ভারত মহাসাগরে ধেয়ে আসছে রাশিয়া
ভারত মহাসাগরে ধেয়ে আসছে রাশিয়া - ছবি : সংগৃহীত
স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার একটি হাইপোসিস ছিল এই যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত মহাসাগরে ‘পা ভেজানোর’ আশা করছে। এটি আসলে সেই ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জনের (১৮৯৯-১৯০৫) লেখা ‘অ্যাঙ্গো-রুশ প্রশ্ন’ নামে পরিচিত ভূরাজনৈতিক ধারণার সম্প্রসারণ মাত্র। আমরা এখন জানি যে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ আসলে যতটা না ছিল কৌশলগত, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল পরিস্থিতিগত প্রয়োজন।
তবে এখন রাশিয়া আসছে ভারত মহাসাগরে এবং সেটা কৌশলগত কারণে। সেটা তারা করছে সামরিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত মার্কিন নীতির প্রতিক্রিয়ায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রায়ই জোরালোভাবে বলে থাকেন যে সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি তার বিশ্বাস আছে। সম্প্রতি ৮ জানুয়ারি ইরান প্রশ্নে বক্তৃতায় ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য প্রক্রিয়ায় ন্যাটোকে নিয়ে আসার ব্যাপারে তার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছেন।
তবে রাশিয়াও ৪ ডিসেম্বর ন্যাটোর লন্ডন ঘোষণাটি এড়িয়ে যেতে পারেনি। তাতে সব কৌশলগত দিক থেকে পাশ্চাত্যের প্রতি রাশিয়ার ‘আগ্রাসী পদক্ষেপগুলো’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ট্রাম্পের বক্তৃতার দুদিন পর ১০ জানুয়ারি ন্যাটোর একটি প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে পৌঁছে যায় ট্রাম্পের আমাদের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা প্রয়াসে সব বোঝা ভাগাভাগি করার আলোকে ইরাকে ন্যাটোর ক্রমবর্ধমান ভূমিকা নিয়ে আলোচনার জন্য।
একই দিন রোমে ওয়াশিংটন ইতালি-যুক্তরাষ্ট্র ডায়ালগের সূচনার কথা ঘোষণা করে জানায়, দুই মিত্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করবে।
এরপর ১২ জানুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও তার তুর্কি প্রতিপক্ষ মাভলুত ক্যাভুসোগলুর সাথে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার সময় এই অঞ্চলে ন্যাটোর ভূমিকার কথা বলেন। স্পষ্টভাবেই বলা যায়, ট্রাম্প কথার কথা বলেননি। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার জন্য ন্যাটোর একটি পরিকল্পনা আছে এবং তা বাস্তবায়ন করতে চায় তারা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় নিজের অবস্থান সুসংহত করেছে রাশিয়া। তুরুস্কের সাথে আঁতাত করে তারা কাজটি করেছে। বিশেষ করে লিবিয়াকে স্থিতিশীল করার কাছে যৌথ পদক্ষেপ ও সিরিয়ার ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের কথা বলা যায়। অন্যদিকে সিরিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়াকে তুলে ধরেছে।
কিন্তু রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে নাজুক বিষয় হলো ভারত মহাসাগর। এখানে রাশিয়াকে মাঝে মধ্যে দেখা যায়। রাশিয়া অনেক দেরিতে এ দিকে চোখ ফিরিয়েছে। রাশিয়া ও চীন গত নভেম্বরের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে মিলে প্রথমবারে মতো ত্রিদেশীয় নৌমহড়ার আয়োজন করে। এক মাস পর তারা ইরানের সাথেও একই ধরনের যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়।
এর পক্ষকালের মধ্যেই উত্তর আরব সাগরের কোনো এক স্থানে রাশিয়া ও মার্কিন রণতরী ক্রুদ্ধভাবে একে অপরের দিকে ছুটে যায়। মার্কিন পঞ্চম নৌবহর ৯ জানুয়ারি অভিযোগ করেছে যে রাশিয়ার নৌবাহিনীর একটি জাহাজ (সম্ভবত গোয়েন্দা জাহাজ) আগ্রাসীভাবে ইউএসএস ফারাগাটের দিকে ধেয়ে আসে। ৫১০ ফুটের গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ডেস্ট্রোয়ারটি উত্তর আরব সাগরে নিয়মিত অভিযানে ছিল বলেও জানানো হয়।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে জানায় যে এটি নিরাপদে নৌচলাচলের আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রুশ অভিযোগে বলা হয়, মার্কিন ডেস্ট্রোয়ারটি রুশ নৌবাহিনীর জাহাজের ট্রাফিক লেন অতিক্রম করেছি।
এই প্রেক্ষাপটে ১৪ জানুয়ারি রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভের ‘ওয়ার্কিং সফরে’ কলম্বো যাওয়াটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র যখন আবারো শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ সময়কার যুদ্ধপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নেভেজায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে উত্থাপন করেছে, তখনই এই সফরটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, দৃশ্যত চীনকে সংযত করার যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ জোটে যোগ দিতে শ্রীলঙ্কাকে বাধ্য করার লক্ষ্যেই এই চাপ সৃষ্টি করছে ওয়াশিংটন।
জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনে পাশ্চাত্যের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কা ঐতিহ্যগতভাবে রাশিয়া ও চীনের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। ল্যাভরব শ্রীলঙ্কাকে আশ্বাস দেবেন যে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বোকে চাপ দেয়ার প্রয়াস তার দেশ রুখে দেবে।
কাকতালীয়ভাবে ১৩-১৪ জানুয়ারি চীনা স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়িও কলম্বো সফর করবেন।
সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, ভারত মহাসারগীয় ভূরাজনীতিতে বর্তমানে শ্রীলঙ্কা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। চীন ও রাশিয়া চায়, শ্রীলঙ্কা যেন তার কৌশলগত সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বজায় রাখে। এ ব্যাপারে মস্কো ও বেইজিং পরস্পরের সাথে সমন্বয় করেই কাজ করবে।
এই দুই দেশের সমন্বিত প্রয়াসের ফলে শ্রীলঙ্কায় মার্কিন চাপ রুখে দেয়া সম্ভভ হবে। শ্র্রীলঙ্কার সাথে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা চুক্তিও আছে। অস্ত্র বিক্রির চুক্তিও আছে রাশিয়ার। তারা এই চুক্তিটি সম্প্রসারণ করতে চাচ্ছে।
আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে ল্যাভরভের বিশেষ আগ্রহ আছে। ১৯৭২ সালে কলম্বোতেই তিনি তার কূটনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। এলটিটিইর যুদ্ধের সময় তিনি মস্কোর হয়ে শ্রীলঙ্কাকে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছিলেন।
আবার ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে গুটিয়ে নিতে হলে তারা শ্রীলঙ্কার মাটিতেই বসতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য ইরাক ত্যাগ করতে যাতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য না করা হয়, সেজন্য নানাভাবে বাগগদাদকে হুমকি দিয়ে আসছে ওয়াশিংটন।
ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন