্শকের মুখোমুখি হওয়াও কি সহজ?
সাহসিনী তো বটেই। ছবিতে। ছবির বাইরেও।
ঠিকই যে, গেরুয়া শিবিরের চক্ষুশূল হওয়ার দৌড়ে আপাতত বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছেন অতীতের ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন প্রকাশ পাড়ুকোনের কন্যা এবং অভিনেতা রণবীর সিংয়ের ঘরনি। তবু অকুতোভয় চিত্তের সঙ্গে আপস করেননি। জেএনইউ নিয়ে বলতে পেরেছেন, ‘যা হচ্ছে, তাতে আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। আরো খারাপ, কোনো পদক্ষেপ করা হচ্ছে না।’
বলিউডের বাকিরা নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছেন তার কথা। শুনেও না–শোনা এবং বুঝেও না–বোঝার চলই এখন বেশি জনপ্রিয়। তাই বলা কঠিন, দীপিকাকে বলিউডের প্রতিনিধি হিসেবে ‘একাকিনী সাহসিনী’ হয়ে থাকতে হবে কতদিন! ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে নমস্কার জানাবেন কত দিন!
তবে সাহসিনীরা তো বেশিরভাগ সময় একাকিনীই হন।
সূত্র : আজকাল