মধ্যপ্রাচ্যের সব ঘাঁটিই এখন বিপদে!
মধ্যপ্রাচ্যের সব ঘাঁটিই এখন বিপদে! - ছবি : সংগ্রহ
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সম্প্রতি জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পর যুদ্ধ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। প্রতিশোধ হিসেবে ৮ জানুয়ারি ইরাকে অবস্থিত দু’টি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তেহরান। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন সামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোর যে ঘোষণা তেহরান থেকে উচ্চারিত হয়, তাতে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাশাপাশি ইরানের ড্রোন হামলা আতঙ্কে ভুগতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের চারদিকে অনেক আগে থেকেই নিজেদের সৈন্য সমাবেশ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। কমপক্ষে ১০টি দেশে মার্কিন সেনাদের সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেশগুলো হলো- ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, জর্দান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্ক। আর পূর্বদিকে রয়েছে আফগানিস্তান, যা এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় চেম্বার হিসেবে পরিচিত। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ছয় হাজার, সিরিয়ায় ৮০০, কুয়েতে ১৩ হাজার, জর্দানে তিন হাজার সেনা, সৌদি আরবে তিন হাজার, বাহরাইনে সাত হাজার, ওমানে ৬০০, সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঁচ হাজার, কাতারে ১৩ হাজার এবং তুরস্কে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দুই হাজার ৫০০ সেনা। এ ছাড়া আফগানিস্তানে রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার মার্কিন সেনা। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে এলাকার বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজে অবস্থান করছে আরো বহু মার্কিন সেনা সদস্য।
এসব এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বহু ঘাঁটি রয়েছে। রয়েছে নানা স্থাপনা। ইরানকে শায়েস্তা করতে এসব ঘাঁটি ও সেনা যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বড় অস্ত্র, তেমনি বড় দুর্বলতাও। কারণ, অস্ত্র সক্ষমতার ঘাটতির কারণে ইরান হয়তো সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালাতে পারবে না, কিন্তু নিজেদের নাগালে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের এসব ঘাঁটিও তাদের জন্য কম লোভনীয় লক্ষ্য নয়। এগুলোর ক্ষতি করেই ইরান তার সাফল্য তুলে নিতে পারে।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এসব দেশে নিজেদের ঘাঁটি স্থাপনে অনুমতি হয়তো নিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে বা সরকার পরিবর্তনের ফলে এসব দেশের পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। কাতার ও তুরস্ক গত কয়েক বছরে ইরানের অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তেমনি কুয়েতও বিভিন্ন সঙ্কটে ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে ঘাঁটি থাকা মানেই যে সে দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে অকুণ্ঠ সমর্থন পাবে, এমনটি না-ও হতে পারে।
আবার ইরানের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে সব দেশ ইরানে হামলা চালাতে তাদের ভূমি ব্যবহার করতে কতটুকু সম্মতি দেবে, তা-ও দেখার বিষয়। কারণ ইরান ঘোষণা করেছে, কোনো দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে সে দেশে হামলা চালানোকে তারা বৈধ মনে করবে। ওই দেশের সম্মতির বাইরেও কথা রয়েছে। কারণ ইরাকে হামলা চালানোর পর হতাহতের পরিমাণ নিয়ে লুকোচুরি থাকলেও ভিডিওতে ওই স্থানের যে ছবি দেখা গেছে, তাতে স্পষ্ট ইরানের হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য ঘাঁটিগুলোতে যদি এমন অবস্থা দেখা যায়, তাহলে সে দেশকে রক্ষার যে ‘দায়িত্ব’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সে দেশে আস্তানা গেড়েছে, তা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। যেমন কিছুদিন আগে সৌদি আরবের আরামকো তেল কোম্পানিতে দেশের বাইরের হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা সৌদি ও মার্কিন উভয় দেশের অস্ত্র সক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। আরো কয়েকটি দেশে যদি এমন হামলা করতে পারে ইরান, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এ ব্যবসা যে একেবারে লাটে ওঠবে তা বলাই বাহুল্য।
আর ইরাকের সরকার যেমন নিজেদের মাটিতে বিদেশী সেনাকে নিষিদ্ধ করেছে, মধ্যপ্রাচ্যে আবার যদি সে ঢেউ ওঠে যায়, তাহলে মার্কিন এসব সেনা ও ঘাঁটি তাদের নিজেদের জন্য বোঝা হয়ে যাবে। ইরাকের ওই ঘোষণার পরপরই ট্রাম্প বলেছিলেন, যদি তারা ইরাকে যে বিনিয়োগ করেছে, তা ফেরত না দেয়া হয়, তাহলে তারা ইরাকের ওই দাবি মানবে না। আসলেই বিভিন্ন দেশে সেনা ও ঘাঁটির পেছনে মার্কিন বাজেট একেবারেই কম নয়। বিশ্বে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে তারা এ খরচটুকু মেনে নিয়েছে। কিন্তু যদি এসব ফিরিয়ে নিতে হয়, তাহলে চরম আর্থিক মন্দায় আক্রান্ত হবে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইরানকে এ সঙ্কটে যতটুকু হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তার জন্য কম করতে হচ্ছে না মোটেও।
আর অনেক দূরে হলেও কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের জেরে যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোতেও পাল্টা হামলার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দুই শহর নিউইয়র্ক ও লস অ্যাঞ্জেলসে কড়া নিরাপত্তা নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করে নিরাপত্তা বাহিনী। মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আশঙ্কা করে, সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইরান যেকোনো সময় যুক্তরাষ্ট্রে হামলা করতে পারে। বড় দুই শহর নিউইয়র্ক ও লস অ্যাঞ্জেলসে এ ঝুঁঁকি সবচেয়ে বেশি। তারা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে হামলা হতে পারে এমন কোনো বিশ্বস্ত ও নির্দিষ্ট তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে শঙ্কা বিবেচনায় পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে।
অন্য দিকে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল ইরাক থেকেও নিজেদের নাগরিকদের অবিলম্বে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের বড় আকারের প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ইরাক ছাড়াও বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে মার্কিন নাগরিকদের দ্রুত চলে আসার নির্দেশ দেয় ট্রাম্প প্রশাসন।
এদিকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান এ সঙ্কটে যারা প্রকাশ্যে না থাকলেও আছে পুরোটাই জুড়ে, তারা হচ্ছে ইসরাইল। দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে ইরান। আর সে দেশটির সর্বোচ্চ জেনারেলের মৃত্যুতে ইসরাইলের কোনো হাত নেই, তা বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। আর সে কারণেই এ পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে ইসরাইলও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ইসরাইলি দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে। এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ বলেন, বিশ্বজুড়ে সব প্রতিরোধ-যোদ্ধাদের কাজ ও দায়িত্ব হচ্ছে এসব খুনি অপরাধীকে যথাযথ শাস্তি দেয়া। সিরিয়া এ ঘটনাকে ‘বিশ্বাসঘাতক আমেরিকার অপরাধমূলক আগ্রাসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর কঠোর নিন্দা জানায়। ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি ব্যাপক সহযোগিতা করেছেন। তিনি ইসরাইলকে ধ্বংসের জন্য জিহাদকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনও এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইয়েমেনের হুতি আনসারুল্লাহর নেতা আবদুল মালিক বদরউদ্দিন হুতি বলেছেন, আমেরিকা এই অপরাধের জন্য অনুশোচনা করতে বাধ্য হবে। এর ফলে প্রতিরোধ ফ্রন্টের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি জোরদার হবে।
ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতিসহ আশেপাশের দেশগুলোতে ইরান সমর্থিত সংগঠনগুলোর কাছে প্রচুর ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে চাইলে বড় ধরনের বেকায়দায় পড়ে যাবে তেলআবিব। পাশাপাশি এখন পর্যন্ত যেসব জায়গা দখল করেছে, সেগুলো ছাড়তেও বাধ্য হবে তারা। সব মিলিয়ে স্মরণকালের আতঙ্কে রয়েছে তেলআবিব।
তবে গত দুই সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে পরিস্থিতি পাল্টেছে বেশ কয়েকবারই। জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর পুরো বিশ্বজুড়ে উৎকণ্ঠা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি সিমপ্যাথি ঝুঁকেছিল ইরানের দিকে। ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার বিষয়টিও তাই সমর্থন পেয়েছে অনেকেরই। কিন্তু ‘মানবীয় ভুলের’ কারণে ইরান নিজেদের মাটিতে যাত্রীবাহী বিমানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যে অমার্জনীয় ভুল করেছে, তাতে বিশ্বের জনমত আবার ইরানের বিপক্ষে চলে যায়।
আবার যারা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণেই ইরানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে, তারা কেবল ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার মাধ্যমে কাসেম সোলাইমানির হত্যার ‘আপাতত’ বদলা শেষ করায় বেশ খানিকটা হতাশ হয়েছে, যদিও বিশ্বশান্তি বিশেষ করে বিশ্বের অর্থনীতিকে মন্দাক্রান্ত থেকে রক্ষা করার জন্য এটাই ছিল সঠিক পদক্ষেপ। আবার ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ইরানকে শান্ত থাকার বিনিময়ে অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তা থেকে সরে এসে আবারো নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরওপ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় তা এখনোই বলা যাচ্ছে না।